মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়াই ইলেকশন কমিশনের কাজ?

Election Commission of India : সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে আধার কার্ডকেই প্রামাণ্য বলে ধরতে হবে। এই সুবিচার যদি নির্বাচন কমিশন মানেন তো মঙ্গল।

নির্বাচন কমিশনের নতুন ম্যাসকট ‘স্যার’ অনেকের মনেই একটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভয়ের কারণ, কোনও কাগজ দেখাতে না পারলেই দলছুট-দেশছুট-ভোটছুট হয়ে পড়ব আমরা! কোন কাগজ তাঁরা মানবেন, আর কোনটা মানবেন না— তা বলা মুশকিল। তার থেকেও বড় কথা হল এই কাগজ দেখবার অধিকার কি নির্বাচন কমিশনের আছে? কারণ এই কাগজ দেখা ও দেখানোর সঙ্গে তাঁরা জুড়ে দিয়েছেন নাগরিকত্ব যাচাই করার একটা মহান দায়। যেমন, একসময় ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূরা মনে করতেন অবশিষ্ট দুনিয়ার ‘অসভ্য’ মানুষদের ‘সভ্যতার আলো’ দেখানো নাকি তাঁদের কর্তব্য— ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’।

যতদূর সাংবিধানিক দায়ের কথা জানা যায় তাতে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং তার স্বার্থে নির্বাচক তালিকা বা ভোটার লিস্ট নির্ভুলভাবে তৈরি করা অবশ্যই তাঁদের কর্তব্য। কিন্তু ভোটারের নাগরিকত্ব যাচাই করা, তাঁদের অধিকারের বাইরের বিষয়। মনে রাখতে হবে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সিদ্ধান্ত নেন নাগরিকতা নিয়ে, নির্বাচন কমিশন নয়।

আরও পড়ুন-

রোহিঙ্গা সমস্যার মধ্যেই উপ্ত ছিল বাঙালি নিপীড়নের বীজ

আর, এই ভোটার লিস্টের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রতি বছর একটা নিয়মিত সংশোধনের ব্যবস্থা আছে। নভেম্বর মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, এই সংশোধন চলে এবং সারা দেশেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সংশোধিত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়। এই মুহূর্তে যে-ভোটারতালিকা চালু আছে তা প্রকাশ হয়েছে জানুয়ারি ২০২৫-এ। এছাড়া বেশ কয়েকবছর হল বারোমাস-ই ভোটার তালিকায় নাম তোলা বা বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনলাইন বা অফলাইনে যে কেউ যখন খুশি আবেদন করতে পারেন। এটা ঠিক যে এই নিয়মিত সংশোধন সত্ত্বেও কখনো-কখনো বিশেষ নিবিড় সংশোধন (যার ডাক নাম SIR) দরকার হয়। পশ্চিমবঙ্গে শেষ এমন সংশোধন হয়েছে ২০০২ সালে। ২০০১ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ছিল এবং পরের লোকসভা নির্বাচন ছিল ২০০৪-এ— ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়, দুই নির্বাচনের মাঝখানের বছরগুলিতে এই সংশোধন-কাজ করা হয়েছিল অনেকখানি সময় নিয়ে। এখন বিহারে বিধানসভার ভোট আসন্ন এবং এই রাজ্যেও আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভোট হবে— দুটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই এই সময় নির্বাচন (পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এখনও সরকারি ঘোষণা হয়নি) যাকে বলে ‘হাইলি সাসপিশাস’! এত তাড়া কীসের? এই ধরনের নিবিড় সংশোধনের ক্ষেত্রে মূলত বাড়ি-বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়— সারা রাজ্যে আনুমানিক সাড়ে তিন কোটির মতো পরিবার আছে— এদের থেকে তথ্য তুলে আনা এবং সেই তথ্য বিচার করা কি এত অনায়াসসাধ্য? বিহারের ভোটার-সংখ্যা আমাদের রাজ্যের থেকে বেশি, সেখানেও অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে এই তথ্য সংগ্রহ করা হল— এটা কি কমিশনের সদিচ্ছা? না কোথাও একটা কথা রাখার দায়? নাকি কাউকে ‘সোনার হরিণ’ ধরে এনে দেওয়ার মহাকাব্যিক প্রতিশ্রুতি?

ভারতের নির্বাচন কমিশন

তাড়াটা আসলে কোথায় তা অবশ্য মহামান্য কমিশন ঠারেঠোরে প্রকাশ করে ফেলেছেন। আসলে তাঁদের মাথায় কেউ বা কারা ঢুকিয়ে দিয়েছেন এবং এই বিষয়ে তাঁরাও যে তেমন মাথা খাটাননি তা হল, গোটা দেশ না হলেও উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারত নাকি বিদেশি অনুপ্রবেশীদের দ্বারা থিক থিক করছে। আর এইসব ‘ঘুসপেটিয়া’-রা সেঁধিয়ে গেছে ভোটার তালিকায়। বল্মীকবাহিনীর কী প্রবল প্রতাপ! রাতের আঁধারে কিংবা ফ্যাটফেটে দিনের আলোয় তারা বাংলাদেশ থেকে সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো এবং পকেটে প্রণামী গুঁজে দিয়ে শুধু ভারতমাতার কোলে আশ্রয় নিয়েছে তাই নয় বিদেশি রাষ্ট্রে ঢুকে তারা আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড-ও পেয়ে গেছে! এই দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি তাদের কে দিল মশাই? প্রথমটি ইউ আই ডি, কেয়ার অফ কেন্দ্রীয় সরকার আর পরেরটা স্বয়ং নির্বাচন কমিশন। নাকি সীমান্তচৌকি পেরোনোর সময়ই সীমাসুরক্ষা বল তাদের হাতে-হাতে এইসব সরকারি নথি উপহার হিসেবেই তুলে দিয়েছিল? গোলমাল এখানেও যে, সমীক্ষার আগেই কত জনের নাম বাদ যাবে তাও জানা গেল নানা সূত্রে— কোথাও সবজান্তা মিডিয়া, কোথাও রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুরা বলতে আরম্ভ করলেন ৫৫-৬৫ লক্ষ নাম বাদ যাবে — রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা হয়ে গেল! অতএব ৩০ লক্ষ, ৫০ লক্ষ, ৬০ লক্ষ — আই পি এল-এর খেলোয়াড় নিলামের মতোই উইপোকাদের সংখ্যা বাড়তে-বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছল যে এইসব বাচাল ও নিরেট নেতারা খেয়ালই করলেন না অনুপ্রবিষ্ট রোহিঙ্গাদের যে সংখ্যা তাঁরা লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন, কার্যত গোটা দুনিয়ায় অত রোহিঙ্গাই নেই।

আরও পড়ুন-

উদ্বাস্তুদের মানচিত্র কোথায়? কীভাবে বাংলাদেশে ভিটেহারা হয়ে এলেন রোহিঙ্গারা?

দেশে-বিদেশি রাষ্ট্র থেকে অনুপ্রবেশের স্বীকৃত তথ্য থাকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। ২০০৪ সালে তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন যে ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে; ২০১৬ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু ভারতের সংসদে বলেছিলেন, 'ভারতে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ২ কোটি অবৈধ অভিবাসী রয়েছে', আবার বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘উইপোকার’ সঙ্গে তুলনা করে ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৮ সালে বলেছিলেন, বিজেপি ৪০ লক্ষ অবৈধ অভিবাসীকে চিহ্নিত করেছে, শুধু তাই নয় পশ্চিমবাংলা থেকে ২ কোটি অবৈধ অভিবাসীকে তাঁরা বার করে দেবেন। কিন্তু ‘ইকোনমিক টাইমস’-এর একটি প্রতিবেদনে (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩) স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে দেশে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সরকারের হলফনামায় বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্তকরণ ও বহিষ্কার একটি জটিল এবং চলমান প্রক্রিয়া। কারণ তাদের প্রবেশের কোনো বৈধ নথি নেই। ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই-ও সংসদে বলেছিলেন যে, অবৈধ অভিবাসীদের গোপনে প্রবেশের কারণে তাদের সম্পর্কে কোনও সঠিক তথ্য সরকারের হাতে নেই। তাহলে যে-বিষয়ে সরকারের নিজের ভাঁড়ারেই কোনো তথ্য নেই তার ভিত্তিতে একটা অনুমান করে নিয়ে ভোটার লিস্টে ভুত খোঁজার চেষ্টার মানে কী?

আচ্ছা, সরকারের কাছে অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কেন? কারণ, আমাদের দেশে জনগণনাই হল একমাত্র প্রক্রিয়া যার ভিক্তিতে এই অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করা যায়। শেষ সেন্সাস থেকে (২০১১) পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে এই ধরনের অভিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লক্ষ, যার মধ্যে ২৩ লক্ষ বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ৭ লক্ষ — এদের মধ্যে একটা বড় অংশ ১৯৯১-এর আগে থেকেই এ-দেশে বাস করছিলেন বলে সমীক্ষায় জানা গেছে। কার্যত ২০১১ সালের খবর অনুযায়ী সেই বছর এ-রাজ্যে সরকারিভাবে অভিবাসন নিয়েছিলেন মাত্র ২২ হাজার জন। কিন্তু তার পরে প্রায় পনেরো বছর পেরিয়েছে, জনগণনা হয়নি। ফলে, সরকারিভাবে এই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। অথচ ওয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির বানানো পঞ্চায়েতে লক্ষ-কোটি অভিবাসীর হিসেব উপচে পড়ছে! যে যার মতো মনের গোবরমাটি মিশিয়ে বিষয়টিকে বহুফসলি করে তুলেছেন। কিন্তু কেউই এইটুকু বলছেন না, কেন এখনও দশ বছরের নিয়মিত জনগণনা হল না? তা বলে কি ‘অবৈধ’ অভিবাসী দেশে বা রাজ্যে নেই? আছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার দিনের পর দিন এই বিষয়ে কোনো নিবিড় সমীক্ষা চালাননি, সেন্সাস না করলেও সীমান্তবর্তী এলাকায় এমন সমীক্ষা করতে কোনো বাধা কিন্তু ছিল না। গত কয়েক বছর আগে তাঁরা আইন পরিবর্তন করে বি এস এফ-এর সীমানা মূল দেশের পঞ্চাশ কিলোমিটার বাড়িয়ে নিয়েছেন।

রোহিঙ্গা জাতির মানুষেরা

যে-পরিমাণ অনুপ্রবেশের গপ্পো বাজারে ছড়িয়ে আছে তা যদি সত্যি হত তাহলে সীমান্তের ওপারে-এপারে আমরা দেখতে পেতাম দীর্ঘ লাইন, তৈরি হত খাদ্য সংকট— ঠিক যেভাবে অন্য নানা দেশে হয়েছে। একশো টাকার একশোটা নোটের মধ্যে দু-তিনটে জাল নোট থাকতে পারে কিন্তু পঞ্চাশটাই জাল নোট থাকতে পারে না। কিন্তু এর কিছুই প্রায় নির্বাচন কমিশনের মাথায় ঢুকছে না এবং তাঁরা প্রায় দেশের সব নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

কিন্তু এ তো প্রায় আত্মঘাতী গোল। ১৯৫২ সাল থেকে দেশে যে নির্বাচন হয়ে আসছে তার ভোটার লিস্ট শতকরা একশো ভাগ সঠিক ছিল তা কেউ দাবি করেন না, সেকালেও যে ভোটে একটু-আধটু কারচুপি হয়নি তা নয়। তাহলে যে ২০০৩-এর ভোটার লিস্টকে তাঁরা মূল ভিত্তি ধরছেন তা-ও কি পুরো ত্রুটিহীন? এই বিষয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশন হলফনামা দিতে রাজি আছেন কি?

কমিশনকে ঘিরে আরও দুটি গভীর জিজ্ঞাসা আছে। প্রথমত, নতুন নাগরিক যাতে ভোটাধিকার পান সেটা নিশ্চিত করা ও মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারের নাম বাদ দিয়ে ভোটার লিস্টকে ত্রুটিহীন করে তোলা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে — কিন্তু এস আই আর-এর প্রশ্নে তাঁরা যখন ত্রুটিপূর্ণ লিস্ট প্রকাশ করে নাম বাদ দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন, তখন ওই ভুল ভোটার লিস্ট তাঁরা এতদিন মেনে নিলেন কেন? নির্বাচন কমিশন যাদের বাদ দিলেন তাদের নাগরিকতা যাচাই হল কোথায়? সেন্সাস নেই, বিশেষ সমীক্ষা নেই, সরকারি তথ্য নেই! এত মানুষ দেশ টপকে ঢুকে গেলেন আর কাকপক্ষীতেও টের পেল না?

এখন বলা হচ্ছে আধার কার্ড মানা হবে না, রেশন কার্ড মানা হবে না। বেশ, মৃত্যুর শংসাপত্র মানেন কি? সরকারের কাছে প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর তথ্য আছে, কেননা আধার কার্ডের মাধ্যমে প্রতিটি মৃত্যু নিবন্ধীকৃত না-হলে শবদেহ দাহ বা সমাধিস্থ করা যায় না। এবং সেই সঙ্গে রেশন কার্ড জমা নিয়ে নেওয়া হয়। তাহলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে থাকা ওই তথ্য নিয়ে মৃত ভোটারদের নাম বাদ দিচ্ছে না কেন নির্বাচন কমিশন? ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় এইটুকু কাজ প্রযুক্তিবিদরা করতে পারেন না? উলটে জীবিত ভোটারদের ঘাড়ে দায় ফেলছেন যে, নিজেদের বেঁচে থাকার প্রমাণ নাকি নিজেদেরই দাখিল করতে হবে!

সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে আধার কার্ডকেই প্রামাণ্য বলে ধরতে হবে। এই সুবিচার যদি নির্বাচন কমিশন মানেন তো মঙ্গল। প্রশ্ন হল আসলে তাঁরা কী চান? ভোটার লিস্ট ত্রুটিমুক্ত করে নির্বাচন-ব্যবস্থা অবাধ করতে? নাকি এক শ্রেণির ভোটারকে বাদ দিয়ে মানুষের মনে এক ধরনের আতঙ্ক বুনে দিতে? হয়তো নির্বাচন কমিশন চান নিজেদের পঞ্চবার্ষিক ভোটাধিকারের প্রত্যাশায় হন্যে হয়ে ফেরা মানুষ আরও-আরও কাদায় পড়ুক। অথবা তাঁদের কাছে হাতজোড়করা বিনতিতে গলে পড়ুক।

তথ্য-ঋণ : ‘এককমাত্রা’ পোর্টালে প্রকাশিত অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধ (২০ জুলাই, ২০২৫)

More Articles