রূপান্তরকামী হিসেবে মোক্ষম জবাব সমাজকে, আলাপচারিতায় উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম স্মরণ্যা ঘোষ
Interview of Transgender Sharanya Ghosh : উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম, মেধা দিয়েই সমাজকে মোক্ষম জবাব রূপান্তরকামী শরণ্যার
কন্যা তুমি বড়ই কঠিন, হৃদয় জোড়ো রোজ, বিশ্বজুড়ে তোমার ছোঁয়ায় স্বপ্ন চালায় খোঁজ! ধন্যি মেয়ে! উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশ হতেই এই মেয়ের কৃতিত্বের আলো ছড়িয়েছে রাজ্যজুড়ে। দেশ-দেশান্তরেও আলোচিত তিনি। বারবার উঠে আসছে তাঁর কথাই। একাধিক কৃতীকে ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন মৌলিক-অভিনব এবং অনন্য! স্মরণ্যা ঘোষ। হুগলির জনাইয়ের বাসিন্দা স্মরণ্যা পরিচিত হয়েছেন তাঁর মেধার জোরেই। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৯০ নম্বর পেয়ে রাজ্যে সপ্তম স্থান দখল করেছেন জনাই ট্রেনিং উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী। প্রথম দশে থাকা ৮৭ জনের মধ্যে রয়েছে স্মরণ্যা। অথচ বাকি সবাইকে পিছনে ফেলে কীভাবে এগিয়ে গেলেন তিনি? কেনই বা বারবার আলোচনায় উঠে আসছেন স্মরণ্যা? কোন উদাহরণ তৈরি করলেন তিনি?
স্মরণ্যা ঘোষ। সম্ভবত, রাজ্যে এই প্রথম কোনও রূপান্তরকামী নারী হিসেবে এমন ফল করেছেন তিনি। দেশের মেধা-মানচিত্রেও ইতিহাস গড়েছেন এই কন্যা। স্মরণ্য থেকে স্মরণ্যা হয়েও অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। সেই স্মরণ্যা ঘোষের মুখোমুখি হল ইন্সক্রিপ্ট। একাধিক প্রশ্নে উঠে এল তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়...
কেমন আছেন?
খুব ভালো। এতদিন যা ছিলাম, এখন তিনগুণ বেড়েছে এই ভালো থাকার মাত্রা।
৮৭ জন প্রথম দশে। আপনিও একজন। কিন্তু যখন নিজের নাম শুনলেন, কী মনে হচ্ছিল?
দেখুন, ভালো ফল যে হবে এমন আশা আমার আগে থেকেই ছিল, তবে ফল প্রকাশের পর যখন সত্যিই দেখলাম আমি স্থান পেয়েছি, রাজ্যে সপ্তম হয়েছি, তখনকার আনন্দটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ভালো লেগেছে এটা ভেবে যে, এই তো আমিও পেরেছি! এতকিছুর পরেও হারিয়ে যাইনি আজও!
তারপর? রাতারাতি কোনও পরিবর্তন এসেছে জীবনে? ভালো ফল এবং...
(কথা থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন স্মরণ্যা) একথা সত্যি। স্বাভাবিকভাবে আমাদের মতো অনেককেই কম বেশি সমাজের বাঁকা দৃষ্টির শিকার হতে হয়। হ্যাঁ, পরিবর্তন তো টের পাচ্ছি। অবাকও হচ্ছি অনেককে দেখেই! যে-ই আমি ভালো ফল করলাম, এবং সংবাদমাধ্যমে আমার নাম প্রকাশ পেল, তখনই কেউ কেউ হঠাৎ করে কেমন বদলে গেলেন! মানুষের এই দুম করে বদলে যাওয়াটাই অবাক করে আমায় বারবার।
অর্থাৎ কাল পর্যন্ত বাঁকা চোখ! তথাকথিত সমাজের কটূক্তির মুখোমুখি হতেন! আর আজ উল্টো?
না, মোটেই এমনটা বলব না যে এতো সহজেই রাতারাতি সব পাল্টে গিয়েছে! হয়তো বাবা, মা অথবা আমার সামনে কেউ সরাসরি বলেননি কিছুই। কিন্তু আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেকের আপত্তি তো ছিল। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সামনে না থাকলেও পিছনে তো ছিল!
মেধাবী হয়েও পড়াশুনার ক্ষেত্রে এই অস্বস্তির শিকার হয়েছেন বারবার?
যদি বলি হইনি, মিথ্যা বলা হবে। ওই যে বললাম, একটা বাঁকা নজর ছিলই! তবে আমার সাফল্য আমাকে বারবার সেই বাঁকা নজরকে উপেক্ষা করতে সাহস জুগিয়েছে। তবে আজকের সাফল্য যে খানিকটা হলেও এই ছবিটা বদলে দিয়েছে সেটা বলতেই হচ্ছে। যদিও সবটা বদল তো এভাবে আসে না তাই হয়তো এখনও কেউ কেউ বাঁকা চোখেই দেখেন!
স্মৃতি নিয়েই এগোয় মানুষ। আপনি এক সময় স্মরণ্য ছিলেন, তারপর এই লড়াই। কেমন ছিল সবটা?
মারাত্মক লড়াই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একটু বুঝতে শিখতেই অনুভব করতাম আমি আসলে মেয়ে। আমাকে পুরুষের শরীর দেওয়া হয়েছে শুধু। আমি পুরুষালি নই। এই দোটানা আমায় বারবার আঘাত করেছে। ঠিক তখনই চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা আমার মতোই আরও অনেক লড়াইয়ের গল্প মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষের লড়াই দেখেছি। শিখেছি। তারপর যখন ক্লাস এইটে পড়ি আস্তে আস্তে আমার শরীরবৃত্তীয় নানা পরিবর্তন ঘটে। আমার বাবা, মা চিকিৎসকের কাছে যান আমাকে নিয়ে। কাউন্সেলিং শুরু হয়। নানা সমস্যা আসতে শুরু হয় তারপরেও। অবশেষে চিকিৎসকের পরামর্শে আর নিজের সত্তা নিয়ে খেলা করিনি আমি।
কবে থেকে পাকাপাকিভাবে নিজেকে নারী হিসেবে খুঁজে পেলেন?
আমি স্কুলে যেতাম। আমাকে সকলে স্মরণ্য হিসেবেই চিনতেন। কিন্তু যেদিন আমার একাদশের রেজাল্ট বেরোয়। আমার মনে আছে, সেদিন আমি মেয়েদের জন্য বরাদ্দ স্কুলের পোশাক সালোয়ার কামিজ পরে স্কুলে যাই। এটাই প্রথম নিজেকে মেয়ে হিসেবে সকলের সামনে স্বীকৃতি দেওয়া।
কিন্তু সেই হঠাৎ পরিবর্তনের ফল তো মারাত্মক ছিল?
তেমন নয়! অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু আমার মা এবং বাবার নিরন্তর পাশে থাকা সব বাধা কাটিয়ে দিয়েছে মুহূর্তেই। আর আমার মনেও জোর ছিল প্রথম থেকে, আমি জানতাম এই লড়াইটা আমার নিজস্ব।
আচ্ছা, পড়াশোনার বাইরে আর কী কী করতে ভালোবাসেন আপনি?
আমি পুজো করতে ভালোবাসি। মূর্তি তৈরি করতে পারি। একা একা বাড়িতে দুর্গাপুজো করি। এসব আমার খুব ভালো লাগে।
আপনি লড়াইয়ে আছেন। লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়ে এগিয়েছেন রোজ। কিন্তু যাঁরা পারছেন না, চেষ্টা করেও হেরে যাচ্ছেন বারবার। তাঁদের জন্য কী বলবেন?
শুধু মেধা দিয়ে নয়, সার্বিক শিক্ষা দিয়ে বদলে দেওয়া যায় সব। এই বৈষম্যকে জব্দ করা যায় শিক্ষার দ্বারাই। আমি বলব, বিদায় নেওয়া মানে হেরে যাওয়া। মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা মানে, জীবনের সমস্যা সমাধান না করে ভীতুর মতো পালিয়ে যাওয়া! লড়াই করুন। শিক্ষা দিয়ে রুখে দাঁড়ান। দেখবেন সব ঠিক লাগছে!
কী হতে চান এরপর?
প্রথম লক্ষ্য অধ্যাপনা করা অথবা শিক্ষকতা করা। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য প্রশাসনিক কোনও পদে কাজ করা।
কেন এই দুটি কাজকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন, এই ইচ্ছার আসল কারণটা যদি বলেন?
দেখুন, একজন শিক্ষক পারেন মানুষ গড়তে। আমি শিক্ষক হতে চাই এই মানুষ গড়ার কাজ করার জন্য। যেন আমার ছাত্ররা শিখতে পারেন, সকলেই সমান। সবার সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা আছে। আর প্রশাসনিক কাজে গেলে সেখানেও একটা প্রভাব অথবা ক্ষমতা থাকবে। যা আমার মতো মানুষ শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে মানুষের জন্য কাজ করতে সুবিধা দেবে। মানুষের সেবা করতে পারব।
রূপান্তরকামী অথবা রূপান্তরিত নারীদের নিয়ে একাধিক অভিযোগ ওঠে, জোর করে টাকা নেওয়া; ইত্যাদি! কী বলবেন?
একটা সময় ছিল, এই ধরনের মানুষদের বারবার বিতাড়িত হতে হয়েছে। বঞ্চিত ওঁরা। আজও অনেক ক্ষেত্রেই এই জিনিস লক্ষ্য করা যায়। তাহলে ওঁরা যাবেন কোথায়? কাজ নেই, শিক্ষা নেই। সম্মান নেই। নিরাপত্তা নেই। কিছু তো একটা উপায় লাগবে। তাই হয়তো জীবনই ওদের বাধ্য করে এই পথ বেছে নিতে। কেউ কি ইচ্ছে করে খারাপ হতে চায়?
এই পরিস্থিতি কী বদলানো সম্ভব বলে মনে করেন?
অবশ্যই। এর জন্য দরকার যথার্থ শিক্ষা। চাকরি। নূন্যতম নিরাপত্তার বন্দোবস্ত। তাহলেই সম্ভব!
বিশেষ কিছু বলবেন এই সমাজের উদ্দেশ্যে?
অর্ধ নারী শ্বর! কৃষ্ণকালী। দেবতার মধ্যে উভয়ের ছোঁয়া নিয়ে তো কই কারোর সমস্যা হয় না, তাহলে বাস্তবে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? কেন কেবল মানব জীবনের ক্ষেত্রেই ব্রাত্য হয়ে থাকার ভয়? আমি শুধু একটাই কথা বলব, দেখুন, আমরাও পারি। আমরাও আসলে নারী!
রূপান্তরকামী নারী আপনি। এই সাফল্যের কারণে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনার মুখোমুখি হলে কী বলবেন?
শুধু রূপান্তরকামীদের জন্য নয়, এই সমাজের পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত সকলের জন্য বলব। সরকার আরও সচেতনতা বাড়াক। প্রচার চলুক। মানুষের মধ্যে ধারণা স্পষ্ট হলেই বদলে যাবে সব।
আপনি শিক্ষক হতে চাইছেন। কিন্তু সেই শিক্ষক নিয়োগ নিয়েই বিতর্ক। ধর্না। মামলা। কী বলবেন?
দেখুন, সবসময় সব শান্ত থাকে না। ঝড় উঠেছে। একদিন তো এই ঝড় থামবেই! মুছে যাবে সব। ঠিক তো হতেই হবে।
এখন সুপ্রিম কোর্টে চর্চা চলছে সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে। শিক্ষা, ইচ্ছা সবকিছু মিলিয়ে এই বিষয়ে কী বলবেন?
আদালতে বিচারাধীন বিষয়। তেমন কিছু বলব না। কিন্তু জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী বাছার ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ কেন্দ্রের। আদি থেকে বর্তমান। বাৎসায়ন থেকে এই সময়! সব ক্ষেত্রেই সমলিঙ্গ সম্পর্কের কথা ব্যক্ত হয়েছে বারবার। একাধিক পুরান-চরিত্রে উঠে এসেছে এই ছবি। তবুও কীসের আপত্তি? নিজের সঙ্গী বাছার স্বাধীনতা নিজের হাতেই থাকা উচিৎ। একজন মানুষ কার সঙ্গে থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত তার উপরেই ন্যস্ত হওয়া প্রয়োজন।