"উচ্চবর্ণরা দলিতদের পোকামাকড় হিসাবে দেখে", বলেছিলেন ফুলন দেবী
Phoolan Devi Speech: ২০০১ সালে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে দুবাইয়ের আলমি মুশায়রায় যোগ দিয়েছিলেন ফুলন দেবী। সেখানে তাঁর বেঁচে থাকা, অবিচার এবং লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন খুব সাদামাটা ভাষাতেই।
উত্তরপ্রদেশের জালোনের কাছে একটি ছোট্ট গ্রামে ১৯৬৩ সালের ১০ অগাস্ট জন্ম হয় ফুলন মাল্লার। পরবর্তীতে দেশ তাঁকে চিনবে 'ডাকাত রানি' হিসেবে, চিনবে 'ফুলন দেবী' হিসেবে। 'নীচ' মাল্লা হয়ে উঠবেন 'দেবী'! জন্ম থেকেই দারিদ্র এবং সামাজিক বৈষম্যের মুখে পড়েছিলেন ফুলন। উত্তরপ্রদেশে 'মাল্লা' তথাকথিত নিচু জাতি হওয়ায় সমাজের উচ্চবর্গের শোষণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত! পরিবার এবং সমাজের চাপে মাত্র দশ বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে। বিয়ের পর প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার হতে হয় ফুলনকে। বাধ্য হয়ে, থাকতে না পেরে সেখান থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে ফুলন। একে দলিত, তায় মেয়ে! শ্বশুরের ঘর ছেড়ে চলে আসার এই ঘটনা একঘরে করে দেয় ফুলনকে। তারপরেই স্থানীয় ডাকাতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় ছোট্ট ফুলনের। বন্ধু বিক্রম মাল্লার সঙ্গে মিশে ডাকাত দলে যোগ দিয়ে দেন ফুলন।
বিক্রম মাল্লা খুন হন অন্য ডাকাত দলের হাতে। অপহরণ করে নেওয়া হয় ফুলনকে। তিন সপ্তাহ ধরে লাগাতার ধর্ষণ করা হয় তাঁকে। গ্রামে নগ্ন করে ঘোরানো পর্যন্ত হয় ফুলনকে। এরপর ঠাকুররা একদিন অর্ধমৃত অবস্থায় রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে চলে যায় ফুলনকে। ভেঙে পড়ার মেয়ে ছিলেন না ফুলন। প্রতিশোধ নেওয়ার পণ করে ১৬ বছরের কিশোরী ফুলন মাল্লা হয়ে ওঠেন ফুলন দেবী। যে গ্রামে তাঁকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়েছিল, ১৯৮১ সালে সেই বেহমই গ্রামে ফিরে আসেন ফুলন। নিজের বিশাল ডাকাত বাহিনী নিয়ে ঠাকুরদের উপর হামলা চালান ফুলন দেবী। গ্রামের চৌমাথায় ঠাকুর গ্যাংয়ের ২২ জন ডাকাতকে দাঁড় করিয়ে তাঁদের বুকে গুলি মেরে ফেলেন ফুলন।
আরও পড়ুন- ফুলন দেবীর খুনিই ভারতে আনেন পৃথ্বীরাজ চৌহানের অস্থি! জানেন, কে তিনি?
১৯৮৩ সালে মধ্যপ্রদেশে নিজের গোটা গ্যাং-সহ আত্মসমর্পণ করেন ফুলন দেবী। ২২টি হত্যা এবং ৩০টি ডাকাতির অপরাধে মোট ১১ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। ১৯৯৬ সালে সমাজবাদী পার্টির টিকিটে মির্জাপুর থেকে লোকসভা নির্বাচনে জিতে সংসদে পৌঁছন ফুলন। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই দুপুর ১:৩০ টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোতেই তাঁকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান ফুলন। ২০০১ সালেই, মৃত্যুর কিছুদিন আগে দুবাইয়ের আলমি মুশায়রায় যোগ দিয়েছিলেন ফুলন দেবী। সেখানে তাঁর বেঁচে থাকা, অবিচার এবং লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন খুব সাদামাটা ভাষাতেই। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন 'ডাকাত' দাগিয়ে দিয়ে সমাজ তাঁর লড়াইকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। নিপীড়িতদের জন্য মর্যাদা দাবি করেছিলেন ফুলন। বলেছিলেন,
আমার নাম ফুলন দেবী, লোকে আমাকে ‘দস্যু রানী’ বলেই চেনে। আমি জানতাম না এত সংগ্রামের পরও আমি বেঁচে থাকব। আমি আপনাদের সকলের মাঝে পৌঁছে যাব, এত সম্মান ও সমাদর পাব, এটা কখনই ভাবিনি। চার বছর আমি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছি।
আপনার নিশ্চয়ই জানেন যে আমাদের ভারতে — এমন এক অনুষ্ঠানে আমার এমন কথা বলা উচিত নয়, তবুও আমি বলব, আমার কী হয়েছে তা আমি আপনাদের বলব। আমাদের সামন্তরা, ধনীরা এবং বিশেষ করে — আমি যদি এখন জাতের নাম বলি, লোকে বলবে, ‘ফুলন দুবাই গিয়ে জাত নিয়ে কথা বলে এসেছে।’
এত উঁচু বর্ণের মানুষ যারা জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাস করে, তারা আমার মতো গরিব, দলিত, নির্যাতিত, সংখ্যালঘুদের পোকা-মাকড় মনে করে, আমরা মানুষ নই। তাই আমি সেই মানুষদের দেখিয়ে দিয়েছি যে আমিও একজন মানুষ, আপনারা আমাদের মেরে ফেললে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না, আমরাও পাল্টা লড়াই করব।
অনেকবার ভেবেছি আত্মহত্যার কথা, মরার কথা কিন্তু তারপর ভাবলাম প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে মারা যায়।
লোকে আমাকে ডাকাত বলে চেনে, ‘ডাকাত ফুলন দেবী’! আচ্ছা বলুন তো, আমার কি চারটে হাত-পা আছে? ওরা বলে, ‘ও চম্বল উপত্যকা থেকে এসেছে,’ — চম্বল উপত্যকাই কি আমার মা বাবা? আমার বাবা মা আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমার একটাই অপরাধ যে আমি কুঁড়েঘরে জন্মেছি, দরিদ্র পরিবারে জন্মেছি, নিপীড়িত সমাজে জন্মেছি। তাহলে কি আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই?
আমার ভাই ও বোনেরা, আমি কোনও ভুল করিনি, আমি ভারতেও মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলি। আবু ভাইয়ের সঙ্গে ওখানেও অনেক জমায়েত হয়েছে, অনেক বড় সমাবেশ হয়েছে। আমি কোনও অন্যায় করিনি।
আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন, আপনারা অনেকেই সেখানকার বাসিন্দা- সীতার কারণে মানুষ এখনও রাবণের কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। রাবণের একমাত্র অপরাধ ছিল যে তিনি একজন মহিলাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং মানুষ এখনও তার কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছে। তাহলে আমি কী ভুল করেছি? এইরকম রাবণরা তো আমার উপরও অত্যাচার করেছিল, আমি সেই রাবণদের জবাব দিয়েছিলাম।
‘ফুলন দেবী একজন ডাকাত, একজন দস্যু।’ শুধুমাত্র শ্রদ্ধেয় মুলায়ম সিংজির কারণে — আমার নাম নেওয়া উচিত নয় — আজ আমি সমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। তা না হলে অনেক বড় ষড়যন্ত্র করা হতো।
আমি কোনও অন্যায় করিনি— যারা আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, যারা আমাকে সমাজে যোগ্যভাবে বাঁচতে দেয়নি, রাগে মানুষ ভালো কাজ করে না, রাগ করে শুধু অন্যায় করে। আর ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, এটা একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্যই ঘটেছে যে, আপনারা যদি আমার মতো বোন-মেয়েদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচার করেন, তাহলে যে কোনও মহিলাই ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁর অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য দাঁড়াবেন।
তাই আমার ভাই ও বোনেরা, ওরা আমাকে ডাকাত ঘোষণা করেছে। আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সবাই একই বক্তৃতা দেয়। কারও আর কোনও ভাষণ বাকি নেই। বলুন, আমাকে দেখে কি ডাকাত মনে হয়? ডাকাত কারা? আপনারা আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছেন, লুট করেছেন, মারধর করেছেন। ডাকাত আসলে সেই অসাধু লোকেরা যারা আমার মতো মহিলাদের লুটপাট করে।
তাই আমার ভাই ও বোনেরা, চার বছর আমি জঙ্গলে ঘুরেছি, ১১ বছর আমি জেলে থেকেছি— জেলেও আমাকে পাগল মহিলাদের সঙ্গে রাখা হয়েছিল, আমাকে ভালো জায়গায় রাখা হয়নি। ‘এই মহিলা পাগল’— এই বলে আমাকে পাগলদের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। আমাকে ১১ বছর জেলে রাখার পরও তারা আমাকে আদালতে হাজির করেনি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে ভারতে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে— 'এত বড় ডাকাত মুক্তি পেয়েছে,’ ‘বড় অন্যায় হয়েছে’।
কিন্তু কেবল আপনাদের ভালোবাসা, আপনাদের আশীর্বাদ এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমি আজ এখানে এসেছি।