প্রতিদিন নদী সাঁতরে স্কুলে; ভাইরাল টিউব মাস্টার আব্দু্ল মালিক
Viral tube master: নদীতে ফেলা আবর্জনা, বর্ষার উত্তাল স্রোত, এমনকি, নদীর তলদেশে আকস্মিকভাবে বালি কমে গেলেও, মালিক মাস্টারকে কোনো বাধাই দমিয়ে রাখতে পারে না।
৪২ বছর বয়সি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মালিক গত ২০ বছর ধরে প্রতিদিন একটি নদী সাঁতরে পার করে স্কুলে পৌঁছন। কেরলের মালাপ্পুরম জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলে পৌঁছতে তাঁকে কাদালুন্দি নদী সাঁতরে পার হতে হয়।
আব্দুল মালিক, মালাপ্পুরম জেলার ‘মুসলিম লোয়ার প্রাইমারি’ স্কুলে গণিতের শিক্ষক। চার সন্তানের পিতা এই শিক্ষক, গত দুই দশক ধরে এভাবেই নদী সাঁতরে পার করে স্কুলে যান। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে তাঁর জামাকাপড়, লাঞ্চ-বক্স ও কয়েকটি বই ভরে নিয়ে যান। একটি ফোলানো টায়ারের টিউবের সাহায্যে, নদী সাঁতরে পার হন। এই টিউবটি তাঁকে, তাঁর জিনিসপত্র নিরাপদে জলের উপরে ধরে রেখে ভাসতে সাহায্য করে। নদীর তীরে এসে দ্রুত তিনি তাঁর পোশাক পাল্টে ফেলেন। এবং তারপর, ১০ মিনিটের চড়াই পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে পৌঁছন।
ছেলেবেলাতেই তিনি তাঁর বাবাকে হারান। বাবার অবর্তমানে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন তাঁর কাকা, যিনি ছিলেন ইমাম। কাকার পরামর্শেই আব্দুল শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ১৯৯৪ সাল থেকে আব্দুল মালিক শিক্ষকতা করছেন। গোড়ার দিকে, বারবার বাস পরিবর্তন করে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথ যেতে, তিন ঘণ্টা লেগে যেত তাঁর স্কুলে পৌঁছতে। এক কিলোমিটার হাঁটার পর, বাসের জন্য অপেক্ষা করা তারপর বাস পরিবর্তন করা এবং আবার হাঁটা, এভাবেই তিন ঘণ্টা কেটে যেত। কখনও একটু দেরি হওয়ার ফলে, একটি বাস ধরতে না পারলে, পরের বাস পেতে আরও আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এ বিষয়ে আব্দুল মালিক বলেন, "এরপর একদিন ভাবলাম, বাসে যাতায়াত করে এত সময় নষ্ট করা কেন? নদীর ওপারে আমার একটা খামার আছে। যখনই খামার থেকে কিছু আনতে আসি, আমি সাঁতরে নদী পার হই”। তাই এত ধকল সহ্য করার পরিবর্তে, কাদালুন্দি নদী সাঁতরে পার করে স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এই শিক্ষক। এভাবে পৌঁছতে তাঁর ১৫-৩০ মিনিট সময় লাগে। তিনি সারাবছর গ্রীষ্ম, শীত তো বটেই প্রবল বর্ষাতেও নদীর স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটেই যাতায়াত করেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন; তাঁর ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে এসেছে।
আরও পড়ুন - গলে পড়ছে আস্ত সেতু! বিচিত্র এই সব সেতুতে যেতে পাঁ কাপে চরম সাহসীদেরও
মালাপ্পুরম জেলার পাদাঞ্জাত্তুমুরি অঞ্চলের এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আঁকাবাঁকা কাদালুন্দি নদী দ্বারা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই স্থলপথে স্কুলে পৌঁছতে গেলে ১২ কিলোমিটার সড়কপথ পেরোতে হয়। কিন্তু, নদীর ওপারেই স্কুলটি দেখা যায়, তাই বিকল্প নদীপথ হলে দূরত্ব কমে দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ কিমি। এই বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকারে মালিক বলেন— তাঁর প্রতিদিনের সাঁতারে প্রায় ১৫-৩০ মিনিট সময় লাগে। তিনি এভাবেই মালাপ্পুরমের ‘মুসলিম লোয়ার প্রাইমারি’ স্কুলে সঠিক সময়ে পৌঁছন, গত ২০ বছরে তিনি একদিনও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকেননি। শিক্ষার্থীরা তাঁকে আদর করে “টিউব মাস্টার” বলে ডাকে। ছাত্রছাত্রীরাই তাঁর শক্তি।

কোনো বাধাই আব্দুল মালিকের শিক্ষাদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না
নদীতে ফেলা আবর্জনা, বর্ষার উত্তাল স্রোত, এমনকি, নদীর তলদেশে আকস্মিকভাবে বালি কমে গেলেও, মালিক মাস্টারকে কোনো বাধাই দমিয়ে রাখতে পারে না। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো পরিবেশের উপর দূষণের প্রভাব। এখন তাঁর স্কুলে, শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে কাদালুন্দি নদীতে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সাঁতারও শেখানো হয়।
আব্দুল মালিক, উত্তর কেরলের রক্ষণশীল সমাজে প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকেও সারা দেশের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। তবে এই ঘটনা যতটা অনুপ্রেরণা দেয়, ঠিক ততটাই হতাশাজনকও বটে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও একজন শিক্ষককে স্কুলে যাওয়ার জন্য, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে হচ্ছ— এটি গ্রামীণ ভারতের পরিকাঠামোগত ব্যর্থতা দেখায়। এখানে শিক্ষকের নিষ্ঠাকে সবাই সম্মান জানাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতা আড়াল করার জায়গা নেই। কেরলের 'মুসলিম লোয়ার প্রাইমারি স্কুলে'র ‘মালিক মাস্টার’ এভাবেই হয়ে উঠেছেন একটি উজ্জ্বল উদাহরণ যে, কীভাবে অধ্যবসায়, সহানুভূতি এবং কর্তব্যবোধ শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয় বরং সমগ্র সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে। তাঁর প্রতিদিনের নদী সাঁতরে স্কুলে যাওয়া, সমাজকে বুঝিয়ে দেয় যে, একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, নানা প্রতিকূলতার মুখেও প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষকরা নিঃস্বার্থভাবে আত্মত্যাগ করতে পারেন।

Whatsapp
