তারেক রহমানের নেতৃত্বেই নির্বাচনী সংগ্রামে যাবে বিএনপি: এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান
Bangladesh AKM Wahiduzzaman Interview: ডিকোড বাংলাদেশের অংশ হিসাবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলছে ইনস্ক্রিপ্ট৷ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছেন...
অর্ক: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরে সাড়ে ৬ মাস কেটে গিয়েছে। অভ্যুত্থানের সময় জনতার যে ঐক্য আমরা দেখেছি, এখন তা নেই। বরং ক্রেডিট নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াইয়ের মূল পক্ষ দু'টি— গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি এবং ইসলামি ছাত্র শিবির। এই কোন্দল নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী? গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকাই বা কী ছিল?
ওয়াহিদুজ্জামান: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দলীয়ভাবে কার ভূমিকা কতটুকু সেটা মূল্যায়ন করার খুব বেশি প্রয়োজন আছে কি? এটা ছিল ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। বিএনপি সহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল এখানে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ না করেই অংশগ্রহণ করেছে। এই কারণে বিএনপি কখনওই এই আন্দোলনে তার নিজের শেয়ার কতটুকু তা নিয়ে রাজনীতি করতে চায়নি। যদি আপনি সত্যিই জানতে চান কার অবদান কতটুকু, তাহলে শহিদ এবং আহতদের তালিকায় দেখুন কাদের কতজন রয়েছেন। বিএনপি-র পক্ষ থেকে তার অঙ্গ সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলির মধ্যে যারা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের তালিকা করা হয়েছে। সংখ্যাটি ৪২২। আপনি এবার ছাত্রশক্তি কিংবা ছাত্র শিবিরকে তাদের শহিদের সংখ্যা জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
ছাত্রশক্তি অবশ্যই কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে এই আন্দোলনের শুরু করেছিল। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে জুলাইয়ের ১৬ তারিখের পর থেকে এই আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন আপামর জনসাধারণ। আমরা অতীতে দেখেছি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তুলনামূলক কম অবদান রাখা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কীভাবে শুধুমাত্র সেই সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বস্থানে থাকার কারণে পুরো মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব একা দাবি করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খাটো করেছে। '২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান নিয়েও এমন নোংরা রাজনীতি হোক, তা আমরা চাই না। কিন্তু তারপরেও এই নোংরামি থেমে থাকছে না। এই আন্দোলনে প্রথম সারির শহিদদের একজন ওয়াসিম আকরামকে শুধুমাত্র তাঁর বিএনপি পরিচয়ের কারণে এতদিন অবহেলা করা হয়েছে। অথচ ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের এক নেতা সম্প্রতি ওয়াসিম আকরামের বাবার সঙ্গে ছবি তুলে ঘোষণা করেছেন, ওয়াসিম আকরামের বাবা জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য হচ্ছেন। ওয়াসিম আকরামের বাবা সংবাদ সম্মেলন করে সেটা আবার অস্বীকারও করেছেন। অন্যের কৃতিত্ব দখল করতে গিয়ে এরা পুরো গণঅভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করছে।
আরও পড়ুন-একাত্তর আঁকড়েই এগোবে চব্বিশ: নাহিদ ইসলাম
অর্ক: গত ১৬ বছরে বিএনপি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রচুর আন্দোলন করেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের কথা তো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেখ হাসিনার সরকার যাবতীয় পরিবহণ বন্ধ করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু এ-কথা তো সত্য যে আপনারা সফল হতে পারেননি। এত বড় দল হয়েও হাসিনাকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কাজটা ছাত্ররা করেছেন। আগামীর বাংলাদেশে বিএনপি কি এই জায়গাতেই অনেকটা পিছিয়ে পড়বে না?
ওয়াহিদুজ্জামান: সাফল্য নির্ভর করছে আপনি এটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন তার উপরে। একটা মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সব সময়ই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। বিএনপির প্রতিটি আন্দোলন শেখ হাসিনা সরকারের ভিতকে দুর্বল করেছে। বিএনপির কোনও আন্দোলনই সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থান ছিল না। বিএনপি বরাবরই চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে চাপের মধ্যে রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করতে।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ ওই একদিনের জন্যই ছিল। সমাবেশ শেষে সবাই আবার বাড়ি ফিরে যেতেন। এটা ছিল একটা শোডাউন। সরকারকে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন দেখানো। ওই দিন তো সরকার পতনের কোনও ডেডলাইন ছিল না। একটু পুরনো পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখুন এমন কোনও ঘোষণা বিএনপি করেনি। তাহলে বিএনপি কীভাবে ব্যর্থ হলো? বিএনপি-র এই বিশাল জনসমর্থন এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটারের ব্যাপক অনুপস্থিতি কি একই সূত্রে গাঁথা নয়?
কাজেই, বিএনপি পারেনি ছাত্ররা পেরেছে— এটা একটা ভুল বয়ান। আগেই বলেছি ছাত্ররা শুরু করেছিল ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’, তারপর ‘বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন’। কিন্তু সেটাকে শেখ হাসিনা পতনের গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর কৃতিত্ব শুধুমাত্র ছাত্রদের নয়। সেই আন্দোলনে ময়দানে থেকে অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন বাম ও ইসলামিক দলগুলি। এই দলগুলির অংশগ্রহণ ছাড়া এই আন্দোলন কখনও সফল হতো? ফেসবুকে ভিডিও পাবেন, ছাত্রশক্তির নেতারা আন্দোলনের দিকনির্দেশনের জন্য বিএনপির ছাত্র সংগঠনের সভাপতির পরামর্শ নিচ্ছেন এবং বিএনপির ছাত্র সংগঠনের দেওয়া সময়সূচি অনুযায়ী তাঁরা নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। অন্য রাজনৈতিক দল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং সর্বোপরি দেশের সাধারণ জনগণের অবদানকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্রশক্তির একক কৃতিত্ব দাবির কারণেই ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে রাজনৈতিক দল তৈরি করা হয়েছে সেটির হাইপ মাঠ পর্যায়ে পাবেন না, শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে পাবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো ইতিমধ্যেই বিরক্ত। নিরপেক্ষ জরিপেও উঠে আসছে যে ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে।
বিএনপি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে বিশ্বাসী। জনপ্রিয়তায় বিএনপি এগিয়ে গিয়েছে না পিছিয়ে পড়েছে সেটার প্রমাণ পাওয়া যাবে আগামী নির্বাচনে। যারা শেখ হাসিনার মতো নির্বাচন নিয়ে ভীত, তারাই বিভিন্ন অজুহাতে ভুলভাল বয়ান দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তার হাইপ তুলছে আর বারবার নির্বাচন পিছিয়ে নিজেদের দল গোছানোর চেষ্টা করছে।
আরও পড়ুন-ভারত-পাকিস্তান উভয়ের অধীনতাই অস্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ : মাহফুজ আলম
অর্ক: বাংলাদেশের বিরাট অংশের ভোটার ৩৫ বছরের কম বয়সি। এদের প্রায় কেউই গত দেড় দশকে ভোট দিতে পারেননি। এবারই তাঁরা প্রথম ভোট দেবেন। বিএনপি এই যুব/তরুণ ভোটারদের সমর্থন পাবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের আবেদন এই অংশের মধ্যে অনেক বেশি। বিএনপি কি আদৌ জেন-জির ভাষা রপ্ত করছে?
ওয়াহিদুজ্জামান: সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ৩৫ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে বিএনপির জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। এর পরের অবস্থান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির। তৃতীয় অবস্থানে আছে আওয়ামী লীগ এবং চতুর্থ অবস্থানে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল। বিএনপি সুনির্দিষ্টভাবে কোনও এজ গ্রুপের জন্য ভাষা নির্ধারণ করে না। বিএনপির ভাষা সার্বজনীন। এই স্ট্র্যাটেজি দিয়েই বিএনপি জেন-জি জনতার মনও জয় করেছে। বিএনপি একটা জিনিস ভালোই বোঝে— জেন-জি’রা যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং অতি সহজেই ভাঁওতা ধরে ফেলতে পারে।
অর্ক: শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই বিএনপির বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। কুয়েটে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠল। তারেক রহমান বার্তা দিচ্ছেন, বহুজনকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে আদৌ কোনও কাজ হচ্ছে?
ওয়াহিদুজ্জামান: মূল সমস্যা হচ্ছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ। নিয়মিতভাবে ডাকাতি হচ্ছে, ছিনতাই হচ্ছে, নারীরা রাস্তায় বের হতে পারছেন না, তাঁদের হেনস্থা করা হচ্ছে। এগুলির চেয়ে অনেক ছোট সমস্যা হচ্ছে ‘চাঁদাবাজি’। এই চাঁদাবাজি নিয়ে যত খবর হচ্ছে তার অনেকগুলিই আবার বিভ্রান্তিকর। যেমন বাজার-হাট, বাসস্ট্যান্ড-ঘাট, সেতু এগুলো প্রতিবছর সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়। আপনাদের পশ্চিমবঙ্গে কি এ ধরনের ইজারা পদ্ধতি নেই? এগুলিকে কি আপনারা চাঁদাবাজি বলেন? যাই হোক, আপনি যে সকল ঘটনার কথা বললেন, তার প্রত্যেকটিতে জড়িত বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপি যদি এখন সরকারে থাকত এবং বহিষ্কার হওয়া এই সকল নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় না আনত, তাহলে এখানে বিএনপির ব্যর্থতা নিয়ে আপনি প্রশ্ন করতে পারতেন। সরকারের বাইরে থাকা বিএনপি আর কী করতে পারে? বিএনপি যাকে দলীয়ভাবে বহিষ্কার করেছে, তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে ইউনূস সরকারের অসুবিধা কোথায়? তাহলে এটা স্পষ্ট যে সরকারের ব্যর্থতার কারণে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অথবা সরকার কোনও অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে।
অর্ক: ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলো। এই দলের সম্ভাবনা কতটা দেখেন? নাহিদ ইসলামের একটি কথা নিশ্চয় আপনি খেয়াল করেছেন, 'বাংলাদেশে আর ভারত বা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না'। এই মন্তব্য বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ওয়াহিদুজ্জামান: ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটি যদি সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যবহার না করে নিজেদের শক্তি দিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে ইনক্লুসিভ রাজনীতি শুরু করতে পারত, তাহলে তাদের ভালো করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এরা প্রথমেই এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে বাইরে রাখার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া ছাত্র সমন্বয়কদের অনেকেই ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন যা নিয়ে টুকটাক খবর হওয়া শুরু হয়েছে। মানুষ নিশ্চয়ই এগুলি খুব একটা পছন্দ করবে না, তাই না?
দেরিতে হলেও নাহিদরা বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন— এর জন্য তাঁদের ধন্যবাদ দিতে হয়। আওয়ামী লীগ আমলের ১৬ বছরে আমরা দেখেছি দেশের বিভিন্ন ইভেন্টে দেশি শিল্পীদের অবহেলা করে ভারত থেকে শিল্পী আমদানি করতে। শেখ হাসিনা বিদায়ের পর ছাত্র সমন্বয়করা পরপর কয়েকটি অনুষ্ঠানে একের পর এক পাকিস্তান থেকে শিল্পী আমদানি করায় আমরা একটু হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। যে কারণে গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ (Bangladesh First) কনসার্ট আয়োজন করি। এটা তো অবশ্যই মানতে হবে যে বাংলাদেশে বসে ভারত বা পাকিস্তানের রাজনীতি করা একটা বেমানান বিষয়।
আরও পড়ুন-রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে ধুঁকছে ইউনূস সরকার : আলতাফ পারভেজ
অর্ক: ৫ অগাস্টের পর থেকে বিএনপি দৃঢ়ভাবে একাত্তরের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামি বা সার্বিকভাবে ইসলামপন্থীদের যে অংশ একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁরা বিএনপিকে 'শাহবাগী' বলে অভিযুক্ত করছেন, 'নব্য আওয়ামী লীগ' বলছেন। অনেকে আপনাদের ভারতপন্থী বলছেন। আপনার অভিমত কী?
ওয়াহিদুজ্জামান: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক এবং শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। বিএনপিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বিএনপি অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি দল। কিন্তু এই প্রত্যেকটা কথার মধ্যেই বাংলাদেশ রয়েছে। বিএনপি নামের শুরুটাও বাংলাদেশ দিয়ে। বাংলাদেশের জনগণের সামনে বিএনপি যে জাতীয়তাবাদ হাজির করেছে সেটিও ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। মুক্তিযুদ্ধে যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে, পরাজিতের ক্ষোভ তো তাদের ভেতরে থাকবেই। সেই ক্ষোভ থেকেই তারা এসব উল্টোপাল্টা ট্যাগ দিয়ে থাকে। পাকিস্তানপন্থী ওই রাজনৈতিক দলটি এখন যেমন বিএনপিকে ‘ভারতপন্থী’ দাবি করছে, ভারতপন্থী আওয়ামী লীগও ঠিক একইভাবে বিএনপিকে ‘পাকিস্তানপন্থী’ দাবি করে বেগম খালেদা জিয়াকে পাকিস্তান চলে যেতে বলত। সুতরাং এখানে বাংলাদেশপন্থা বের করা খুব সহজ। যদি দেখেন কোনও রাজনৈতিক দলকে আওয়ামী লীগ ‘পাকিস্তানপন্থী’ দাবি করছে আর জামায়াতে ইসলামী ‘ভারতপন্থী’ দাবি করছে, তাহলে বুঝে নেবেন ওই দলটি আসলে বাংলাদেশপন্থী।
অর্ক: ইদানিং আপনারা প্রবল জামাত বিরোধী, অথচ এত বছর জামাতের সঙ্গে জোটে ছিলেন, সরকার চালিয়েছেন, তারা তো তখনও স্বাধীনতা বিরোধী ছিল। বিষয়টি দ্বিচারিতা হচ্ছে না?
ওয়াহিদুজ্জামান: জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে কিন্তু আওয়ামি লীগেরও জোট ছিল। বিএনপির সঙ্গেও জামায়াতের ছিল নির্বাচনী জোট। নির্বাচনী রাজনীতিতে জয়লাভের জন্য এই ধরনের জোট আপনাদের দেশেও আছে। এই জোট করার মানেই কিন্তু এই না যে জোটের একদলকে অন্য দলের মতাদর্শের অনুসারী হতে হবে বা অন্য দলের মতাদর্শের ভুলভ্রান্তির দায় নিতে হবে। বরং এটা ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, নারী নেতৃত্ব মেনে নিয়েই জামায়াতে ইসলামিকে বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, জোটে থাকা অবস্থায় জামাতে ইসলামির নেতাদের শহিদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে হয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন-অতীতের ভুল শুধরেই বামপন্থার বিকাশ হবে বাংলাদেশে : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
অর্ক: এই অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের সাড়ে ৬ মাসের মূল্যায়ন কী? আদৌ সরকার সফল? আমলারা সহযোগিতা করছেন না বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, অভ্যুত্থানে আহত, নিহতরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না অধিকাংশ। দেশে মাজার ভাঙা হচ্ছে, সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তৌহিদি জনতার নামে মব তৈরি করা হচ্ছে, জামিল আহমেদ পদত্যাগ করলেন, অভিযোগ করলেন 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না— এগুলি নিয়ে কী বলবেন?
ওয়াহিদুজ্জামান: দেখুন, আপনার প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু উত্তর রয়েছে। দেশের জনগণ অনেক আশা ভরসা নিয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই সরকার কোনও কাজই ঠিক মতো করতে পারছে না অথবা করার চেষ্টা করছে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত ছয় মাসে ওঁরা শুধু পছন্দের লোকদের বিভিন্ন পদ-পদবি দিয়ে সরকারের বিভিন্ন জায়গায় বসানোর কাজে মগ্ন থেকেছেন এবং এখনও সেই কাজটি করে যাচ্ছেন। ফলে একটি মাথাভারী প্রশাসন তৈরি হয়েছে যারা কোনও কাজই করছে না, বরং মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছে তাদের পদে পদে বাধা দিচ্ছে। বিএনপি আরও দুই বছর আগে সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। এই সরকার যদি সংস্কারের বিষয়ে প্রকৃতই আন্তরিক হতো, তাহলে কিছু সংস্কার কর্মকাণ্ড আপনার চোখে পড়ত। সত্যি করে বলুন তো, পড়েছে কি?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাচ্ছেতাই অবস্থা। তৌহিদি জনতার মবকে ঠেকানোর চেষ্টা করার কারণে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরোক্ষভাবে সরকার নিজেই তো এই সকল আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাই না? জনগণের কাছে একটি বিশাল সমস্যা এখন দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। সরকার কি এখানে কিছু করতে পারছে? বাজারে ভোজ্য তেল নেই। অথচ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের মজুদ ধরে রেখেছে। সেই পুরাতন সিন্ডিকেট। যারা আওয়ামী লীগ আমলেও সক্রিয় ছিল। নারীদের উপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ হচ্ছে। বিষয়গুলো হতাশাজনক।
অর্ক: ধানমন্ডি ৩২ ভাঙা রুখতে কোনও ব্যবস্থা নিল না সরকার। আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
ওয়াহিদুজ্জামান: দেখুন, বিচারহীনতার সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে মব জাস্টিস। এটা দুঃখজনক, কিন্তু বাস্তব। আজ যদি আমি আপনাকে হত্যা করি এবং কিছুদিন পর পর অডিও বার্তা দিয়ে সেই হত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে থাকি, তারপরও দেশের আদালত যদি আমার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আপনার সমর্থকরা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিলে এর জন্য দায়ী হবেন বিচারহীনতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল আরও অনেক আগেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করে তাঁকে বিচারের আওতায় আনার জন্য ভারত সরকারকে বন্দি প্রত্যাবর্তনের চাপ দেওয়া। নিদেনপক্ষে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করে শেখ হাসিনা যেন এভাবে উস্কানিমূলক বক্তব্য না দেয় সেটির ব্যবস্থা করা।
অর্ক: শোনা যাচ্ছে, ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন হবে। আপনারা আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি চাইছে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, গণপরিষদ নির্বাচন। আপনাদের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণ ঠিক কী, যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
ওয়াহিদুজ্জামান: কোনও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস বলে, সবচেয়ে বেশি নির্বাচনকালীন সহিংসতা হয়ে থাকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে এই কারণেই বিএনপি চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এত বড় একটা ঝামেলায় না জড়াক।
আরও পড়ুন-ক্ষমতায় থাকতে আসিনি, দায়িত্বপালন করে চলে যাব : শফিকুল আলম
অর্ক: ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল কি কিংস পার্টি?
ওয়াহিদুজ্জামান: যখন একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের দিন জেলা প্রশাসকরা চিঠি দিয়ে বাস রিকুইজিশন করে সেখানে ভাড়াটে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, তখন তো তার বিরুদ্ধে কিংস পার্টি হওয়ার অভিযোগ উঠতেই পারে।
অর্ক: বিএনপি বলছে নির্বাচনে তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও জাতীয় সরকার গঠন করবে। এই বিষয়টা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
ওয়াহিদুজ্জামান: এই বিষয়টি আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় অনেকবার ওঁর বক্তব্যে পরিষ্কার করেছেন। তারপরেও আমি ওঁর বক্তব্য থেকেই সরাসরি বলছি: দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেখ হাসিনা সরকার যেভাবে ভঙ্গুর করে রেখে গিয়েছে, যেভাবে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে, যথেচ্ছভাবে বিদেশে টাকা পাচার করা হয়েছে, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যেভাবে নষ্ট করা হয়েছে, সেটিকে আবারও সঠিক পথে আনার জন্য অন্ততপক্ষে একটি মেয়াদে সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার থাকা প্রয়োজন। এই জাতীয় সরকারের মাধ্যমেই বড় রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারগুলি সংসদ থেকে পাশ হওয়া প্রয়োজন। তাহলে এখানে জনগণের সর্বাধিক অংশীদারিত্ব থাকবে এবং ভবিষ্যতে সেগুলো নিয়ে কোনও ধরনের বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না।
অর্ক: তারেক রহমান দেশে আসছেন না কেন? কী সমস্যা? তিনি কবে দেশে আসবেন? তিনি আদৌ বিএনপির নির্বাচনী সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবেন?
ওয়াহিদুজ্জামান: হত্যার ঝুঁকিতে থাকা জনাব তারেক রহমানের দেশে ফেরার অনুকূল নিরাপদ পরিস্থিতি কি ইউনূস সরকার তৈরি করতে পেরেছে? দেশের রাস্তাঘাটে সাধারণ ব্যবসায়ীরাই তো নিরাপদ নন। কে কখন এসে কাকে গুলি করে মেরে ফেলছে তার কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের থানায় আটক করার পর ছাত্র সমন্বয়করা তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে! এমতাবস্থায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশে ফিরুন, এটা তো আমরা নিজেরাও চাই না। অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে তারেক রহমান সাহেব অবশ্যই দেশে ফিরবেন এবং তিনি আগামী নির্বাচনে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন।
অর্ক: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিপুল অবনতি হয়েছে। বিএনপি সরকারে এলে কি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হবে?
ওয়াহিদুজ্জামান: দেখুন, পাশাপাশি দুইটি দেশের রাজনীতিবিদরা চাইলে তাঁদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে পারেন, চাইলে তাঁদের পতাকা পরিবর্তন করতে পারেন, রাষ্ট্র ধর্ম পরিবর্তন করতে পারেন, রাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন করতে পারেন, এমনকী রাষ্ট্রের নামও পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু চাইলেও তাঁরা তাঁদের প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারেন না। এই বিষয়টি মাথায় রেখে যদি দুইটি প্রতিবেশী দেশের মানুষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন, তাহলে অবশ্যই একটি সম্মানজনক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব। বিএনপি-র পররাষ্ট্র বিষয়ক রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত এবং মায়ানমার উভয়ের সঙ্গেই মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে। সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদী, বাণিজ্য ও অসমতা সহ আরও যে সকল সমস্যা রয়েছে সেগুলি বারবার আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যেক পক্ষেই কিছুটা ছাড় দিয়ে একটা সম্মানজনক সমঝোতায় উপনীত হতে হবে— এই আশা তো আমরা করতেই পারি। আবার এটাও সত্য যে, সেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটি ‘স্বামী-স্ত্রীর’ সম্পর্ক হওয়া ঠিক হবে না। যেমনটি আওয়ামী লীগ দাবি করত।