কেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের হলবার্গ পুরস্কার প্রাপ্তি এত গুরুত্বপূর্ণ?

Gayatri Chakravorty Spivak Holberg Prize: নরওয়ের সরকারি হলবার্গ পুরস্কারের নামকরণ হয়েছে নরওয়ের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ লুডভিগ হলবার্গের নামানুসারে। হলবার্গ পুরস্কারকে বলা হয় 'সামাজিক বিজ্ঞানের নোবেল'।

সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে তত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ক অসীম জ্ঞানের জন্য, অপরিসীম মেধার জন্য। পুরস্কার সামান্য, তবু সেই পুরস্কার জীবনের দীর্ঘ মেধাচর্চার, চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রকে এমন এক স্বীকৃতি দিয়ে যায়, যাকে অস্বীকার করা যায় না। আর সেই সম্মান যদি হয় নরওয়ের হলবার্গ পুরস্কার, তাহলে এমন সম্মান প্রাপককে নতমস্তকে কুর্নিশ করতে চায় সমগ্র বিশ্বই। প্রখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত, অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এই বছর নরওয়ের হলবার্গ পুরস্কার অর্জন করেছেন। আর্টস ও হিউম্যানিটিজ বিষয়ক ‘নোবেল’ বলে পরিচিত এই পুরস্কার আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রীর দীর্ঘ কর্মজীবনের অসংখ্য স্বীকৃতি ও সম্মানের মুকুটে অন্যতম পালক জুড়ে দিল। মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন বা ধর্মতত্ত্বের কোনও অসামান্য গবেষককেই এই বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

হলবার্গ পুরস্কার আর পাঁচটা পুরস্কারের মতো নয়। নরওয়ের এই সরকারি পুরস্কারের নামকরণ হয়েছে নরওয়ের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ লুডভিগ হলবার্গের নামানুসারে। হলবার্গ পুরস্কারকে বলা হয় 'সামাজিক বিজ্ঞানের নোবেল'। এ যাবৎ যে সব কৃতীরা হলবার্গ পুরস্কার অর্জন করেছেন, সেই তালিকাও বেশ চমকপ্রদ। হলবার্গ পুরস্কার জয়ীদের মধ্যে আছেন জুলিয়া ক্রিস্টেভা, জার্গেন হ্যাবারমাস, নাটালি জামন ডেভিস, ফ্রেডরিক জেমসন, স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট, পল গিলরয়, স্যমুয়েল আইজেনস্ট্যাড, মেরিনা ওয়ার্নার, ব্রুনি লাটোর সহ প্রখ্যাত সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা। এই তারকাখচিত তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মানববিষয়ক নানা ক্ষেত্রেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের অগাধ, অসম্ভব পাণ্ডিত্য। যে জ্ঞানসাগরের কাছে আজীবন নত হয়ে শিখে যেতে হয়। অমর্ত্য সেন বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল জয়ের মতোই, এ এক চূড়ান্ত গর্বের বিশাল মুহূর্ত।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ২০০৭ সাল থেকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সমাজের ইনস্টিটিউটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গায়ত্রী স্পিভাক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ, "সাবল্টার্নরা কি কথা বলতে পারে?” (১৯৮৮) দিয়ে সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির কণ্ঠস্বরের প্রতি বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে দাঁড় করিয়েছিলেন এক প্রকাণ্ড প্রশ্নচিহ্নের সামনে। জোর গলায় বলেছিলেন, সাহিত্য যদি সাবঅল্টার্ন কণ্ঠগুলিকে তুলে না ধরে তাহলে তা অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সর্বজনীন হতে পারে না। বিশেষ করে সাবঅল্টার্ন মহিলাদের কথা বারেবারে তুলে ধরেছেন তিনি।

১৯৪৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্ম গায়ত্রীর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা তাঁর। বছরের পর বছর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মহাশ্বেতা দেবীর মতো শিক্ষাবিদ এবং লেখকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। মহাশ্বেতা দেবীর ছোট গল্প, 'দ্রৌপদী' অনুবাদ করেছিলেন গায়ত্রী। অনুবাদের সূচনাতেই বলেছিলেন, "আমি এই বাংলা ছোট গল্পটিকে এর খলনায়ক সেনানায়কের জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি, এবং এর শিরোনাম চরিত্র, দ্রৌপদীর (বা দোপদী) জন্যও করেছি, কারণ সেনানায়কের মধ্যে আমি তৃতীয় বিশ্বের সন্ধানে প্রথম বিশ্বের পণ্ডিতের সবচেয়ে বেশি মিল পেয়েছি, আমি প্রথমেই তার কথা বলব।"

গায়ত্রী স্পিভাকের কছে অনুবাদ এক গভীর রাজনৈতিক এবং দার্শনিক কাজ কারণ এটি জ্ঞানকে গণতান্ত্রিক করে তোলে। ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার অফ গ্রাম্যাটোলজিও অনুবাদ করেছেন তিনি। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নয়টি বই লিখেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী বইটি অবশ্যই A Critique of Postcolonial Reason: Towards a History of the Vanishing Present (১৯৯৯)।

গত ৪০ বছর ধরে তথাকথিত 'অস্পৃশ্য' এবং ভারতের দরিদ্রতম অঞ্চলের উপজাতিদের মধ্যে স্ব-ভর্তুকিপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে চলেছেন গায়ত্রী। বিভিন্ন দেশের প্রান্তিক গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলিতে গণতান্ত্রিক শিক্ষার অনুপস্থিতির সমস্যা মোকাবিলার এই প্রচেষ্টাকে কোনও ভাষাতেই ব্যাখ্যাতীত। বর্তমান সময়ে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজন গায়ত্রী। তুলনামূলক সাহিত্য, অনুবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিক চর্চা, রাজনৈতিক দর্শন এবং নারীবাদী তত্ত্বে তার যুগান্তকারী গবেষণার জন্যই এই হলবার্গ পুরস্কার পেলেন তিনি। তাঁর এই অর্জন, এই টলমলে সময়ে একজন চিন্তক, একজন নারীবাদী, একজন পণ্ডিত মানুষের জয়কে বিভক্ত চিন্তার দেওয়ালে খোদাই করে দিয়ে গেল। খোদাই করে দিয়ে গেল সেই সমস্ত 'সাবঅল্টার্ন'-দের নামও, যাদের প্রান্তিক করে রাখাতেই লাভ দেখে সমাজ!

More Articles