অনুপর্ণাকে নিয়ে কেন চুপ মেইনস্ট্রিম মিডিয়া?
Film Director Anuparna Roy: তিনি শহরের মুখ নন, প্রান্তিক পুরুলিয়ার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। কলকাতাকেন্দ্রিক খবরের ভিড়ে বরাবরই চাপা পড়ে যায় অনুপর্ণাদের কথা।
বিশ্বমঞ্চে ইতিহাস গড়েছেন পুরুলিয়ার মেয়ে অনুপর্ণা রায়। ৮২তম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালকের পুরস্কার এবং সাত মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছেন তাঁর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ’ (Songs of Forgotten Trees)-এর জন্য। আর তারপর থেকেই সমালোচিত হচ্ছেন তিনি। ইতালিতে ভেনিসের মঞ্চে তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে বিতর্কের ঝড় বইছে সামাজিক মাধ্যমে।
ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘অরিজন্তি’ বিভাগে প্রথম ভারতীয় হিসেবে সেরা পরিচালকের খেতাব জিতে নিজের বক্তব্য রাখার সময় অনুপর্ণা ফিলিস্তিনি শিশুদের প্রতি তাঁর সংহতি জানান। তিনি বলেন, “প্রতিটি শিশুরই শান্তি এবং স্বাধীনতা প্রাপ্য এবং প্যালেস্টাইন কোনো ব্যতিক্রম নয়। এই মুহূর্তে প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। আমার দেশ হয়তো অখুশি হবে (আমার কথায়), কিন্তু সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অনুপর্ণা রায়
মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় অনুপর্ণার এই বক্তব্য। এবং বিশ্বমঞ্চে ঘরের মেয়ের সম্মান অর্জনের প্রশংসার পরিবর্তে তাঁর বক্তব্য নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয় সমাজ মাধ্যম। নানা আক্রমণ ধেয়ে আসে অনুপর্ণার দিকে। কুরুচিকর মন্তব্য থেকে তাঁর ছবি বিকৃত করে পোস্ট, সবই চলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে আসা একজন মহিলা তাঁর বক্তব্য রাখবে তাও প্যালেস্টাইনের পক্ষে, এ তো মানা যায় না। তাই বিচারালয় খুলে বসে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর একাংশ।
আরও পড়ুন- “শ্মশানে কাজ! কেউ বিয়ে করবে না”, যেভাবে সমাজকে জবাব দিয়েছেন ‘ডোম’ টুম্পা দাস
বলি সুন্দরীদের ক্লিভেজ নিয়ে বা ‘উপস’ মোমেন্ট নিয়ে সংবাদ শিরোনাম করে মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত থাকা গোদি মিডিয়াকেও নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় অনুপর্ণার সাফল্যে। সত্যটা হলো, অনুপর্ণা যে এত বড় মঞ্চে যাচ্ছেন তেমন খবরও ‘বাজারি’ মিডিয়ার কাছে ছিল না। তাছাড়া তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের ভাষায় বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলেননি। তাঁর কথায় কোনো শিখিয়ে দেওয়া বুলি ছিল না বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়ে যেতেই এই বিশ্বমঞ্চকে ব্যবহার করেছেন অনুপর্ণা। ঠিক যেমনটা একদা করেছিলেন জঁ-লুক গদার। তাই তথাকথিত প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম অনুপর্ণার সাফল্যকে দেশের সাফল্য বলে জয়গাঁথা লিখবে না সেটা স্বাভাবিক।

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অনুপর্ণা রায়
সমাজমাধ্যমে যারা রে রে করে উঠেছে, তারা হয়তো জানেও না অনুপর্ণার ছবির বিষয়বস্তু কী? জানার আগ্রহও নেই। মিডিয়ারই তো দায়িত্ব ছিল অনুপর্ণার বিশ্বজয়ের খবর গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু গোদি মিডিয়া তা করেনি। কারণ তিনি শহরের মুখ নন, প্রান্তিক পুরুলিয়ার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। কলকাতাকেন্দ্রিক খবরের ভিড়ে বরাবরই চাপা পড়ে যায় অনুপর্ণাদের কথা। মিডিয়া সাধারণত যারা বৃত্তের কেন্দ্রে রয়েছে, আলোর কেন্দ্রে রয়েছে তাকে নিয়েই প্রচার করে।
এই যে মিডিয়ার পক্ষপাত, একচোখামি তার কেন্দ্রে পুরুষতন্ত্রেরই বীজ রয়েছে। মিডিয়ার এই নিয়মের ক্ষেত্রে বাদ যান না কারাবন্দিরাও। এক্ষেত্রে ভেবে দেখা যেতে পারে গুলফিশা ফাতিমার কথা। ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা মামলায় শার্জিল ইমাম, উমর খালিদদের পাশাপাশি তিনিও গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু গোদি মিডিয়ায় যতটা উমর-শর্জিলদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, গুলফিশাকে নিয়ে লেখা হয়নি।

গুলফিশা ফাতিমা
এমবিএ পাশ ফাতিমা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং মহিলাদের সংগঠন ‘পিঞ্জরা টোড়’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গার ষড়যন্ত্র ও উসকানির অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ইউএপিএ (UAPA) আইনে মামলা চলছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি তিহার জেলে বন্দি, যদিও মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উমরের হয়ে গলা ফাটানোর লোক যত রয়েছেন, তত লোক সমাজমাধ্যমে গুলফিশার কথা বলেন না।
আরও পড়ুন- অনুষ্কা কী পরবেন! কে ঠিক করবেন?
অনুপর্ণা পরিচালিত সিনেমায় ফুটে উঠেছে নারী স্বাধীনতার গল্পই। মেয়েদের লড়াই হলো তাঁর গল্পের মূল সুর। Songs of Forgotten Trees সিনেমায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দুই নারী ও তাঁদের অন্তরঙ্গতা নিয়ে সমাজের সঙ্গে লড়াইয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। ২০২৩ সালে ‘রান টু দ্য রিভার’ (Run to the River) তৈরি করেছিলেন ব্রিটিশ বাংলার প্রেক্ষাপটে, সেটি ছিল অনুপর্ণা পরিচালিত প্রথম শর্ট ফিল্ম। যেখানে তিনি এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বাল্যবিবাহের গল্প তুলে ধরেছিলেন। তারপর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি, আর তাতেই বিশ্বমঞ্চে স্বীকৃতি।
অনুপর্ণা পরিচালিত Songs of Forgotten Trees-এ প্রধান চরিত্রে রয়েছেন দুই নারী— কলসেন্টারের কর্মী শ্বেতা (সুমি বাঘেল) ও যৌনকর্মী থুয়া (নাজ শেখ)। কোনো আড়ম্বর নেই, মেকআপ নেই সিনেমায়। মুম্বইয়ে ভগ্নপ্রায় যে ফ্ল্যাটে অনুপর্ণা বাস করেন, সেখানেই সিনেমাটির শুটিং হয়েছে। সিনেমার গল্প অনুযায়ী, দুই নারী একই ফ্ল্যাটে একইসঙ্গে বাস করতে করতে ধীরে ধীরে এক অপরের কাছে আসেন।

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অনুপর্ণা রায়
মীরা নায়ার, জোয়া আখতার, কিরণ রাও, রীমা দাস, পায়ল কাপাডিয়ার মতো নারী পরিচালকরা অনুপর্ণা রায়ের অনুপ্রেরণা। তাঁর শৈশব কেটেছে পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ায়। নিতুড়িয়া রানিপুর কলিয়ারি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক দেওয়া, এরপর হুড়া ব্লকের নপাড়ায় মামাবাড়িতে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। বাবা ব্রহ্মানন্দ রায়ের চাকরি বদলি হওয়ায় পশ্চিম বর্ধমানের কুলটিতে চলে আসা। সেখান থেকেই ইংরেজিতে স্নাতক করার পর নয়া দিল্লিতে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়তে যান অনুপর্ণা। পরে তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাতে চাকরিও করেন। ২০২২ সালে চাকরি সূত্রে মুম্বইয়ে পাড়ি দেওয়া।

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অনুপর্ণা রায়
কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন পূরণ করতে চাকরি ছেড়ে দেন। সেদিন অনুপর্ণার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, পরিচালক-সম্পাদক পরেশ কামাদার, পরিচালক অনির্বাণ মাইতি এবং নীরজ সাহায়। অনুপর্ণার মা মনীষা রায় সংবাদমাধ্যমকে জানান, “সত্যজিৎ রায় মেয়ের অন্যতম আইকন।” বাবা যখন মেয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ করছিলেন, তখন অনুরাগ কাশ্যপের ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ সিনেমাটি দেখে ছবি বানানোর স্বপ্ন বুনছিলেন তিনি। পরে সেই অনুরাগ কাশ্যপই তাঁর Songs of Forgotten Trees উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে।
আগামীতে অনুপর্ণা পুরুলিয়া-সহ ভারতের মহিলাদের অবস্থা নিয়ে কাজ করতে চান। ২০২৫-এও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেভাবে নিয়মিত নারীদের হাজার লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়, বঞ্চিত হতে হয় নিজের অধিকার থেকে, স্বাধীন জীবন যাপন থেকে, অনুপর্ণারা তাঁদের কাছে হুমকির হবে এটা স্বাভাবিক। তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যতই নারীদের ডানা কাটতে উদ্যত হবে, অনুপর্ণার মত চরিত্ররা সামনের সারিতে উঠে এসে বলবেন, নারীরাও মানুষ, পুরুষের মতোই।

Whatsapp
