অতীতের ভুল শুধরেই বামপন্থার বিকাশ হবে বাংলাদেশে : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

Mujahidul Islam Selim Interview: বাংলাদেশের মানুষ কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় চায় না কেন? আওয়ামী লীগের বি-টিম সিপিবি? বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে বামপন্থীদের ভূমিকা কী? কথাবার্তায় বাংলাদেশের বামনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্ক ভাদুড়ির সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রাক্তন সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গণঅভ্যুত্থানে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল, সিপিবি কি আওয়ামী লীগের বি-টিম, 'নতুন বাংলাদেশে' মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা কী, এই অভ্যুত্থান কি মার্কিন মদতপুষ্ট কালার রেভোলিউশন, নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে কমিউনিস্ট পার্টি— সব প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দিয়েছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

অর্ক : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইনস্ক্রিপ্টে আপনাকে স্বাগত। আপনি তিনটি গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন— ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে ১৯৭১ সালের অভ্যুত্থান এবং এরশাদ বিরোধী ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা আপনি। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্বে ২ অগাস্টের দ্রোহযাত্রায় আপনি ছিলেন সামনের সারিতে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে সাড়ে ৬ মাস কেটে গেল। ৫ অগাস্ট পর্যন্ত যে বহুমাত্রিক ঐক্য ছিল, তা আর নেই। অভ্যুত্থানের ক্রেডিট নিয়ে তরজা শুরু হয়েছে । এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন? এই অভ্যুত্থানে বামপন্থীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে আপনার মত কী?

সেলিম : আপনাকে ধন্যবাদ, অর্ক ভাদুড়ি। অভ্যুত্থানের ক্রেডিট নিয়ে তর্কযুদ্ধ দেখে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ছে, "রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অর্ন্তযামী।" শেখ হাসিনা বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের প্রধান কুশীলব এদেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র-জনতা। এই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের বিরাট ভূমিকা ছিল। তাঁরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার এ কথাও সত্য যে, বিপুল অংশের সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী জনতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া এই অভ্যুত্থান সফল হতো না। আমি বিশেষ করে বলতে চাই, ঢাকা মহানগরের রিকশচালক এবং পোশাক শ্রমিকদের কথা। বলতে চাই চা শ্রমিকদের কথাও। অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে শহিদ হয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন। হাসিনার খুনি বাহিনীর মোকাবিলা করেছেন অসীম সাহস ও প্রত্যয় নিয়ে। অথচ অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে তাঁদের পর্যাপ্ত মূল্যায়ন হচ্ছে না।

অনেকে এই গণঅভ্যুত্থানকে দু'মাসের ঘটনা হিসাবে দেখছেন। তাঁরা ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ যেমন কেবল ৯ মাসের ঘটনা ছিল না, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানও তাই। গত দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনার ভয়াবহ স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চলেছে। সাধারণ মানুষ লড়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলি লড়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী এই সংগ্রামে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বামপন্থীরাও লাগাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। গত কয়েক বছরে মানুষের চোখে আমরা দেখেছি ঘৃণার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণা, গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে ঘৃণা, লুটপাটতন্ত্র কায়েমের বিরুদ্ধে ঘৃণা। হাসিনার প্রহসনের নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি, বামজোট সহ বিরোধী দলগুলি। আপামর জনতা পথে নেমেছে। ছাত্র ইউনিয়ন সহ বামপন্থী ছাত্ররা বারবার আহত, রক্তাক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগের গুন্ডাদের হাতে। কমিউনিস্ট পার্টির গত কংগ্রেসেও আমি বলেছি, মানুষের বুকে বারুদের বাক্স জমে আছে। যে কোনও সময় বিস্ফোরণ হবে। বিস্ফোরণ হতোই । আজ না হোক কাল । কোটা আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে। সেখান থেকে দাবানল। বামপন্থীরা আগাগোড়াই এই আন্দোলনে ছিলাম। আমরা হাসিনার '১৪ এবং '১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচন বয়কট করেছি। বারবার মার খেয়েছি। আমি নিজেও আক্রান্ত হয়েছি  বামপন্থী নন, এমন অনেক প্রগতিশীল মানুষও অভ্যুত্থানে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কথা বলব। তবে এই গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত কুশীলব বাংলাদেশের জনতা। তাঁদের ঘৃণার আগুনে হাসিনার স্বৈরাচার পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।

অর্ক : এই আন্দোলনে আমরা তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে দেখলাম। যাঁরা নিজেদের 'অরাজনৈতিক' বলতেন, তাঁরা বুকের রক্তে রাজপথ লাল করে দিলেন। আপনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রথাগত ছাত্র রাজনীতি, বা একটু বড় করে দেখলে প্রথাগত রাজনীতি কি আবেদন হারাচ্ছে? একইসঙ্গে প্রশ্ন, হাসিনার পতন কি অবশ্যম্ভাবী ছিল?

সেলিম : নিঃসন্দেহে হাসিনার পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন নতুন করে জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু এই অগ্ন্যুৎপাত যদি শেখ হাসিনাকে উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হতো, তা হলেও আজ না হোক কাল সরকারের পতন ঘটতই। কোটা আন্দোলন যে ক্লিক করল, তার মূলেও রয়েছে অর্থনীতি। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে। যুবসমাজের মধ্যে সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য হাহাকার। সেই আকুতি থেকে তারা বারবার পথে নেমেছে। আমি অরাজনৈতিক শব্দটি ব্যবহার করব না, তবে আন্দোলনের অদলীয় চরিত্রটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। একথা ঠিক যে, রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের বিরূপতা রয়েছে। ছাত্রলীগ সহ বুর্জোয়া দলগুলির ছাত্র সংগঠনের প্রতি শিক্ষার্থীদের তীব্র বিরূপ মানসিকতা আছে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির শক্তি কম। কোটা সংস্কার আন্দোলনে একটা নতুন নেতৃত্ব সামনে এল। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেল, এটা অরাজনৈতিক বা অদলীয় আন্দোলন। এর ফলে প্রচুর সাধারণ মানুষ সহজে অংশ নিতে পারলেন। এমনকী আওয়ামী লীগের সমর্থকদের অনেকেও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে প্রথাগত রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠনের প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছেন। অভ্যুত্থানের পরে আমি তো আরও বেশি করে দেখছি যে মানুষ রাজনৈতিক সরকার চাইছে। যে ছাত্ররা নিজেদের অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি বলে দাবি করছেন তাঁরাও তো একটি রাজনৈতিক দলই তৈরি করলেন। ফলে, বিষয়টির অতি সরলীকরণ করা ঠিক হবে না।

আরও পড়ুন- ভারত-পাকিস্তান উভয়ের অধীনতাই অস্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ : মাহফুজ আলম

অর্ক : অভ্যুত্থানের তুঙ্গ মুহূর্তে নেতৃত্বে কারা ছিলেন? ওই শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলিতে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল?

সেলিম : আমি আবারও বলছি এই অভ্যুত্থানের কোনও নির্দিষ্ট নেতৃত্ব ছিল না। একটা দক্ষ কেন্দ্র বা কোর অবশ্যই ছিল। অনলাইন নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা ছাত্রনেতারা খুব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। শুধু ঢাকায় নয়, সর্বত্র সমন্বয়ের কাজ খুব ভালো করে হয়েছে। কিন্তু মূল শক্তি ছিল জনগণ। ছাত্র ইউনিয়ন সহ প্রগতিশীলরাও স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে ছিল। তবে তারা সচেতনভাবেই ব্যানার ব্যবহার করেনি, যাতে দলীয় ছাপ না আসে। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আওয়ামী লীগ হামলা করল, সব হল খালি করে দিল, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নামল। তারা একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ গড়ে তুলল। এক্ষেত্রেও বামপন্থী ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এই সঙ্গে আমি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথাও বলতে চাই। উদীচীর একাংশের ভূমিকা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে 'একাংশ' শব্দটি ব্যবহার করতে হলো আমাকে। উদীচীর একাংশের উদ্যোগে ত্রিশেরও বেশি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থাকে নিয়ে কার্ফিউ ভেঙে গানের মিছিল সংগঠিত করা হয়। এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। কার্ফিউয়ের সময়ে মানুষ একটু থমকে ছিল। সরকার তখন বীভৎস দমনপীড়ন চালাচ্ছিল। তখনও সমন্বয়করা সম্ভবত শেখ হাসিনাকে উচ্ছেদ করার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। সমন্বয়কদের একাংশ বলছিলেন এটা হাসিনার পতনের আন্দোলন নয়। আটদফা না ন'দফা তাই নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, এই আন্দোলনের নেতা ছিল জনগণ। সরকারি অত্যাচারের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জনগণ বহু আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল এই আন্দোলনের অন্তিম গন্তব্য এক দফা - হাসিনার পতন।

অর্ক : প্রধানত বামপন্থীদের দ্বারা সংগঠিত দ্রোহযাত্রার ভূমিকা তো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

সেলিম : হ্যাঁ। জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাসে দ্রোহযাত্রার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বস্তুতপক্ষে, দ্রোহযাত্রাই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপথে একদফার ঘোষণা দেয়। এটা ছিল মূলত ৩৫টি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের উদ্যোগ। শিক্ষক নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সংগঠন ও অগণিত মানুষ তাতে অংশ নিয়েছিলেন। হাজার দশেক মানুষ নিয়ে মিছিল শুরু হয়। মিছিল যখন শহিদ মিনারে পৌঁছয়, তখন জনসমুদ্র। সেই লাখো জনতার জমায়েতে একদফা ঘোষিত হয়।

অর্ক : বামপন্থীদের একাংশ এই আন্দোলনে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু আরেকটি অংশ কি নিস্পৃহ ছিলেন বা আওয়ামী লীগের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছেন বলে আপনি মনে করেন?

সেলিম : এই গণঅভ্যুত্থানে বামপন্থীদের বিরাট অংশ সর্বশক্তি দিয়ে নেমেছিলেন। তাঁরা শহিদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। দ্রোহযাত্রার কথা একটু আগেই বললাম। শুধু এই অভ্যুত্থানে নয়, দেড় দশক ধরে বামপন্থীরা শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছে। তবে এটা ঠিক যে বামপন্থীদের আরও বেশি করে এই অভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। বামপন্থীদের একাংশও স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন, যারা আওয়ামী লীগের জোট ১৪ দলে ছিলেন। আমি তাঁদের আলোচনার বাইরে রাখছি। তবে আমাদের ভিতরেও কারও কারও মনে এমন ধারণা ছিল যে, আওয়ামী লীগকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না (ডোন্ট ডিস্টার্ব আওয়ামী লীগ)। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক। আয়ুব খানের আমলেও এরকম দেখেছি। চিনপন্থী কমিউনিস্টদের একাংশও তখন আয়ুব খানের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্র খুঁজে পেত। বামপন্থীদের অনেকে বলেন গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে দ্বিতীয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকর্তা ভেবে বসলেন। এই জায়গা থেকেই অনেকে ১৪ দলে ঢুকে পড়লেন। আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করলেন না। আবার যাঁরা ১৪ দলের বাইরে থাকলেন, তাঁরাও কেউ কেউ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রইলেন। এই ধরনের রাজনীতি মৌলবাদ ও অগণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করেছে। আমাদের এই বিভ্রান্তির জাল ছিঁড়ে বেরতে হবে। আমরা মৌলবাদের বিরুদ্ধেও লড়ব, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও লড়ব। কোনও আগে-পরের বিষয় নেই। দু'টি লড়াই সমান্তরাল। একে অপরের পরিপূরক।

আরও পড়ুন- একাত্তর আঁকড়েই এগোবে চব্বিশ: নাহিদ ইসলাম

অর্ক : জনমানসে এমন একটি ধারণা আছে, আপনারা আওয়ামী লীগের বি-টিম। আপনি এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

সেলিম : প্রশ্নই ওঠে না। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গত দেড় দশক আমরা লড়েছি। আমি নিজে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছি। গণঅভ্যুত্থানে আমাদের কী ভূমিকা ছিল, আমি আগেই তা বললাম। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, জনমানসে এমন একটি ধারণা আছে যে আমরা আওয়ামী লীগের বি-টিম। এই ধারণার পিছনে ইতিহাসের যেমন দায় আছে, তেমনই আমাদের একাংশের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে নরম মনোভাব, যার কথা আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, তারও দায় অনেক। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই নরম মনোভাব ধ্বংস করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এগুলি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে বিরাট বাধা। আমাদের আসন্ন পার্টি কংগ্রেসেও এই নিয়ে আলোচনা হবে।

অর্ক : আপনারা রাজপথে আন্দোলন করেন, অথচ ক্ষমতায় যেতে পারেন না, ভোট পান না। অথচ নেপালে কমিউনিস্টদের সরকার, শ্রীলঙ্কাতেও এখন কমিউনিস্ট সরকার। বাংলাদেশে সমস্যাটা কী?

সেলিম : বাংলাদেশের মানুষ বামপন্থীদের, কমিউনিস্টদের 'ভালো মানুষের দল' বলে জানেন কিন্তু আমরা যে সরকার গড়তে পারি, তা বিশ্বাস করতে চান না। মানুষ সরাসরি, স্পষ্টভাবে দেখতে চান রাজনৈতিক ক্ষমতা কার হাতে থাকবে। দুঃখজনকভাবে, আমরা, সিপিবি এই বিষয়ে কার্যকরী বিকল্প আনতে পারিনি। মানুষ জিজ্ঞাসা করেন, "আপনারা কাকে সমর্থন করবেন, আওয়ামী লীগ না বিএনপি?" আমরা নিজেরাই যে সরকার গড়তে পারি, এই প্রত্যয় আমরা জনমানসে সঞ্চারিত করতে পারিনি। আমাদের দলের প্রয়াত নেতা কমরেড জসিমউদ্দিন মণ্ডল জনগণকে একটা কথা বলতেন, "সব শালাকেই তো দেখলেন, কিন্তু নিজের শালাকে তো দেখলেন না"। আমরাই যে জনতার 'নিজের শালা', তা তো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। না হলে তো হবে না। আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় নয়া যুক্তফ্রন্টের কথা বলছি। এই নতুন যুক্তফ্রন্ট অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পাবে বলে আমি মনে করি। আমাদের রাজনৈতিক শক্তি যতটা বাড়ানো প্রয়োজন, আমরা তা পারিনি। গতানুগতিকতায় আটকে গিয়েছি। এই সমস্যাগুলি অতিক্রম করতেই হবে।

অর্ক : গতানুগতিকতা বলতে ঠিক কী বুঝব?

সেলিম : এই যে সংস্কার সংক্রান্ত বিতর্কে আমাদের ভূমিকাই দেখুন। আমাদের কী করা উচিত ছিল? একদম তরতাজা ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রতিটি সংস্কার ইস্যুতে নিজেদের কমিশন করা প্রয়োজন ছিল। তারা কাজ করত, গবেষণা করত। তার ভিত্তিতে আমরা নিজেরাই সংস্কার বিষয়ক রূপরেখা দিতাম। এর ফলে একটা বামপন্থী বিকল্পের অবয়ব তৈরি হতো। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা গতানুগতিকভাবে চলছি যেহেতু, ফলে মানুষও আমাদের সেভাবেই দেখেন। আমরা যে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারি, সেটা জনগণ বিশ্বাস করে না। আমরা স্লোগান দিই, 'ক্ষমতা না রাজপথ'— ফলে মানুষ ভাবেন ক্ষমতায় আর এদের যাওয়ার দরকার কী, এরা রাজপথেই থাকুক, আন্দোলন করুক। এর সঙ্গে রয়েছে লেজুড়বৃত্তির মানসিকতা, আপনার 'আওয়ামী লীগের বি-টিম' সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে যা বললাম। অনেক বামপন্থী মনে করেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশে মৌলবাদী ঝড় বয়ে যাবে। অথচ শেখ হাসিনার আমলেও মৌলবাদী শক্তিকে সরকার যথেষ্ট তোয়াজ করেছে। সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল— সবই হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের অনেকে মানসিক কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তবে আমরা দ্রুত এগুলি থেকে বেরিয়ে আসব। আমাদের বেরিয়ে আসতে হবেই।

অর্ক : সেলিমভাই, আওয়ামী লীগ নিঃসন্দেহে দানবিক স্বৈরাচার কায়েম করেছিল, কিন্তু ৫ অগাস্টের পর কি দেশে মৌলবাদের দাপাদাপি নেই? অনেকেই অভিযোগ করছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আক্রান্ত হচ্ছে। আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই বিষয়ে আপনার কী মত?

সেলিম : আমার অবস্থান খুব স্পষ্ট। একাত্তরকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ একটি পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। আমাদের পার্টির জনসভায় আমি বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানকে কবর দিতে হবে কিন্তু তার নামে যদি মুক্তিযুদ্ধকে কবর দেওয়ার সামান্যতম চেষ্টাও হয়, তাহলে সর্বাত্মক প্রতিরোধ হবে। আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দিইনি।

বাংলাদেশে কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে রাজনৈতিকভাবে সফল হতে পারবে না। একথা ঠিক যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকৃত ও কলুষিত করেছে। গোটা মুক্তিযুদ্ধকেই তাদের দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ কিছুটা আহত হয়েছে। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মানুষের উপর অত্যাচার করেন, ভোটের অধিকার কেড়ে নেন, তাহলে এমন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এখনও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আবেগ বিপুল। আপনি গোটা ঢাকা ঘুরে দেখুন, এই জেন-জি যে দেওয়াল লিখেছে, তার অধিকাংশেই একাত্তর এবং চব্বিশকে একসঙ্গে রেখে লেখা। একাত্তরের ধারাবাহিকতায় চব্বিশ। তবে এ-কথা ঠিক যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি আছে। তারা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে পাকিস্তানপন্থীরা—এই দুই পক্ষই চেষ্টা করছে একাত্তর এবং চব্বিশকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে। কিন্তু বাংলাদেশ মানেই একাত্তর। ফলে এই প্রচেষ্টা সাফল্য পাবে না। বাংলাদেশের মানুষ কখনও মুক্তিযুদ্ধকে ভোলেননি, ভুলতে পারবেন না। কারণ মুক্তিযুদ্ধ এই দেশের বুনিয়াদ।

অর্ক : কারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বয়ান তৈরি করছে?

সেলিম : জামায়াত ইসলামি, একাত্তরের পরাজিত শক্তি, মৌলবাদীরা। বলার চেষ্টা হচ্ছে একাত্তরে ভুল হয়েছিল, সেই ভুল শুধরে নিতে হবে। কিন্তু এগুলি ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট। বাংলাদেশ কখনও একাত্তরের থেকে একটি পা-ও পিছু হটবে না।

অর্ক : খোদ ইউনূস বলেছেন এই অভ্যুত্থান নাকি মেটিকিউলাসলি ডিজাইনড, একজন ছাত্রনেতাকে মাস্টারমাইন্ড বলা হচ্ছে, অনেকে অভিযোগ করছেন এটি আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে সংগঠিত কালার রেভোলিউশন। আপনার কী বক্তব্য?

সেলিম : এই ধরনের বিশ্লেষণের প্রবণতা আমি একাত্তর পরবর্তী সময়ে জামাতিদের মধ্যে দেখেছি। এখনও দেখি। পাকিস্তানপন্থীরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ভারতীয় প্রকল্প। ভারত তার নিজের স্বার্থে একাত্তর ঘটিয়েছে। এখন কেউ কেউ একই সুরে বলছেন চব্বিশের অভ্যুত্থান আমেরিকা ঘটিয়েছে। এই কথাগুলি যাঁরা বলেন, তাঁরা জনগণের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন। একাত্তর ঘটিয়েছিল বাংলাদেশের বীর জনগণ, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নির্মাতাও তাঁরাই। ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলি তখনও ছিল, এখনও আছে, আগামীতেও থাকবে, কিন্তু ইতিহাসের নির্মাতা জনগণ। সংগঠিত জনগণ। এই অভ্যুত্থানের কোনও মাস্টারমাইন্ড ছিল না। কোনও মেটিকিউলাস ডিজাইন মেনেও অভ্যুত্থান হয়নি। জনগণ অভ্যুত্থানের দিনগুলিতে নিজেরাই চূড়ান্ত সৃজনশীলতা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছে। নেতারা যা বলেছেন, জনগণ তার চেয়ে এক ধাপ, দু'ধাপ, পাঁচ ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। নেতারা যখন শেখ হাসিনার পতনের দাবি তোলা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, জনগণ তখনই রাজপথের মুখে দাঁড়িয়ে হাসিনার স্বৈরাচারকে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কোনও মেটিকিউলাস ডিজাইন বা মাস্টারমাইন্ডের তত্ত্ব দিয়ে জনগণের ভূমিকা আড়াল করা যাবে না। জনগণই এই অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড, তাঁরাই গুলির মুখে দাঁড়িয়ে অভ্যুত্থান 'ডিজাইন' করেছেন। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্রেডিটের জন্য যে মারামারি, তার স্বার্থে অনেকেই অনেক কথা বলবেন, তাতে সত্য বদলে যায় না।

আরও পড়ুন- ক্ষমতায় থাকতে আসিনি, দায়িত্বপালন করে চলে যাব : শফিকুল আলম

অর্ক : ছাত্রদের নতুন দল সম্পর্কে কী বলবেন?

সেলিম : কোনও গোষ্ঠী যদি নিজেদের সমগ্র ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি বলে মনে করে, তাহলে তা ঠিক নয়। কাজেই এই নতুন দল অভ্যুত্থানকারী ছাত্রদের সকল অংশের প্রতিনিধি নয়। সমন্বয়কদের ভূমিকাকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু তাঁরা যেন তাঁদের গণ্ডিটা বোঝেন। বেশ কিছু বিপজ্জনক ঝোঁক ইতোমধ্যেই চোখে পড়ছে। "যতদিন সংস্কারের কাজ শেষ হবে না, ততদিন নির্বাচন নয়" বা "শেখ হাসিনার শাস্তির আগে নির্বাচন নয়"— এমন কিছু বয়ান শোনা যাচ্ছে। এগুলি মারাত্মক। এগুলির মাধ্যমে বর্তমান সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে হয়। মনে রাখতে হবে, হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছিলেন, কারণ হাসিনা নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই হত্যা করেছিলেন। দেড় দশক ভোট দিতে না পারা মানুষকে দ্রুত ভোট দিতে দিন। নাহলে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে।

অর্ক : এই নতুন রাজনৈতিক দল কি কিংস পার্টি?

সেলিম : আসল কথাটা হলো, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট হতে হবে। নতুন দলের সঙ্গে যুক্ত কেউ সরকারে থাকলে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। জনগণের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হবে।

অর্ক : নতুন সরকারের এই কয়েক মাসের কাজকর্ম নিয়ে আপনার কী অভিমত?

সেলিম : আমি এই সরকারকে সফল বলতে পারছি না, দুঃখিত। এটি কোনও মনোলিথিক সরকার নয়। বহু পরস্পরবিরোধী শক্তি সরকারে আছে। দেশের বিরাট অংশের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে না। নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইতোমধ্যেই এই সরকারের গুলিতে মজুরির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের উপরে হামলা হয়েছে। মন্দিরে হামলা হয়েছে, একের পর এক মাজার ভাঙা হচ্ছে, অথচ সরকার কিছু করতে পারছে না। মানুষের চাহিদা খুব সামান্য। মানুষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি দেখতে চায়, দ্রব্যমূল্য যাতে না বাড়ে সেই বিষয়ে সরকারের সক্রিয়তা দেখতে চায় কিন্তু প্রত্যাশিত কাজ তো একেবারেই হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একদম শোচনীয়। 'মবের মুলুক' কায়েম হয়েছে। এই সরকার তো অভ্যুত্থানের সরকার। এই সরকার ব্যর্থ হলে আমি মর্মাহত হব। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার যত বেশি দিন থাকবে, ততই তার ব্যর্থতা বাড়বে। তাই সমাধানটাও সহজ। আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন — এমন করলে চলবে না। আগে নির্বাচন, তারপর সংস্কার। জনতা তার প্রতিনিধিদের সংসদে পাঠাবে। তাঁরা সংস্কার করবেন। তার আগে, নির্বাচনের জন্য যেটুকু সংস্কার অবশ্যকরণীয়, সরকার সেটুকু করে দ্রুত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করুক।

অর্ক : বিএনপির সঙ্গে নানা বিষয়েই আপনারা একমত হচ্ছেন। তাহলে কি বিএনপি-সিপিবি জোট হতে পারে?

সেলিম : বিএনপির সঙ্গে আমাদের মতাদর্শগত ভিন্নতা আছে। তাই এক মঞ্চে আসা যাবে কিনা আমি জানি না। তবে জামায়াত ইসলামি এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কার, রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো প্রশ্নে আমাদের দুই দলের অভিমত মিলে যাচ্ছে। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়, আমরাও তাই চাই। আমি মনে করি, বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়, কারণ তারা জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। আমরা দ্রুত নির্বাচন চাই গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে। তবে আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পরে তৃণমূল স্তরে বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আশা করব তাঁরা এই বিষয়ে আরও সক্রিয় হবেন।

অর্ক : আমরা আলোচনার শেষ দিকে চলে এসেছি। আপনার কি মনে হয় সংসদ সর্বস্বতা বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ক্ষতি করেছে?

সেলিম : নিঃসন্দেহে। সংসদ সর্বস্বতা ও বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তির মানসিকতা কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী প্রাণসত্তা নষ্ট করেছে। ভারতে এবং বাংলাদেশে আমরা বাম ও ডান বিচ্যুতির মাঝে পেন্ডুলামের মতো দোলা খেয়েছি। ভারতের কথাই ধরুন, যোশীর আমলের ডান বিচ্যুতি, সেখান থেকে রণদিভে আমলের বাম বিচ্যুতি। একটা ভুল, সেটাকে সমাধান করতে গিয়ে আরেকটা ভুল, সেখান থেকে আরও ভুল। এত বছরের সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, অথচ সাফল্য নেই। আমার একটি বিষয় মনে হয়, যেটা আগেও বললাম, কমিউনিস্টদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী হতে হবে। পাকিস্তান আমলে পার্টি দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ ছিল। বিপুল দমনপীড়নের মধ্যে ছিল। ফলে কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দলের মধ্যে ঢুকে বা জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়েছে। এর ফলে কমিউনিস্টদের স্বাধীন বিকাশ ধাক্কা খেয়েছে। ১৯৯৩ সালে দলের মূল নেতৃত্ব বিলোপবাদী তত্ত্ব আনলেন। পার্টি বিপুল ধাক্কার মুখে পড়ল। নেতৃত্বের বিরাট অংশ আওয়ামী লীগ, গণফোরাম, বিএনপিতে চলে গেলেন। অনেকে বসে গেলেন। বহু কষ্ট করে পার্টিকে রক্ষা করা হলো সেই সময়। বিপুল রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও পার্টি রয়ে গেল। শত শহিদের রক্তে ভেজা পতাকা রক্ষা করা গেল। কিন্তু তারপরেও পুরনো রোগ ও ঝোঁকগুলি রয়ে গিয়েছে। আমরা সেগুলি থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। কমিউনিস্টরা যে নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারি, কোনও বুর্জোয়া দলের লেজুড়বৃত্তি না করেই, এই আত্মবিশ্বাস তৈরি করা জরুরি।

আরও পড়ুন- রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে ধুঁকছে ইউনূস সরকার : আলতাফ পারভেজ

অর্ক : শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী একদলীয় শাসন বাকশালে যোগ দেওয়া কি কমিউনিস্ট পার্টির ভুল ছিল?

সেলিম : নিঃসন্দেহে ভুল ছিল। যে পদ্ধতিতে আমরা বাকশালে যোগ দিয়েছিলাম, যে পাবলিক স্টেটমেন্ট করা হয়েছিল— সবই ভীষণ ভুল ছিল। আমরা ব্যক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভর করেছিলাম, যা ছিল চরম ভুল। ব্যক্তি যে দল বা শ্রেণির উর্ধ্বে নন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা বিবেচনায় আনিনি। একই ভুল কিন্তু জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও আমরা করেছি। সেবারও বুর্জোয়াদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। এই ভুলগুলির জন্য আমাদের বিরাট দাম দিতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

তবে একটি কথা আমি এখানে বলতে চাই। কমিউনিস্ট পার্টির বাকশালে যোগ দেওয়া নিয়ে একটি ভুল তথ্য খুব জনপ্রিয়। বলা হয়, আমরা গোটা পার্টি তুলে দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলাম। এটা ঠিক তথ্য নয়। সিপিবি নেতৃত্ব শেখ মুজিবকে একদলীয় সরকার না করার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তিনি তা মানেননি। এরপর গোপনে এক চতুর্থাংশ পার্টি নেতৃত্ব এবং দলীয় কাঠামো রেখে আমরা বাকশালে যোগ দিই কিন্তু প্রকাশ্য বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা গোটা দলসহ বাকশালে যোগ দিয়েছি। সে যাই হোক, গোটা বিষয়টাই যে খুব বড় ভুল ছিল, তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই।

অর্ক : বাংলাদেশের বামপন্থীদের রাজনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনার বিষয়ে আপনি আদৌ আশাবাদী?

সেলিম : অতি অবশ্যই আশাবাদী। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পুরনো সমীকরণ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিকাশের উপযুক্ত সময় এটাই। অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে লড়াই চালাতে পারলে বাংলাদেশে বামপন্থীদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা বিপুল।

অর্ক : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

সেলিম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

More Articles