গলা, মাথা, মুখ, হাত বাঁচাতে কুঁকড়ে নিয়েছিলাম নিজেকে : ইন্দ্রানুজ রায়

Indranuj Ray Jadavpur: বাঁ চোখে ১৪টি সেলাই। ঘা সারতে লাগবে প্রায় দুই সপ্তাহ। প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে চোখে! হাসপাতালে শুয়েই যাদবপুর প্রসঙ্গে যা বলছেন ছাত্রনেতা ইন্দ্রানুজ রায়

বাংলার রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চিত নাম ইন্দ্রানুজ রায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ১ মার্চ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভের ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়ির তলায় চাপা পড়ে আহত হয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে উঠে এসেছে তাঁর নাম। তাঁকে এবং তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। তুঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্কও। হাসপাতালের বেডে শুয়েই ইনস্ক্রিপ্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটালেন ইন্দ্রানুজ নিজেই।

এখন কেমন আছেন ইন্দ্রানুজ?

মেডিকেল রিপোর্ট হাতে এসেছে বলে জানিয়েছেন ইন্দ্রানুজ। ডান হাতের কব্জির হাড় এবং বাম পায়ের পাতার আঙুলের হাড় ভেঙেছে। ইন্দ্রানুজ বলছেন, “আর কোথাও হাড় ভেঙেছে কিনা ডিটেইলসে দেখার জন্য ফের MRI করতে রেকমেন্ড করেছে ডাক্তার। বাঁ চোখে ১৪টি সেলাই হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, ঘা সারতে লাগবে প্রায় দুই সপ্তাহ। প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে চোখে!” তবে আর কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি ইন্দ্রানুজ।

শনিবার ঠিক কী ঘটেছিল!

ইন্দ্রানুজের বর্ণনা অনুযায়ী, ওয়েবকুপার সম্মেলন চলছিল। OAT-এর বাইরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিল। সেই সময় তাদের সাধারণ ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে তৃণমূলের লোকজন। তারপর চেয়ার ছুঁড়ে মারে। তখন অবস্থানরত ছাত্ররা ভেতরে ঢুকে তৃণমূলের লোকেদের পাল্টা প্রশ্ন করে যে কেন তারা এগুলো করছে? বেরিয়ে এসে আবার অবস্থান শুরু করে এবং শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চায় ছাত্ররা। এরপর ব্রাত্য বসু বেরিয়ে এসে আশ্বাস দেন, প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি কিন্তু ইন্দ্রানুজরা দাবি করেন, সকলের সঙ্গেই কথা বলতে হবে ভেতরে বসে। শিক্ষামন্ত্রী মৌখিক আশ্বাস দেন যে তিনি আলোচনায় বসবেন। ইন্দ্রানুজের বক্তব্য, “তিনি যে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তা প্রমাণিত। কারণ তারপরেই তৃণমূলের কর্মীরা আমাদের মারধর শুরে করে হঠাৎ করেই। এই সুযোগে মন্ত্রী গাড়িতে উঠে যান। তখন আমরা গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই এবং বলি যে আলোচনা করার কথা বলেছেন, সেটা করেই যেতে হবে। তখন গাড়ি চালু হয়ে যায় এবং গাড়ি এগোতে থাকে। আমরা ‘না’ করছিলাম তাও গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর তখনই এটা ঘটে। গাড়িতে চাপা পড়ে চোখে, হাতে, পায়ে আঘাত পাই আমি। তখন আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল যে, নিজেকে বাঁচাতে হবে। নিজের গলা, মাথা, মুখ, হাত বাঁচাতে আমায় কুঁকড়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। সবাই গাড়িটা ঘিরেছিল। আমি গাড়ির তলায় যাওয়ার পর স্পিড কমেছিল কিনা বলতে পারব না, আমি শুধু দেখছি গাড়ির চাকা আমার হাতে, পায়ে উঠে গেছে। তারপর বাকিরা আমাকে সরিয়ে নেয়। আর মন্ত্রীর গাড়ি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়।”

আরও পড়ুন- যাদবপুর কাণ্ডে বেকায়দায় ব্রাত্য, কেন চুপ তৃণমূল?

ইতিমধ্যেই ব্রাত্য বসু ইন্দ্রানুজের বাবার সঙ্গে কথা বলে এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন ইন্দ্রানুজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই তাঁর সঙ্গেও কথা বলবেন। ইন্দ্রানুজ কী মনে করেন এই সৌজন্য প্রসঙ্গে?

এই প্রসঙ্গে ইন্দ্রানুজের সাফ কথা, “ব্রাত্য বসু এগুলো এখন সৌজন্য দেখানোর জন্য করছেন কিন্তু সত্যিই যদি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ থাকে, তাহলে সেদিন ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করার চেষ্টা না করে আলোচনায় বসতেন। এটা নজিরবিহীন যে, আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়ি চাপা দিয়ে খুন করার চেষ্টা করলেন। এখন যা করছেন তা আই ওয়াশ করার চেষ্টা। আমাদের যে বিভিন্ন দাবি শুধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে নয়, সমগ্র রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই বিভিন্ন ইস্যুগুলোর মোকাবিলা করতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আন্দোলন আমরা চালিয়ে নিয়ে যাব। এরকম আই ওয়াশ করার মতো কথায় আমরা ভুলব না।”

ইন্দ্রানুজের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। কী বলছেন তিনি?

এই প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রানুজের জবাব, “আমি RSF (Revolutionary Student’s Front)-এর সদস্য। আমাদের ঘোষিত অবস্থান যে, আমরা মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদকে বর্তমান সময়ে সবথেকে এগিয়ে থাকা এবং বৈজ্ঞানিক দর্শন বলে মনে করি। সেই দর্শনের ভিত্তিতে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করি।"

আরও পড়ুন- ঠিক কী কী দাবি ছাত্রদের? অগ্নিগর্ভ যাদবপুরের নেপথ্যে পুঞ্জীভূত যেসব ক্ষোভ

ইন্দ্রানুজ কি মাওবাদী?

অবশ্যই তিনি মাওবাদে বিশ্বাসী বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন ইন্দ্রানুজ। তিনি আরও বলেন, “মাওবাদ একটা দর্শন। এটা নিষিদ্ধ নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ও আছে এই বিষয়ে। যে কেউ মাওবাদ দর্শনে বিশ্বাসী হতে পারে। এমনকী CPI (Maoist)-এর সদস্যও হতে পারে। সেটাও অপরাধ না, যদি সে দলকে কোনওরকম অর্থসাহায্য না করে বা দলের সশস্ত্র কার্যকলাপে যুক্ত না হয়। সুপ্রিম কোর্ট এটা বলেছে, তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কী বলল বা মিডিয়া ট্রায়ালে কী বলা হচ্ছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।

মহম্মদ সেলিম ও শুভঙ্কর সরকার হাসপাতালে গিয়ে দেখা করেছেন ইন্দ্রানুজের সঙ্গে, কী বললেন তাঁরা?

ইন্দ্রানুজের জবাব, “তাঁরা ঘটনাটা জানতে চেয়েছিলেন। যা ঘটেছে আমি বলেছি। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন এই লড়াইয়ে পাশে থাকবেন।”

ইন্দ্রানুজ আদৌ পাশে চান সেলিম-শুভঙ্করদের?

এই প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট বক্তব্য অবশ্য দেননি ইন্দ্রানুজ। তাঁর বক্তব্য, “কোনও বিরোধী স্বরকে দমন করতে গেলে এতদিন মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হতো কিন্তু এখন গাড়ি চাপা দিয়ে মারার চেষ্টা হচ্ছে। এটাই যদি পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায় তাহলে আগামী দিন খুবই ভয়ংকর হবে। গণতন্ত্রে বিরোধী মতকে জায়গা দিতে হবে। সেটাকে গণতান্ত্রিক উপায়ে এবং রাজনৈতিকভাবে যদি মোকাবিলা করতে হয়, তো করতে হবে। সেই লড়াইয়ে যদি তাঁরা (সেলিম-শুভঙ্কর) আন্তরিকভাবে থাকতে চান তাহলে ওঁদের স্বাগত।"

সামনেই বঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে জমে উঠেছে ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকারের লড়াই। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে তোলপাড় রাজ্য-রাজনীতি। তাতে কিছুটা হলেও অক্সিজেন পেয়েছে বিধানসভায় শূন্য হয়ে যাওয়া বামেরা। সাম্প্রদায়িকতার বাইনারির মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনায় বামেরা উঠে এসেছে নতুন করে। রাজ্যের ভোটে কি কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে যাদবপুর কাণ্ড? সে উত্তর অবশ্য ভবিষ্যৎই দেবে।

More Articles