ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও মস্তিষ্ককে বিক্রয়যোগ্য করে তোলেননি প্রীতীশ
Sudhir Mishra on Pritish Nandy: প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ দিল্লিগামী একটা ফ্লাইটে। তখন ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’ ছবির জন্য টাকা জোগাড়ের যাবতীয় চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়েছি।
প্রীতীশ নন্দীর মতো মানুষ অত্যন্ত বিরল বললেও কম বলা হয়। একদিকে কবিতা লিখছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, আবার বক্সিং গ্লাভস পরে স্যান্ডব্যাগ ঝুলিয়ে রীতিমতো পেশাদার বক্সারদের মতো চলছে অনুশীলন। এই দৃশ্য যে না দেখেছে, সে বুঝতে পারবে না কী নিখুঁত তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গি এবং কী ক্ষুরধার তাঁর পাঞ্চ। ঠিক তাঁর পর্যবেক্ষণের মতো। আমার মতে, তিনি ছিলেন সেই সারির মানুষের অবিসংবাদী প্রতিনিধি, যিনি নরম, উদারমনস্ক এবং পাশাপাশি দৃঢ়চেতা ও যাকে আমরা চলতি কথায় বলি ‘মাচো’। প্রীতীশ নন্দী বিষয়ে বলতে গেলে দু-একটা কথা প্রথমেই বলা প্রয়োজন। তাঁর সঙ্গে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কোনও বিষয়ে উৎসাহ থাকলে সে বিষয়ে আলোচনার সময় তিনি খুব মন দিয়ে শুনতেন। তাঁর পর্যবেক্ষণও ছিল খুব তীক্ষ্ণ। সমস্ত আলোচনার সারবক্তব্য তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে দু-তিন বাক্যের মধ্যে সংক্ষিপ্ত করে আনতে পারতেন।
আমার মনে পড়ে, তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ দিল্লিগামী একটা ফ্লাইটে। তখন ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’ ছবির জন্য টাকা জোগাড়ের যাবতীয় চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়েছি। আমাকে হতাশ দেখে প্রীতীশ নন্দী এগিয়ে আসেন। ইতিপূর্বে যাঁর ফান্ড করার কথা ছিল, তাঁর মনে হয়েছে ছবিটির গল্প নিতান্তই অর্থহীন, অত্যন্ত পলিটিকাল এবং যেভাবে দরকার সেভাবে পলিটিকাল নয়। উপরন্তু, ছবির নায়িকা খানিকটা স্বেচ্ছাচারিণী। ফলে এ ছবি কেউ দেখবে না। এসব কথা শুনে প্রীতীশ নন্দী হাসেন। বলেন— ছবির গল্পটা কী, তার একটা বিবরণ দিতে। আমি ১৫ মিনিটের একটা ন্যারেশন দিই। ফ্লাইটেই। পুরোটা শুনে তিনি বোধহয় একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন মাত্র। সঙ্গে সঙ্গে বললেন— "কাল সকালে আমার অফিসে এসো। ছবিটা করো। আমি তোমায় টাকা দেব।" এভাবেই কিন্তু ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ’-র পথচলা শুরু। গালিবের কবিতার একটি অংশ ধার করে ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যাসি’ শিরোনামটা স্থির হলো।
আরও পড়ুন- কেউ রইল না আর, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়
এর আগে আমি প্রীতীশ নন্দী বিষয়ে জানতাম, তিনি টাইমস গোষ্ঠীর প্রকাশন অধিকর্তা। তাছাড়া ‘Illustrated Weekly’-র সম্পাদক। তাঁর আগে এই পত্রিকার সম্পাদনা করতেন খুশবন্ত সিং। ক্রমশ জানলাম, বিহারের ভাগলপুরে তাঁর জন্ম। পড়াশোনা কলকাতায়। তাঁর মা লা মার্টিনিয়ের কলেজের প্রথম ভারতীয় ভাইস প্রিন্সিপাল। তাঁর দাদা শ্রুতকীর্তি আশিস নন্দী। তবে প্রীতীশদা তাঁর মায়ের কথা খুব বলতেন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, কলকাতা শহরই কি তাঁর কবিসত্তার প্রকাশ ঘটাল? সাহিত্যপ্রীতি কি কলকাতা শহরকে ঘিরেই? কলকাতার সাহিত্যমহল নিয়ে তিনি বেশ হইহই করে কথা বলতেন। দক্ষিণ আমেরিকান এক লেখক হতে চেয়েছিলেন উপন্যাস রচয়িতা এবং সেই অর্থে একজন কবি। প্রীতীশদার এই কথাটা আজও মনে পড়ে। লাতিন আমেরিকার লেখকরা তাঁদের অব্যবহিত চারপাশকে সরাসরি প্রভাবিত করতে চান। কখনও কখনও দেশের রাজনীতিকেও। এইসব কথা শুনেছি প্রীতীশদার কাছে। তিনি সুযোগ পেলেই কবি, চিত্রনির্মাতা, চিত্রকরদের সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। তখন তাঁর প্রবল প্রতাপ। টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপের একজন বড় পদাধিকারী। সাক্ষাৎকার কী করে নিতে হয়, সেই বিদ্যা আমার মনে হয় প্রীতীশদার কাছে শেখা উচিত। তিনি বলতেন, কবি সেই মুহূর্তে একজন সাংবাদিক, একজন সম্পাদক এবং একজন এমন মানুষ যাঁর মতামত, যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তাঁকেও প্রভাবিত করবে। তিনি মানুষের নষ্ট-ভ্রষ্ট বিষয়গুলো চিনতে পারতেন। কোথায় একজনের বিচ্যুতি, কোথায় তাঁর শক্তি, কীভাবে সেই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তাঁর সামর্থে রূপান্তরিত করা যেতে পারে, এইসব বিষয়ে প্রীতীশদার সঙ্গে আলোচনা চলত। আমার সম্পর্কে এমন অনেক কথা বলেছেন যা এক অর্থে কটুবাক্য কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত। আমি তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ যে তিনি এতটা সময় নিয়ে আমার সম্পর্কে ভেবেছেন।
অনেক সময় তাঁর ভাবনা আমাকে কার্যকরী করতে হয়েছে। অর্থাৎ, আমার নিজেকে কিছুটা বদলাতে হয়েছে যাতে তাঁর কিছুটা সমাদর পেতে পারি। ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’ একটা এমন ছবি যেখানে কলকাতার র্যাডিকাল সংস্কৃতি ভীষণভাবে উপস্থিত। শিক্ষিত, অত্যন্ত মেধাবী এক প্রজন্ম ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের চোখে দুনিয়া বদলানোর স্বপ্ন। কলকাতার মিছিল, মিটিং, পুলিশের লাঠি-গুলি এবং সেই সঙ্গে বাদল সরকার। ১৯৭৪ সালে বাদলদারা যখন ‘মিছিল’ নাটকটি প্রযোজনা করবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছেন, সেখানে পুলিশ লাঠি চালায়। একজন নাট্যানুরাগীর মৃত্যু হয় পুলিশের লাঠিপেটায়। কার্জন পার্কে অভিনয় করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর বাদলদারা প্রায় গেরিলা কায়দায় ঢুকে পড়লেন কার্জন পার্কে। এইসব খবর তখন আমাদের কাছে আসছে। দিল্লির শ্রীরাম সেন্টারের ওপর তলায় ওই লোকটির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। ‘ভোমা’ প্রযোজনা নিয়ে বাদলদা ছুটছেন দক্ষিণবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে। তাঁর পিছু ধাওয়া করেছি, অনামিকা হাকসর, বীণা পল প্রমুখরা। আমরা ‘ভোমা’-তে কোরাসের মতো যে অংশগুলি আছে, তাতে গলা মিলিয়েছি। বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ আর কীসের যেন হাহাকার। বাদলদা গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছেন তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের কাছে নাটকটি কি দুর্বোধ্য? তাঁরা বলছেন— "কেন, এ তো ক্ষুধার নাটক। ভোমা ভাত খেতে চাইছে। এ নাটক দুর্বোধ্য হবে কেন!"
আরও পড়ুন- থিয়েটারে-বাস্তবে যেভাবে নগ্ন প্রতিবাদের মুখ হয়েছেন মণিপুরের মেয়েরা
‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ’-র কথা যখন ভাবছি, তখন আমার মগজের ভেতরে বসে আছেন উত্তর কলকাতার ছোটখাট চেহারার ওই মানুষটি। তাঁর কণ্ঠস্বরে তখন বজ্রনির্ঘোষ। তাঁর লেখা যেন আগুনের বর্ণমালা। সারা জীবন, এই মুহূর্তে যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তখনও আমার মানসপটে উপস্থিত রয়েছেন বাদলদা। ছবি যখন হবে না এমনটাই দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি, সেই সময় প্রীতীশদা হাত রেখেছিলেন আমার কাঁধে। আর ছবি করার জন্য যখন এখানে সেখানে ঘুরে মরছি, মাথা খুটছি তখন প্রতিটি মুহূর্তে আমার সঙ্গী হয়েছেন বাদল সরকার। নিশ্চয়ই অদৃশ্যভাবে। কিন্তু আমার কাছে তিনি সবসময়ই দৃশ্যমান। বাদলদার কাছ থেকে অগ্নিমন্ত্র গ্রহণ করেছিলাম আমরা। তারই ফলশ্রুতি আমার ছবি করতে আসা। উত্তাল সেই সময়ের অস্থিরতা আমার সাধ্য মতো ধরে রাখতে চেয়েছি এই ছবিতে। বাদলদা এই ছবি দেখেছেন কী দেখেননি এ নিয়ে কিছু বলব না। আমি ওঁকে দেখেছি। প্রীতীশ নন্দীর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে তিনি আমার আরেকটি ছবিও প্রযোজনা করেন (‘চামেলি’)।
প্রীতীশদার কথায় ফিরি। তাঁর বহু সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখর হয়েছেন সমালোচকরা। কেউ কেউ তাঁকে নিন্দা করেছেন, ধিক্কার জানিয়েছেন। তিনি ক্ষমতার অলিন্দের কাছাকাছি ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু তাঁর মন, মনন, মস্তিষ্ককে কখনও বিক্রয়যোগ্য করে তোলেননি। প্রীতীশদা ছিলেন উদারমনস্ক এবং স্বাধীন চিন্তার মানুষ। কোনওদিন তিনি হাল ছাড়েননি। কোনও একটি বিষয় কখনও জনপ্রিয় হয়, কখনও আবার হয়ও না। একসময় যাঁরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা ছেড়ে গিয়েছেন প্রীতীশদাকে। তাঁর বিরোধিতা করেছেন। তবু প্রীতীশদা নিজের অবস্থানে থেকেছেন অনড়, অটল। কখনই কোনও বিষয়ে তিনি গোঁড়া ছিলেন না। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও পিছ-পা হতেন না।
আরব সাগরের জল এখনও নোনা। মুম্বইয়ের ট্র্যাফিক জ্যাম বাড়ছে-কমছে। মেরিন ড্রাইভে সান্ধ্য ভ্রমণকারীরা এখনও পথে হাঁটছেন। কিন্তু প্রীতীশদাকে ছাড়া মুম্বইয়ের কথা ভাবতে কেন জানি না ভালো লাগছে না।
(সুধীর মিশ্রর দু'টি লেখা এবং একান্ত একটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন সুদেব সিংহ)