'অপর'-কে বুঝে ফেলার বিভ্রান্তিকর মহত্বের অহংকে প্রশ্ন করে যান গায়ত্রী

Gayatri Chakravorty Spivak: স্পিভাকের গবেষণার অন্যতম বিষয় যেমন প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষকে নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তা করতে শেখানো, তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির মূল কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তাঁর অবদান।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সামাজিক মাধ্যম জুড়ে সংক্রামক হয়ে উঠেছেন এক বাঙালি ভাবুক। খবর – মানববিদ্যার গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০২৫ সালে নোবেল সমতুল হলবার্গ পুরস্কার লাভ করেছেন জনৈক বাঙালি নারী – গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। একদিকে গায়ত্রী উচ্চশিক্ষিত বাঙালির একটি পরিচিত নাম, ইংরেজি সাহিত্য কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রের কাছে যিনি পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত স্পিভাক, অন্যদিকে তাত্ত্বিক জটিলতা এবং দর্শনের পুরুষ অধ্যুষিত এলাকায় একক নারী হিসেবে তাঁর ভিন্নতর উপস্থিতি ভীতি ও সম্ভ্রম জাগায়। একদিকে তিনি বিনির্মাণের মতো আপাতদৃষ্টিতে দুর্বোধ্য এক দার্শনিক ঘরানার অন্যতম দিশারী, অন্যদিকে তিনি দেশজ প্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞানের উত্তরঔপনিবেশিক চিন্তা পরিকল্পের প্রধানতম ভাবুকদের একজন। তাঁর প্রতিটি পরিচয়ের সঙ্গে কোথাও মিশে আছে অপরিচিতি – বিস্ময়বোধ – স্ট্রেঞ্জনেস। যেন স্পিভাকের পাঠের নিদান মেনেই আকাদেমিক মহলে চিন্তক রূপে তাঁর নিজের উপস্থিতিও এক ক্রিটিকাল ইন্টিমেসি অথবা জটিল নৈকট্যের দাবি রাখে।

একদিকে যা কিছু সহজ, যা কিছু কাছের, যা কিছু খুব চেনা তার ভিতরের লুকিয়ে থাকা, অদর্শিত জটিলতার পরত উন্মোচনই স্পিভাকের দার্শনিক প্রস্থান। তাঁর লেখার ব্যাপ্তি জুড়ে রয়েছে মার্ক্সবাদ, নারীবাদ, উত্তরঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চাকে নতুন করে, তার আপাত সারল্যকে ভেদ করে, আভ্যন্তরীণ জটিলতাকে উন্মোচনের আহ্বান। এই লেখার উদ্দেশ্য সেই কাজের ব্যাপ্তিকে দু-এক কথায় বলা নয়। স্পিভাকের অনুসারী হলে সেটা অসম্ভব। ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদার বিনির্মাণতত্ত্বের অন্যতম আকরগ্রন্থ Of Grammatology-র (১৯৬৭) যে স্বকৃত অনুবাদের মাধ্যমে স্পিভাকের পাশ্চাত্য আকাদেমিয়ায় প্রথম উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি, তার দীর্ঘ ভূমিকাতে প্রথমেই স্পিভাক স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে একটি লেখার সারসংক্ষেপ করা যায় না, সেটি অসম্ভব, যা করা যায় সেটি হলো পাঠ। কিন্তু পাঠ তো আমরা নিয়মিত করে থাকি। আমাদের সব থেকে সরল এবং নিয়মিত অভ্যাস বই থেকে শুরু করে ছায়াছবি, প্রকৃতি, মানবসমাজ ইত্যাদি সমস্ত কিছুর পাঠ। মানুষের যুক্তিবোধ যেন সমস্ত কিছুই পাঠ করতে সক্ষম। মানুষ এভাবেই বহির্জগতের জটিলতাকে সরল করে নেয়, আপন করে নেয়, প্রতিষ্ঠিত করে নিজের ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব। এমনকী যে বিস্ময়কর প্রকৃতি ও অস্তিত্বকে সে পাঠ করে বুঝে উঠতে পারে না, সেই না বুঝে উঠতে পারাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারা, কান্টের ভাষায় সেই বিস্ময়কর সাবলাইমের অপাঠ্যকে অনুভব করাও যেন এক ভিন্ন ধরনের পাঠ। জাক দেরিদার বিনির্মাণের পথ অনুসরণ করে এই মানবতাবাদী, যুক্তিবাদী পাঠের অহংকে প্রশ্ন করাই যেন স্পিভাকের ভাবনার গোড়ায়। এই পথেই তিনি নারীবাদ, মার্ক্সবাদ অথবা উত্তরউপনিবেশবাদের পাঠ প্রক্রিয়াকে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করান। অর্থাৎ আমাদের পাঠের অভ্যাসে বদল আনাই স্পিভাকের দার্শনিক কাজের অভিমুখ।

আরও পড়ুন- কেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের হলবার্গ পুরস্কার প্রাপ্তি এত গুরুত্বপূর্ণ?

এখানে এটাও মনে রাখতে হবে যে, তত্ত্ব এবং প্রয়োগের ভেদ বিনির্মাণের চিন্তন পদ্ধতিতে থাকে না। চিন্তার প্রচলিত অভ্যাসকে ভেঙে দেওয়ার, তার অন্দরের না-বলা কথা, নীরবতাগুলির অনুসন্ধান চিন্তার প্রক্রিয়ায় একটি প্রয়োগ তো বটেই। তার প্রভাব অবশ্যই চিন্তায় আবদ্ধ নয়, কারণ আমাদের প্রতিটি কাজ চিন্তা-নির্ধারিত। চিন্তার অভ্যাসে বদল এলে যে কোনও কাজ করার পদ্ধতিতেও বদল আসতে বাধ্য। স্পিভাকের গবেষণার অন্যতম বিষয় যেমন প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষকে নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তা করতে শেখানো, তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির মূল কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তাঁর অবদান। কিন্তু তাঁর অবদান চোখে দেখা কেজো বস্তুগত সাহায্য প্রদান নয়। প্রান্তিক মানুষকে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে রেখে, কেবলমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যকারী যে শিক্ষিত ভারতীয় বুর্জোয়া সমাজ তৈরি হয়েছে তার ফলে সৃষ্ট চেতনাগত দূরত্বের সমাধান করার দুরূহ প্রচেষ্টাই তাঁর উদ্দেশ্য। নচেৎ, স্পিভাকের কথা— একদল মানুষ চিরকাল যেমন সামাজিক ন্যায়ের অধিকারপ্রাপ্ত থেকে যাবে, আরেক দল থাকে যাবে কৃপাপ্রার্থী যারা নিজেরা নিজেদের সমস্যাগুলো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না, কল্পনাশক্তির মাধ্যমে নিজেদের প্রান্তিক অবস্থা থেকে উত্তরণের দিশা খুঁজতে পারবে না। অর্থনৈতিক, ঔপনিবেশিক এবং জাতপাতের বৈষম্যের শিকার এই মানুষদের চিন্তার জগত থেকে বহিষ্কারের ফলে তৈরি হওয়া দূরত্বের উত্তরণ কেবল সুবিধাভোগী সমাজের মানুষদের থেকে প্রাপ্ত বস্তুগত সাহায্য এবং প্রান্তিক মানুষের সমস্যা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব নয়।

স্পিভাক তাঁর Aesthetic Education in the Era of Globalization (২০১২) গ্রন্থে সংকলিত একাধিক প্রবন্ধে এবং অন্যত্র দেখিয়েছেন কেন ও কীভাবে এই চেতনার দূরত্বকে বোঝা সম্ভব এবং কেবলমাত্র প্রান্তিক মানুষের চেতনাগত আঘাতকে বোঝার এক প্রায় অসম্ভব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাদের ভিতর নান্দনিক বোধকে জাগ্রত করার দিকে যাওয়া, যুগযুগ ধরে নিষ্পেষণ ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে থাকার ফলে তাদের ভোঁতা করে দেওয়া আকাঙ্খায় বদল আনা সম্ভব। এভাবেই হয়তো তারা তাদের অবস্থা এবং অবস্থানকে বুঝে উত্তরণের কল্পনা করতে পারবে। গায়ত্রী স্পিভাক তাঁর এই দার্শনিক পরিকল্পকে ব্যবহার করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক কিছু এলাকায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে বঞ্চিত জনসমাজের মাঝে কল্পনাশক্তি জাগ্রত করার শিক্ষা দেওয়ার বিদ্যায়তন স্থাপন করেছেন। মনে রাখতে হবে এই পদ্ধতি কলোনিয়াল প্রভুদের, জাতীয়তাবাদী ভাবুকদের মতো ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থা নয়, তদানীন্তন মার্ক্সবাদীদের সর্বহারাদের কীভাবে বিপ্লব করতে হয় শেখানোর ভ্যানগার্ড রাজনীতিও নয়। এ রাজনীতি পাঠের রাজনীতি, প্রান্তিক মানুষের জাগতিক অভিজ্ঞতাকে বুঝে তার লব্জেই তার কল্পনাশক্তির অনুশীলন।

আরও পড়ুন- গায়ত্রী স্পিভাক বনাম অনশুল কুমার: এর নাম দলিত রাজনীতি?

আবার, আমরা যেভাবে মূলস্রোত সমাজের প্রান্তবাসীদের দেখি, তাদের সমস্যাগুলোকে পাঠ করি সেই অভ্যাসে বদল আনাও স্পিভাকের পাঠের রাজনীতির অংশ। সমস্ত চিন্তার মূলে থাকে দার্শনিক পদ্ধতি আর দর্শন আমাদের চিন্তাকে এক মাত্রায় বাঁধে। এই বাঁধুনি দিতে গিয়ে কিছু ভাবনাকে চেতনার বাইরে রাখা হয়। ঔপনিবেশিক চিন্তার হাত ধরে ভারতে প্রবেশ করে পাশ্চাত্য আলোকায়ন পর্বের যুক্তিবোধ। কিন্তু সেই যুক্তিবোধ ও উদারনীতির চর্চা সীমিত ছিল এই দেশের কলোনিয়াল ভদ্রলোক সমাজের মধ্যে, এই দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ তার আওতায় আসেনি। তাই এই যুক্তিবোধ নিম্নবর্গের মানুষদের বিচ্ছিন্নতাকে বোধবুদ্ধিহীনতা বা অনুন্নয়ন মনে করে উপেক্ষা করে এসেছে। পরবর্তীতে মার্ক্সবাদীচর্চা এবং উত্তরঔপনিবেশিক চর্চা মূলস্রোত সভ্যতার “অপর” ব্যাখ্যায় সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করলেও তারা এই অপরকে নির্দিষ্ট ভিন্নতায় মেপে তাদের সমস্যাকে বুঝে ফেলার চেষ্টা করে। পাশ্চাত্যের উত্তরঔপনিবেশিক চিন্তায় এক সময়ের উপনিবেশগুলির প্রান্তবাসীরা যেন গবেষণার উপাদান যাদের বাইরে থেকে বোঝা যায় নির্দিষ্ট দূরত্বে আর উত্তরঔপনিবেশিক দেশের উচ্চশিক্ষিত গবেষক যেন স্পিভাকের ভাষায় native informant— যারা এই উপাদান সংগ্রহ করে পৌঁছে দেয় তথাকথিত উন্নত বিশ্বের কাছে।

স্পিভাকের অন্যতম বিখ্যাত প্রবন্ধ “Can the Subaltern Speak?” (প্রথম প্রকাশ - ১৯৮৫)। সেখানে তিনি এমন এক সামাজিক পরিস্থিতির কথা বলেন যেখানে নিম্নবর্গের স্বর উপস্থাপিত হয় না, তাদের সম্পর্কে জানা যায় উচ্চবর্গের কথন থেকে। মনে রাখতে হবে আমাদের পাঠের ভুল অভ্যাস চিরকাল ভাবিয়েছে স্পিভাকের লেখার অর্থ বোধহয় এটাই যে নিম্নবর্গ কথা বলতে পারে না। কিন্তু তাঁর চিন্তার মূল এখানে নিম্নবর্গের কথা উপস্থাপিত না হওয়ার ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিস্থিতি। বিশ্বায়নের উন্নয়নের বড় গল্পে এই নিম্নবর্গের মানুষগুলো যেন কতগুলো তথ্য, যাদের বঞ্চনাকে দূর থেকে বুঝে ফেলে তাদের সুযোগসুবিধা দিয়ে শান্ত রাখা যায়, অব্যাহত থাকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক আদানপ্রদান। ‘ওরা-আমরা’— এই দ্বৈততায় একাংশ সর্বদা অন্য অংশের হয়ে কথা বলে। এই কথা বলার রাজনীতি – অপরকে বুঝে ফেলার বিভ্রান্তিকর মহত্বের অহংকে প্রশ্ন করা এবং প্রান্তিক মানুষের কল্পনাশক্তিকে আমাদের চিন্তার কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়াই গায়ত্রী স্পিভাকের গবেষণার মূল অভিমুখ। এ কথা ভুললে চলবে না যে তিনি একই সঙ্গে নারীবাদী তাত্ত্বিক। পিতৃতান্ত্রিক অহং সব সময় ভাবায় পুরুষ বা পুরুষসুলভ সক্ষম ভাবুক সকলের সমস্যা বুঝে সকলের হয়ে কথা বলবে। নারীস্বর সেখানে প্রান্তিক। নারীর মনকে তাই মনোঃসমীক্ষক সিগমন্ড ফ্রয়েড মনে করেন দুর্বোধ্য। স্পিভাকের চিন্তায় নিম্নবর্গকে ভাবা হয়েছে অনুরূপ দুর্বোধ্যতা এবং অজ্ঞাত অবস্থানের জায়গা থেকে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেমন নারী, তেমনই ভারতের মতো উত্তরঔপনিবেশিক সমাজে নিম্নবর্গ – যাদের পরিচয় কেবল বোঝা যায় সমাজের মূলস্রোতের থেকে পার্থক্যের মাধ্যমে। কিন্তু সেই পার্থক্য তাদের বিচ্ছিন্নতার কারণেই পুরোপুরি জানা যায় না। রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তীর প্রমুখ নিম্নবর্গচর্চার কাণ্ডারিরা ঐতিহাসিকভাবে এই দেশের নিম্নবর্গকে সামাজিক সাংস্কৃতিক ভেদের মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেয়েছিলেন। স্পিভাক দেখালেন, নিম্নবর্গের ভাষাগত এবং দার্শনিক অপর হিসেবে নির্মাণ। স্পিভাক আমাদের বলেন চিন্তার জটিলতা অভ্যাস করতে। বিশ্বায়নের পরিমাপযন্ত্র আজ সারা দুনিয়ায় যখন প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বিপন্নতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাধানের পরিবর্তে যখন হয়ে উঠছে সংকটের কারণ, তখন স্পিভাকের পথ অনুসরণ করে আমরা না হয় সরল উত্তরের পথ বর্জন করি। দেখতে থাকি চিন্তার বাঁধুনির মধ্যে কারা বাদ পড়ে গেল। আমাদের কল্পনাশক্তি কি ধরতে পারে চিন্তার সেই “অপর”?

 

লেখক সিধো-কানহ-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়ার ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

More Articles