হাসিনার পথে হাঁটছেন ইউনূস, জুলাই নিয়ে আমরা গর্বিত: সিপিবি-র সাধারণ সম্পাদক

Left movement in Bangladesh: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন সঙ্গে আলাপচারিতায় অর্ক ভাদুড়ি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন। শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড, জুলাই গণঅভ্যুত্থান, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ, বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনের সংকট ও সম্ভাবনা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন অর্ক ভাদুড়ির সঙ্গে।

অর্ক ভাদুড়ি: আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, আপনাকে স্বাগত জানাই৷ সিপিবি-র নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন৷ প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ায় ধন্যবাদ। একদম শুরুতেই জানতে চাইব, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? আমরা দেখলাম চট্টগ্রাম বন্দর সংক্রান্ত চুক্তিও একই দিনে হলো। এর কারণ কী?

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন: অর্ক, আপনাকে ধন্যবাদ। ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময়ের গণহত্যা-সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, অপরাধ যেই করুক না কেন তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবেএকইসঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছপ্রশ্নমুক্ত হতে হবেজুলাই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে সবকিছু আকাঙ্খানুসারে না হলেও বিচারের সূচনা হয়েছে এবং তার প্রথম রায় ঘোষণা হয়েছেএই মামলার পরবর্তী ধাপগুলোয় প্রয়োজনীয় অগ্রগতি প্রয়োজনশুধু তাই-ই নয়, অন্য যারা অপরাধ করেছে, তাদের সকলের বিচারও সম্পন্ন করতে হবে

সরকারের সব কাজের ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে ‘ন্যয়বিচারের’ বিষয়েও তার আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেমন, মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাইব্যুনালের বিচার সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হলেও, যে চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার নিয়ন্ত্রণ আমেরিকাকে দিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার, লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে, বলতে গেলে প্রায় সংগোপনে চুক্তি স্বাক্ষর করল কেন? এ থেকে মানুষের মাঝে সন্দেহ জেগেছে যে, সরকারের আসল উদ্দেশ্য হয়ত অন্যকিছুন্যায়বিচারের বিষয়টি তার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষের মনে হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের বিচার চলছে ‘প্রতিহিংসার’ জন্য বা লোক দেখানো ‘প্রতীকী’ পদক্ষেপ হিসেবে। এরকম হলে বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের আস্থাহীনতা বাড়বে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের শিকার ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি কঠিন হবে। শহিদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, ফাইয়াজ, সিপিবি নেতা কমরেড প্রদীপ ভৌমিক, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী রিজভী, তাহের জামান প্রিয়, সাপ্তাহিক একতার কর্মী আতিক, হকারনেতা ইউসুফ সানোয়ার, গার্মেন্ট শ্রমিকনেতা আশরাফুল-সহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ সকল শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী, শিশু ও নারী হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ও সুষ্ঠ বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে ন্যায় বিচারের স্বার্থেদণ্ডপ্রাপ্তদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার কী আইনি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেটা জনগণকে জানাতে হবে। বিচার যেন প্রতীকী না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে

অর্ক: সম্প্রতি ঢাকায় সিপিবি যে জাতীয় সমাবেশের আয়োজন করেছিল, তাতে একজন সুফি সাধক মঞ্চে ছিলেন। তিনি বক্তৃতাও করেছেন৷ সমাবেশে উপস্থিত কয়েকজন তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিলেও বৃহত্তর বামপন্থী বলয়ে আপনাদের এই উদ্যোগের প্রশংসিত হয়েছে। আপনি কমিউনিস্ট পার্টির এই পদক্ষেপকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ক্বাফী রতন: আমরা শ্রেণি আন্দোলন ও শ্রেণি সংগ্রামের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়টিকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ত্রয়োদশ কংগ্রেসে আলোচনা করেছি। এর প্রেক্ষিতেই আমরা গত ৩১ অক্টোবর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কনভেনশন আহ্বান করেছিলাম। সেখানে ৫৫ টি গোষ্ঠী অংশ নিয়েছিল। আমরা ১৪ নভেম্বরের জাতীয় সমাবেশে প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে চারজনকে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তাঁদের একজন পাহাড়ের আদিবাসী, একজন সমতলের আদিবাসী, একজন হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও একজন সুফি। ৫ অগাস্ট, ২০২৪ এর পর থেকে বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত মাজার ভাঙ্গা হয়েছে। আমাদের দেশের একজন সর্বজনশ্রদ্ধ সুফিসাধক হযরত শাহপরাণের মাজার ভাঙচুর করা হয়েছেসুফি, বাউলদের চুল, দাড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে। গত দেড় বছরে সালাফি, ওহাবী, মওদুদীবাদীদের হাতে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছেন সুফিরা, মাজারপন্থীরানিপীড়িত মাজারপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবেই একজন তরুন সুফিসাধককে আমাদের মঞ্চ থেকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির এই উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসা পেয়েছেনিপীড়িত মাজারপন্থীরা স্বস্তি পেয়েছেন, প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন এটা আশার কথা।

আমাদের লড়াইয়ের মূল ধারা হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রাম। তার পাশাপাশি ভবিষ্যতে সব ধরনের সামাজিক নিপীড়ণের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব। এটাই হচ্ছে ৫ অগাস্ট পরবর্তী আমাদের নতুন রাজনীতি

অর্ক: একটু ব্যক্তিগত আলোচনায় যাই। আপনি এক সময় কর্পোরেট জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতেন। সেই চাকরি ছেড়ে বামপন্থী রাজনীতিতে এসেছেন। আপনার রাজনৈতিক যাত্রার শুরুটা যদি একটু বলেন

ক্বাফী রতন: আসলে আমি কর্পোরেটে গিয়েছিলাম নেহাতই ঘটনাচক্রে। নব্বই সালে সোভিয়েতের পতনের পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে বড় বিপর্যয় দেখা দেয়। ৭৭ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ১৩ জন কমিউনিস্ট বাদ দিয়ে বাকি ৬৪ জন হয় দলত্যাগ করেন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। অনেকে অন্য দলে চলে যান বা নতুন দল গঠন করেন। আমরা সে সময় ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির কর্মী ছিলাম। আমাদের তখন বলা হলো, পার্টি আর সার্বক্ষণিক কর্মী বা হোলটাইমারের ধারণায় বিশ্বাস করে না। এই কারণে আমি ১৯৯৩ সালে ছাত্র আন্দোলন ছেড়ে যাই। তখন আমি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলাম। এমতাবস্থায় আমি একটি চাকরির পরীক্ষা দিই এবং তাতে উত্তীর্ণ হয়ে যাই। প্রথম চাকরির পরীক্ষাতেই এই সাফল্য না পেলে হয়ত আমার মন বদলে যেত, চাকরি করাও হত না। এরপর প্রায় ২৩ বছর আমি ব্যাঙ্কে কাজ করেছি। ২০১৪ সালে যখন আমি স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়ি, তখন ওই ব্যাঙ্কের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ছিলাম। মানসিকভাবে আমি সবসময়ই রাজনৈতিক কর্মীই ছিলাম। চাকরি করাকালীনও আমি গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করি, পার্টির আহ্বানে যুব ইউনিয়নে যোগ দিই এবং দু'টার্মে সাড়ে সাত বছর সেখানে সভাপতি থাকি। নিরানব্বই সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই। সুতরাং, রাজনীতি বিচ্ছিন্ন আমি কখনোই ছিলাম না। পার্টি একদিনের জন্যই ছেড়ে যাইনি, কিন্তু সার্বক্ষণিক কর্মী হওয়ার স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ২০১৪ সালে যখন আমার পরিবারকে আমি কনভিন্স করতে পারি, তখন আমি চাকরি ছেড়েছি

অর্ক: আর রাজনীতিতে আসার একদম শুরুটা কীভাবে হলো?

ক্বাফী রতন: যৌবনের প্রথমে আমার রাজনীতিতে আসাটা খুব ইন্টারেস্টিং। আমি পড়তাম ক্যাডেট কলেজে, আপনাদের যেমন মিলিটারি স্কুল আছে সেরকম। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আমি সেখানে পড়েছি, সপ্তম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। সেখানে শুধু সরকারি পত্রিকা যেতে পারত। 'দৈনিক বাংলা' নামে তখন একটি পত্রিকা ছিল। ১৯৮৪ সালে একদিন তাতে পড়লাম তাজুল ইসলাম নামে একজন শ্রমিক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি একজন মেধাবী মানুষ ছিলেন; পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছেন, অষ্টম শ্রেণিতেও পেয়েছেন, স্কুল কলেজে লেটারমার্ক-সহ পাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনাও করেন। তারপর সপ্তাহে ৭০ টাকা মজুরিতে তিনি শ্রমিক হিসেবে যোগ দিলেন আদমজী জুটমিলে, শুধুমাত্র সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলবেন বলে। সেখানে ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি হরতালের মধ্যে তাঁকে আঘাত করা হয়। পরের দিন মার্চের তারিখ তিনি মারা যান। আমার ক্যাডেট কলেজের এক সহপাঠীর দুলাভাই ছিলেন তিনি। তাঁর এই শ্বশুরবাড়ির দিক ছিল খুবই বনেদি। তাঁর বড় ভায়রা ছিলেন মেজর জেনারেল, পরবর্তীতে এরশাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই বন্ধুর মাধ্যমে কমরেড তাজুল ইসলামের স্ত্রী নাছিমা ইসলামের সঙ্গে আমার সংযোগ হয় এবং আমি তাঁকে পত্র লিখি। ইতোমধ্যে, আমাদের বর্তমান হাইকোর্টের একজন বিচারপতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তখন তিনি ঢাকা কলেজে পড়তেন। কোনো একটা আন্দোলনের সময়ে তাঁর নামে মামলা হওয়ায় তিনি ফেরার হয়ে আমার মামার বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার নানা রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বছর ২৮ মে, চট্টগ্রামে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিনে, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহদাতকে তাঁরই রুমমেট, ছাত্র শিবিরের কর্মী হারুন গলা কেটে হত্যা করে। আমি তখন ঢাকায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ঢাকায় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজিত হলে মামার সঙ্গে আমিও তাতে যোগ দিই। সেই ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সমাবেশে আমার প্রথম যোগদান। তবে, সক্রিয় ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন করা শুরু করি ১৯৮৫ সালের ২৫ জুলাই। তারপর থেকে একদিনের জন্যেও আমার রাজনৈতিক জীবন থেমে থাকেনি

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে ধুঁকছে ইউনূস সরকার : আলতাফ পারভেজ

অর্ক: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বামপন্থীদের ভূমিকার বিষয়ে আসি। সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে সিপিবি-র নবনির্বাচিত সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, আপনি, প্রেসিডিয়ামে থাকা জলি তালুকদার-সহ বাকি নেতানেত্রীরা সকলেই গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতের বামপন্থীদের একাংশ মনে করেন এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী রাজনীতির শক্তিশালী হয়েছে, জামাতে ইসলামির ক্ষমতায়ন ঘটেছে। আপনি এ বিষয়ে কী বলবেন? জুলাই অভ্যুত্থানে আপনাদের অংশগ্রহণের জন্য এখন কি আপনারা দুঃখিত?

ক্বাফী রতন: অবশ্যই না। জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে আমরা গর্বিত। অভ্যুত্থান তো ছত্রিশ দিনের, কিন্তু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন অনেক পুরনো। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচনটা হয়েছিল, তার ভোট করানো হয়েছিল আগের দিন রাতের অন্ধকারে। সে জন্য এটাকে আমরা 'নৈশকালীন নির্বাচন' বলে থাকি। সেই নির্বাচনের পরে ১১ জানুয়ারি বাম-গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থীদের একটা কনভেনশন হয়েছিল। সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেখ হাসিনার শাসনের ইতি ঘটাতে হবে। বাংলাদেশে শাসন করার কোনো বৈধ অধিকার তাঁর আর নেই। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁকে উৎখাত করাই হবে আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাতেও এই সিদ্ধান্ত সমর্থিত হয়। ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে নানারকম ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই লড়াই এগিয়ে গিয়েছে। ২০১৮ সালেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং কোটা আন্দোলন হয়েছে। এই সকল আন্দোলনই ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা চরম পরিণতি পায়

খুব বিনয়ের সঙ্গে বলি, ভারতের কমরেডদের সঙ্গে আমার পরিচিতি এবং অভিজ্ঞতা বেশ কম, কিন্তু তাঁদের কিছু বিবেচনায় আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হই। যেমন তাঁদের অনেকের বদ্ধমূল বিশ্বাস "শেখের বেটি ভুল করতে পারে না"। আমরা যদি বলতাম নেহরুর কন্যা ইন্দিরার পক্ষে কোনো ভুল করা সম্ভব না, এঁরাই কিন্তু রে রে করে উঠতেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনে আমরা তো দিনের পর দিন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অপহৃত হতে দেখেছি, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারিনি। আমাদের লড়াই ছিল সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ জন এমপি বিনা ভোটে জিতে গিয়েছিলেন! সরকার গড়তে লাগে ১৫১ জন। এটা ভারতে কল্পনা করা সম্ভব? ১৯৭২ সালের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে সিদ্ধার্থশংকর রায় যে ভয়াবহ রিগিং করেছিলেন, সে কারণেই তো সিপিআই(এম) সঠিক ভাবেই সেই নির্বাচনকে বয়কট করেছিল। বাংলাদেশে ২০১৮-র 'রাতের নির্বাচনে'-র যে কথা বললাম, সেটিও তেমনই। প্রার্থী হয়েও আমি নিজেই ভোট দিতে পারিনি! ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নেননিআওয়ামী লীগের প্রার্থী লড়েছেন আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাকেই তো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল৷ এর বিরুদ্ধেই ছিল আমাদের লড়াই

দুর্নীতির কথা তো বলে শেষ হওয়ার নয়। শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, তাঁর বাসার কাজের ছেলেটিও চারশো কোটি টাকার মালিক। শেখ হাসিনার খুড়তুতো ভাইয়ের বাসা থেকে বস্তা বস্তা টাকা পাওয়া গিয়েছে। তাঁর দলের সিনিয়র নেতা আমীর হোসেন আমুর বাসা থেকে ৫ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। ২ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের বাসা থেকে। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করল, তাতে দেখা গিয়েছে যে হাসিনার আমলে ২৮ লক্ষ কোটি টাকা বিভিন্নভাবে দুর্নীতি হয়েছে। আমরা এই সংগঠিত রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়েছিআমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে দেশে আসে ২৩ বিলিয়ন ডলার। গার্মেন্ট শ্রমিকদের উৎপাদন রফতানি থেকে আসে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সরকারি পরিষেবা কিন্তু উন্নত হচ্ছে না। কারণ, ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর পাচার হয়ে গিয়েছে। একদিকে আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষরা প্রাণপাত পরিশ্রম করে অর্থ আয় করে আনছেন, অন্যদিকে লুটেরা ধনি শ্রেণির প্রতিনিধিরা তা বিদেশে পাচার করছেন। শেখ হাসিনার আমলে ১৫ বছরে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। আমরা এসবের বিরুদ্ধে লড়েছি। এই কথাগুলি ভারতের বামপন্থী কমরেডরা গভীর ভাবে চিন্তা করেন না বলেই হয়ত শেখ হাসিনাকে তাঁরা নির্দোষ ভাবতে পারেন

অর্ক : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলিতে রাজপথে আপনাদের ভূমিকার কথা যদি একটু বলেন..

ক্বাফী রতন : ২০২৪-এর ১৯ জুলাই, শুক্রবার, শেখ হাসিনার সরকার কারফিউ জারি করল। ৫ অগাস্ট ছাড়া সবচেয়ে বেশি হত্যা সংগঠিত হয়েছিল এই ১৯ জুলাই। ২৬ জুলাই, আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর নেতা জামশেদ আনোয়ার তপনের নেতৃত্বে কারফিউ ভেঙে সেনাবাহিনীর সামনে গানের মিছিল বের করেছিলাম আমরা। ওইদিন বিকেলবেলা বামজোটের তরফে মানববন্ধন করলাম। ২৭ জুলাই নারীদের বিক্ষোভ সমাবেশ হলো। ২৮ তারিখ শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ পল্টন মোড়ে সমাবেশ করল। সেখান থেকে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো। এই সমাবেশ থেকে বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আমাদের কালচারাল স্কোয়াডকে থামিয়ে দেওয়া হয়। তখন আমরা ২ অগাস্ট দ্রোহযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিই। ঐতিহাসিক এই দ্রোহযাত্রায় জড়ো হয়েছিলেন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। আমরা যদি সেদিন সারারাত বসে থাকতাম, শহিদ মিনারে অথবা শাহবাগে, তাহলে পরের দিন সকালে সেটা কমপক্ষে এক লক্ষ লোকের জমায়েতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমরা থাকিনি। হয়ত সেই প্রস্তুতি ছিল না। ইতোমধ্যে আন্দোলনকারী ছাত্ররা ১ অগাস্ট জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শহিদ মিনারে সমাবেশের ডাক দেন ৩ তারিখে। ছাত্রদের ডাকা সেই সমাবেশে জড়ো হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। যেটা আমরা করতে পারতাম, সেই সুযোগ ভীরুতা বা নির্বুদ্ধিতার কারণে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও বলব, দ্রোহযাত্রা ছিল আমাদের ব্রেকথ্রু পদক্ষেপ এবং এর কারণেই দু'দিনের মাথায় হাসিনার পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে যায়। গোটা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। কারফিউ-এর পরে মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে আনার কৃতিত্বটা কিন্তু আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি বা উদীচী-র। সময়ের হিসাবটা যদি আমরা আরেকটু সঠিকভাবে করে উঠতে পারতাম, একদিন আগে-পরের গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারতাম, তাহলে হয়ত আমরাই এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতে পারতাম।

অর্ক: গত চোদ্দো মাসে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থীদের দাপাদাপি খুবই প্রকট হয়েছে। অজস্র মাজার ভাঙা হয়েছেসংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছেন এবং যেমনটা আগেও বললাম অনেকেই একটা আশঙ্কা করছেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসলে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি শক্তিশালী হয়েছে, হাসিনার পতনে জামাতে ইসলামের নতুন করে ক্ষমতায়ন ঘটেছে। এটা নিয়ে আপনার কী বক্তব্য?

ক্বাফী রতন: জামাতে ইসলাম তো নতুন করে আমদানি হয়নি। তাদের পাকিস্তান থেকেও নিয়ে আসা হয়নি৷ আকাশ থেকেও তারা নেমে আসেনি। তারা এই জমিনেই ছিল। এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিপি-জিএস, নাম নিচ্ছি না, তাঁরা গত বছর অগাস্টের আগে কী ছিলেন? তাঁদের ভিডিও তো ফেসবুক ইউটিউবেই পাওয়া যায়জামাতের ছাত্র শিবিরের যে নেতা ডাকসুর ভিপি হয়েছেন, তাঁকে ভিডিওতে শেখ হাসিনার পক্ষে শ্লোগান দিতে দেখা গিয়েছেডাকসুর এখনকার ছাত্র শিবিরের জিএস ছিলেন ঢাকস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের আওয়ামী ছাত্রলীগের কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। ছাত্রলীগের একজন সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন, সাত বছর শিবিরের ‘সাথী’ ছিলেন। সিলেটের এমসি কলেজে পড়তেন, যেখান থেকে তাঁকে শিবির হিসেবে চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই ছেলে ঢাকায় এসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। এই যে অসংখ্য শিবির ছাত্রলীগের মধ্যে আত্মগোপনে ছিল, তারাই এখন বেরিয়ে আসছে। বামপন্থী ছাত্রনেতা মেঘমল্লার বসুকে আওয়ামী লীগের আমলে বারবার মারাত্মক আঘাত করা হয়েছে। যে হেলমেট বাহিনী তাঁকে আক্রমণ করেছে, তাদের মধ্যেও হেলমেটধারীর ছদ্মবেশে প্রত্যক্ষভাবেই শিবির ছিল। জামাতে ইসলামের যারা এতদিন চুপচাপ ছিল, তারা এখন মাঠে নেমে আসতে পারছে কেন? কারণ, ৫ অগাস্ট আন্দোলন শেষ হওয়ার পর আমরা, বামপন্থীরা রাজপথের দখল রাখিনি, বিশ্রামে চলে গিয়েছি। যে ছাত্ররা সেদিন পথে নেমে এসেছিল, তাদের ৯৯ শতাংশই ক্লাসরুমে ফিরে গিয়েছে। আমি সেদিন বলেছিলাম "বাবারা, তোমরা ক্লাসরুমে ফিরে যাও, তবে রাজপথেও তোমাদের পদচারণা থাকতে হবে"। কিন্তু তাদেরকে রাজপথে রাখার জন্য যে উদ্যোগটার দরকার ছিল, সেই উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি।

আমরা যখন নিষ্ক্রিয় ছিলাম, দক্ষিণপন্থীরা তখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রশাসন দখল করেছে। ৫ অগাস্ট অবধি যে লোকটি আওয়ামী আমলের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিল, তিনমাসের মধ্যে সে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সচিবে রূপান্তরিত হয়েছে। এটা কীভাবে হয়েছে? ইউনূস সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে জামাত শিবির নিজের ক্যাডারদের প্রোমোশনের ব্যবস্থা করে নানারকম উচ্চপদে বহাল করেছে। তারা এখন প্রশাসনিক ক্যু করার চিন্তায় মশগুল

বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামি কখনোই ৫-৬ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। কিন্তু তাদের অর্থ আছে প্রচুর। তাদের হাতে ইসলামি ব্যাঙ্ক আছে, শত শত হাসপাতাল আছে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আছে, আরও অনেককিছু আছে। এগুলো তারা কোথায় পেয়েছে? ১৯৭১-এর পরে গোলাম আজম মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন, সেখানে 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি' নামে চাঁদা তুলেছিলেন। সৌদি আরবের একটি এনজিও রাবেতা-আল-ইসলামি, জামাতে ইসলামকে নানা ভাবে অর্থ জুগিয়েছে, তাদের নেতাদেরকে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই যে মীর কাসেম আলী, তিনি রাবেতার পরিচালক ছিলেন। এই সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা যে অর্থ সংগ্রহ করেছে, এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মরত প্রচুর কর্মীকে ব্যবহার করে এবং টাকা দিয়েও লোকবল বাড়িয়ে তারা নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রবল জনপ্রিয়তা বা ক্ষমতার স্ফীতি অনেকটাই ফাঁপা বেলুনের মতো। অবশ্যই এখন তারা আগের তুলনায় ভালো পরিস্থিতিতে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্বাচনে (ডাকসু) তারা জয়লাভ করেছে, এর মধ্যে দিয়ে একধরেন শক্তিপ্রদর্শনও তারা করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ডাকসুতে জয়লাভ করা দেশের ক্ষমতাদখলের পূর্বলক্ষণ না। তা যদি হত, তাহলে ৭২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় যেতে পারত। সে বছরে বাংলাদেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটা কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল জয়লাভ করেছিল।

অর্ক: ডাকসুর কথা যখন উঠল, তখন আরেকটা প্রশ্ন করি। শিবিরের জয়ের মাঝেই আমরা দেখলাম বামপন্থী প্রার্থী মেঘমল্লার বসু পাঁচ হাজার ভোট পেলেন, হেমা চাকমা জয়লাভ করলেন। এটা কীভাবে হলো বলে আপনি মনে করেন? দক্ষিণপন্থার পাশাপাশি বামপন্থারও একটা উত্থান বা প্রতিরোধ কি দেখছি আমরা?

ক্বাফী রতন: একটা কথা আছে, শত্রুকে বন্ধুহীন করে দিতে হবে। জ্যোতি বসু এই আপ্তবাক্যের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সব বামপন্থী শক্তিকে বামফ্রন্টে একজোট করে। ডাকসু নির্বাচনের আগে এই কথাটা আমরা বলেছিলাম। উমামা ফতেমা আর মেঘমল্লার বসুদের যদি জোট হত, তাহলে কিন্তু ঘটনাটা অন্যরকম ঘটতে পারত। সেইসঙ্গে অন্যান্য স্বতন্ত্র যে প্রার্থীরা চার হাজার করে ভোট পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও অনেককে সঙ্গে আনা যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি, ভোটের পাটিগণিত শেষ পর্যন্ত আমাদের বিপক্ষে ছিল।

অর্ক: কিছুদিন আগে আপনি বলেছিলেন মাজারপন্থীদের সঙ্গে ঐক্যের প্রয়োজনের কথা। এটাও বলছিলেন, ২০৩৬ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা আপনারা ভাবছেন। বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে তো এগুলি অনেকে ভাবতেই পারেন না। না পারাই স্বাভাবিক। আপনি আপনাদের আগামী দিনের যাত্রাপথকে কীভাবে দেখছেন যদি একটু সবিস্তারে বলেন। সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন, বর্তমানে দক্ষিণপন্থীদের দাপটের পিছনে ইউনূস সরকারের মদত রয়েছে বলে আপনার মনে হচ্ছে কি?

ক্বাফী রতন: কক্সবাজার ঢোকার মুখে রামু বলে একটি শহরের সব বৌদ্ধ মন্দিরগুলি ভেঙে দেওয়া হয় ২০১২ সালে। সেই ঘটনার ১৩ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা একটি সমাবেশ করেছি। যখন আমরা সেই সমাবেশ করছিলাম, একইধরনের ঘটনা তখন ঘটেছে খাগড়াছড়িতে। শেখ হাসিনার আমলে বলা হয়েছিল ভারত এটা করাচ্ছে। পরেও দেখলাম ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা বলছেন, ভারত এটা করাচ্ছে। এই যে ন্যারেটিভের সাযুজ্য, তা থেকেই বোঝা যায় তাদের নির্লিপ্ততা কতখানি। হাসিনা যদি এরশাদ হয়, আর ইউনূস যদি হাসিনা হয়, তাহলে আর লড়াই করে লাভ কী হলো! ইউনূসের ভাষাও যদি হাসিনার ভাষা হয়, তাহলে তো এত জীবনদান, এত পঙ্গুত্ববরণের কোনো মানে হয় না। দক্ষিণপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করা, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়ানো এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ইউনূস সরকারের একধরনের নির্লিপ্ততা আছে। গত এক বছরে যত মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে, নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের জন্য খুবই বেদনানায়ক। শুধুমাত্র বিশ্বাসের তফাৎ থাকার জন্য একজন মৃত মুসলমানের লাশ কবর থেকে তুলে তাঁকে দাহ করা হয়েছে এই ঘটনা কতখানি লজ্জাজনক! ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট আচরণ করছেন এক শ্রেণির মানুষ।

আমরা বামপন্থীরা তো সমাজের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়েই এতদিন লড়াই করেছি। যেমন শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর। তার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদেরও যদি যুক্ত করতে পারি আমাদের রাজনীতির সঙ্গে, তাহলে ভালো বৈ মন্দ হবে না। পতিত স্বৈরাচার একটা মিথ্যা-সেক্যুলারিজমের আবরণ দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভুলিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ক্ষমতার পিরামিডের নিচের অংশেই তাঁদের রেখে দিয়েছিল। তাঁদের মূল্য কেবল ভোটবাক্সেই সবচেয়ে বেশি ছিল। আওয়ামী লীগের দ্বারা সবচেয়ে নিপীড়িত হয়েছেন তাঁরাই। এটা আমার কথা নয়, 'দিনবদলের কর্মসূচী'র লেখক আবুল বারাকাত এই কথা বলছেন। তাঁর বইতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ সবচেয়ে বেশি যাদের দখলে আছে, তাঁরা বংশপরম্পরায় আওয়ামী লিগার। তাঁদের বাবা দাদারা হয়ত ছিলেন মুসলিম লিগে, তারপর তাঁরা গিয়েছেন আওয়ামী লিগে। পুত্র পৌত্রাদিক্রমে হিন্দুদের পরিত্যক্ত জমিবাড়ি এবং সম্পত্তি দখল করে বসে আছেন। কিন্তু এরাই আবার সংখ্যালঘুর রক্ষাকর্তার ভাবমূর্তি নির্মাণ করে রেখেছে। এদের অনুপস্থিতিতে এখন সত্যিকার অর্থে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে পারে কমিউনিস্ট ও অপরাপর বামপন্থীরাই। আমাদের দলীয় কংগ্রেসে আমরা যে দলিল প্রস্তাব করেছিলাম, তাতে আমরা স্পষ্ট করে বলেছি বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে একটা রামধনু জোট গড়ে তোলার কথা। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলে যে শব্দবন্ধ আপনাদের ভারতেও খুবই জনপ্রিয়, বাংলাদেশেও আমরা তার প্রয়োগ করতে চাই। সামাজিক সম্পর্কগুলিকে মজবুত করে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসতে চাই।

এই পরিকল্পনা মাথায় রেখেই আমরা বলেছি যে, ২০২৬ সালে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। ২০৩১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে আমরা একটা ধাক্কা দেব। তারপর ২০৩৬ সালে আমরা ক্ষমতায় আসব। যদি তার আগেই আমাদের যথেষ্ট শক্তিবৃদ্ধি ঘটে, সেক্ষেত্রে হয়ত ২০৩৬ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা নাও করতে হতে পারে এবং ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পরিপূরক আরেকটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ক্ষমতা অর্জন করতে পারি

আমরা বলছি এখন দু'টো বাক্স আছে একটা বিএনপির বাক্স, একটা ইসলামপন্থীদের বাক্স। আমরা চাই একটা তৃতীয় বাক্স তৈরি করতে যেটা হবে গরিব মানুষের বাক্স। বিএনপি বা জামাত কেউই গরীব ও প্রান্তিক মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না। কাজেই তাঁদের কাছে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে আসার যথেষ্ট কারণ থাকবে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি আমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।

অর্ক: গত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে জামাত বিরোধিতার প্রশ্নে আপনাদের সঙ্গে বিএনপির সুর খানিকটা যেন মিলে যাচ্ছে। আপনাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো নির্বাচনী বোঝাপড়ার কি সম্ভাবনা আছে?

ক্বাফী রতন: আজকে জামাতে ইসলাম এমন ভাব করছে যেন তারা ক্ষমতায় চলে এসেছে। এটা বাস্তবতা-বিবর্জিত আচরণ। নানাধরণের প্রচার চালাচ্ছে তারা। একটা শ্লোগান দিচ্ছে "চাঁদা তোলে এখানে, ভাগ যায় লন্ডনে"। বিএনপির প্রধানকে তারা খলনায়ক সাজাবার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি একটা টিভি টক শো-তে আমি ছিলাম, যেখানে উপস্থিত একজন মৌলবী- তিনি জামাত করেন না, তবে জামাত-ঘনিষ্ঠ, বিএনপির প্রতিনিধির উদ্দেশ্যে বলে বসলেন "আপনাদের মহাসচিব তো নাস্তিক, কারণ তিনি শরিয়ার বিরুদ্ধে বলেছেন।" এই হলো জামায়াতের আচরণ!

আমরা আমাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে জামাতের মোকাবিলা করতে করতে আসছি। জামাত-শিবিরের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত আমাদের বন্ধুদের গলা-কাটা, কব্জি-কাটা লাশ দেখেছি। কিন্তু বিএনপির এই অভিজ্ঞতা ততখানি নেই। তারা তাই জামাতের এধরনের আক্রমণে বেশি ভীতসন্ত্রস্ত। ১৯৮৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির একজন ছাত্রনেতা কবীরকে শিবির হত্যা করেছিল। তখন আমরাই প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই থেকে ৫ অগাস্ট ২০২৪ পর্যন্ত শিবির কখনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি। জামাত-শিবিরের বিরোধিতা, মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের বিরোধিতার প্রশ্নে আমরা তো একই অবস্থানে আছি। বিএনপি বরং এখন বুঝতে পারছে যে জামাতের সঙ্গে সহযোগিতার যে পথ তারা অতীতে বেছে নিয়েছিল, সেইটা তাদের রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে তাদের প্রধান নেতা থেকে শুরু করে অনেকেই এখন জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন।

অর্ক: শেখ হাসিনা প্রবল জামাত-বিরোধী বা বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার কাণ্ডারি বলে নিজেকে তুলে ধরতেন। আবার এই হাসিনার আমলেই আমরা দেখেছি প্রচুর মডেল মসজিদ করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে শফি হুজুরের নিবিড় সম্পর্ক। ১৯৯৬ সালে জামাতের সঙ্গেও আওয়ামি লিগের আন্দোলনের ঐক্য হয়েছে। শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জামাত সম্পর্কে অবস্থান নিয়ে আপনি কী বলবেন?

ক্বাফী রতন: গোলাম আযম তো জামাতের আমির ছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে পারতেন না, যেহেতু তাঁর নাগরিকত্ব ছিল না। তাঁর জায়গায় ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন আব্বাস আলী খান। পত্রপত্রিকায় সে সময় ছবি বেরিয়েছিল, শেখ হাসিনা আব্বাস আলী খানের হাত থেকে কোরান শরিফ গ্রহণ করছেন। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিশের সাথে ব্লাসফেমি আইন বিষয়ে চুক্তি করেছিল। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গোলাম আযমের কাছে গিয়ে তাঁর ভোটপ্রার্থনা করেছিল। কওমী মাদ্রাসার ডিগ্রীকে প্রথাগত স্নাতকোত্তরের সমমানের ডিগ্রির মর্যাদাও দিয়েছিলেন শেখ হাসিনাই, এই কারণে তাঁকে কওমী জননী নামে অভিহিত করা হয়হাসিনার আমলেই বাংলাদেশের স্কুলপাঠ্য বই থেকে ২৯টি লেখা বাদ পড়েছিল, কারণ এই লেখাগুলি হিন্দু বা নাস্তিকদের লেখা। এর মধ্যে রয়েছে হুমায়ুন আজাদের লেখা, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, শরৎচন্দ্রের লেখা। মেকি-সেক্যুলারিজমের গল্প দিয়ে হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের মন ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে পরিণত করেছে পারিবারিক সম্পত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বীর যোদ্ধাদের কোনো জায়গা সেই কাহিনীতে ছিল না।

অর্ক: আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লিগের আবার ফেরার সম্ভাবনা আছে? যদি না থাকে, তাহলে আওয়ামী-বিহীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা অথবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনাদের অবস্থান কী হবে?

ক্বাফী রতন: নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক, সেটা আমরা চাই না। এটা আমাদের পার্টিগত অবস্থান। কিন্তু যে অপরাধ তারা করেছে সরকারি ভাষ্যেই অন্তত ৮০০ মানুষকে হত্যা করেছে, ২৫,০০০ মানুষকে পঙ্গুত্বে ঠেলে দিয়েছে, আঠাশ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছে, সেই সকল কারণে আইনি বিচারের মাধ্যমে যদি তাদের শাস্তি হয়, তাদের দল যদি নিষিদ্ধ হয় বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার না পায়, তাহলে আমার আপত্তির কিছু থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধ আর আওয়ামী লিগকে এক করে ফেলাই তো ছিল হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধ বা ইতিহাস বিকৃত করে ভাষা আন্দোলন আর শেখ মুজিবকে এক করে ফেলা। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়ে দেখবেন, ভাষা আন্দোলনের সময়ে মুজিব কিন্তু ছিলেন জেলখানায়। ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন তাঁকে লঞ্চে করে ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার কথা তিনি তখন জানতেনই না। ২২ তারিখ সকালবেলায় পত্রিকা পড়ে তিনি জেনেছেন ঢাকায় গুলি চলেছে, ছাত্র হত্যা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে আওয়ামী মদতে গল্প চালু ছিল, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে কাগজে লিখে ঘুলঘুলি দিয়ে ঢিলের সঙ্গে রাস্তায় ফেলতেন। সেই কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। অথচ শেখ মুজিব নিজেই সেই গল্পকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। এই যে আমাদের ইতিহাসটাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একটি পরিবারকেন্দ্রিক, একটি দলকেন্দ্রিক করে ফেলা হয়েছে, এইটাই তো দেশের ইতিহাসের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা

অর্ক: বাংলাদেশে বহু জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার খবর আসছে, আপনারা কী করবেন, কী পদক্ষেপ নেবেন?

ক্বাফী রতন: এইগুলি হচ্ছে ঘরপোড়ার মধ্যে আলুপোড়ার মতো। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙা বা ৩২ নম্বর ভাঙা তো আমাদের লড়াইয়ের লক্ষ্য ছিল না। যারা একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, তারা এই কাণ্ড গুলি ঘটিয়েছে। আমরা একদিকে লড়াই করছি, অন্যদিকে তারা এইসব ভাঙচুরের কাজ করছে। এইগুলিকে চিহ্নিত করা দরকার। ইউনূস সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এগুলিকে আটকানো যায়নিপুলিশ, আর্মি দেখেনি যে বুলডোজার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তারা কেন থামালো না? হাসিনার আমলেও প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়ে অনেক ভাঙচুর হয়েছে। এখনও তাই। ইউনূস সাহেব কেন এটা হতে দিলেন?

অর্ক: অনেকেই জুলাই অভ্যুত্থানকে মার্কিন-মদতপুষ্ট কালার রেভোলিউশন বলে মনে করছেন যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় বামেদের একটা বড় অংশও, হয়ত আপনাদের দলের অভ্যন্তরেও কেউ কেউ এমন ভাবছেন বা বলছেন।

ক্বাফী রতন: এই আন্দোলনটা ছিল একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এই আন্দোলনে কোনো নির্দিষ্ট দল, মতাদর্শ বা নেতৃত্ব ছিল না, কোনো গাইডিং প্রিন্সিপলও ছিল না। এই যে কোটি কোটি ছাত্রযুব রাস্তায় নেমে পড়ল, তাদের কোনো নেতা ছিল না। আমরা কমিউনিস্টরা আমাদের মতো করে নেমেছি, ছাত্রদল ছাত্রদলের মতো করে, জামাত জামাতের মতো করে নেমেছে। সবাই যার যার মতো করে নেমেছে। জামাতে ইসলাম যদি আমেরিকা থেকে টাকা পেয়ে থাকে, তার দায় তো আমার না। আমার কাছে সে তথ্য ছিল না। আমরা কোনো অবস্থাতেই আমেরিকার মদতপুষ্ট হয়ে কোনো আন্দোলন করিনি

অর্ক: আমি এখানে একটা তুলনা টানি। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল। তার জন্য কি মুক্তিযুদ্ধকে ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট বলা যায়? তেমনি, এখানে যদি আমেরিকার কোনো ভূমিকা থেকেও থাকে, তার জন্য কি এটাকে মার্কিন প্রজেক্ট বলা ঠিক হবে?

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে ভারত?

ক্বাফী রতন: মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছে। কখন করেছে? যখন আমরা ভারতে গিয়ে আশ্রয় চাইলাম। কিন্তু ভারতের প্রজেক্ট হিসেবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, এই কথাটা তো আমি মানতে রাজি না। আপনাদের পার্লামেন্টে প্রিয়াংকা গান্ধী-সহ অনেককেই বলতে শুনেছি ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছেন। সেটা সত্য নয়। তিরিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, দু'লক্ষ নারী ভয়ানক যৌননিপীড়ন সহ্য করে, আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছে। আমরা আপনাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। আমরা রাশিয়ার কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। সে কারণে আমরা কৃতজ্ঞ। একটা সময় ছিল যখন ত্রিপুরার মানুষের চেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশের মানুষ ত্রিপুরায় ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়। সেই কারণে কৃতজ্ঞতা আমাদের আছে। কিন্তু তার মানে এই না যে ভারত দেশ স্বাধীন করে আমাদেরকে উপহার দিয়েছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি

অর্ক: বাহাত্তরের সংবিধান বদলে ফেলার প্রয়োজনীয়তার কথা নানা মহল থেকে উঠে আসছে। এটা নিয়ে আপনার কী মত?

ক্বাফী রতন: বাহাত্তরের সংবিধান তো একটা চমৎকার সংবিধান ছিল। তাকে ১৮ বার সংশোধন করে নানারকম বিষয় ঢোকানো হয়েছেরাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঢোকানো হয়েছে। আবার আদিবাসীদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা হয়েছে। নানারকম বৈসাদৃশ্য এবং অসঙ্গতি আছে এটার মধ্যে। যে কারণে গণপরিষদের সব সদস্য স্বাক্ষর করলেও কেবলমাত্ৰ দু'জন ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সাক্ষর করেননি। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করার দাবি কমিউনিস্ট পার্টি করে না। বরং বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূল নীতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে বাদবাকি নানা অসঙ্গতি সমাধা করা এবং সংবিধানের সমসাময়িকীকরণের বিষয়গুলিকে এড্রেস করার প্রয়োজন আছে বলে আমাদের মনে হয়

অর্ক: সিপিবি-র বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ তারা ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের বি-টিম। কেউ খানিকটা বিদ্রুপ করে বলেন, 'হারমোনিয়াম পার্টি'। কেউ বলেন সিপিবি বাকশালে ছিল। এগুলির কিছু কথা তো অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবেই সত্য, যেমন বাকশালে আপনারা ছিলেন। আওয়ামী লীগ বিহীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় আপনাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগকে আপনারা কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন? বিশেষ করে আপনারা, যাঁরা এই অভ্যুত্থানে ও তসর আগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁরা এমন একটা দলের মধ্যে আছেন, যাকে আওয়ামী লীগের বি-টিম বলা হয়। এই জটিলতাকে কাটিয়ে উঠবেন কীভাবে?

ক্বাফী রতন: আমাদের নেতারা কিন্তু ১০০ শতাংশ সৎ মানুষ ছিলেন। একটা গল্প বলি। ১৯৭৩ সালে আমাদের দ্বিতীয় কংগ্রেস। কমরেড মনি সিং-এর বন্ধু ছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার। তিনি তখন খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। মনি সিং-এর অনুরোধে কংগ্রেসের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। কংগ্রেস শেষ হওয়ার পরে যেই রেশনটা বেঁচে গেছিলেন, সেটা ফেরত দেওয়ার জন্য কমরেড মনি সিং ফণীভূষণ মজুমদারের কাছে গেলেন। ফণীভূষণ মজুমদার আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন। বললেন, "দাদা, এটা অন্য জায়গায় খরচ করেন।" কিন্তু মনি সিং ফেরত নিলেন না। কংগ্রেসের জন্য নিয়েছিলেন, বেঁচে গেছে, বাকিটা ফেরতই দিতে হবে। কোনোকিছু পাওয়ার জন্য আমাদের নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য করেননি। তাহলে কেন করেছিলেন? রাজনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে করেছিলেন। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, অর্থাৎ অ-ধনবাদী পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবে জাতীয় বুর্জোয়াকে একটা সময় পর্যন্ত সহযোগী হিসেবে পাবে এই তত্ত্বের ভিত্তিতে। আমাদের যদি ভুল হয়ে থাকে, তা হলো আওয়ামী লীগকে জাতীয় বুর্জোয়া মনে করা। এটা প্রথম কংগ্রেসের সময় থেকেই। অনেকে হয়ত বলবেন আমি ভুল বলার কে? কিন্তু আমি মনে করি বামপন্থীরা যদি মুক্তিযুদ্ধে একটা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রাখতে পারতাম, তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কোনো বোঝাপড়ায় যেতে হত না। যেমন মনি সিং-কে বা মুজাফফর আহমেদকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে রাখা হয়েছিল, কিন্তু একটা বৈঠকের পর উপদেষ্টা মন্ডলীর আর কোনো বৈঠক হয়নি। আমাদের কমরেডরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে বসেছিলেন, কিন্তু একেবারে শেষের দিকে তাঁরা সেটা প্রয়োগ করতে পেরেছেন। ভারতের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমন বহু সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে

মুক্তিযুদ্ধের পরেও, বাহাত্তর সালে, মানুষ কমিউনিস্টদের সংকেত দিয়েছিলেন, 'তোমরা সামনে এসো'। সারাদেশের ছাত্রযুবরা কমিউনিস্ট পার্টিকে বাছাই করেছিল। আমরা মানুষের নির্দেশ বুঝে সাড়া দিতে পারিনি। যেমন শুরুতেই আমি বললাম যে, ২০২৪-এর ২ অগাস্টের রাতে আমরা বুঝতে পারিনি আমাদের করণীয়। ৩ অগাস্ট বাদ রেখে ৪ অগাস্ট আমরা প্রোগ্রাম রাখলাম। অথচ একদিন আগে প্রোগ্রাম রাখলেই হয়ত আমরাই আজকে এই অভ্যুত্থানের মূল নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতাম। বাহাত্তর সালেও তেমন হয়েছিল। আমাদের সমর্থন করেছিল যারা, তাদের বিরাট অংশ একে একে জাসদ ছাত্রলিগে যোগ দিয়েছিল। আমাদের মতো করেই পরবর্তী নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলিগ সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়লাভ করেছিল।

অর্ক: আপনাদের বাকশালে যোগ দেওয়াটা কি তাহলে ভুল হয়েছিল?

ক্বাফী রতন: অবশ্যই। এই বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য আছে। বাকশালে যোগ দেওয়া, মুজিবকে শ্রেণির বা পার্টির উর্দ্ধে দেখা এগুলি ভুল হয়েছিল। ৭৪ সালের অক্টোবরে কমিউনিস্ট পার্টি একটা প্রস্তাব নিল দেশে যে সরকারটি আছে, সেটি একটি দুর্নীতিবাজ সরকার, তাই অবিলম্বে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তখনও কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ন্যাপক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের সঙ্গে একসঙ্গে ত্রিদলীয় ঐক্য জোটে আছে। তারপরও অক্টোবর মাসে সিপিবি এই প্রস্তাব নিয়েছে। মূল্যায়ন ঠিক ছিল, কিন্তু নিদানটা ভুল হলো। সিপিবি বলল, এই সরকারকে পদত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুরই নেতৃত্বে আরেকটি দেশপ্রেমিক এবং সৎ সরকার গঠন করতে হবে। যিনি সরকারের প্রধান, তাঁরই নেতৃত্বে আরেকটা সরকার গঠনের দাবি মানে তো সরকার-প্রধানকে তাঁর দায় থেকে সম্পূর্ণ ছাড় দিয়ে দেওয়া! ১৯৮০ সালে তৃতীয় কংগ্রেসে এই ভুলগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ৫/৬টি ভুলের কথা স্বীকার করা হয়েছিল যেমন বাকশালে যোগ দেওয়া, বঙ্গবন্ধুকে শ্রেণির উর্দ্ধে দেখা, সমাজতান্ত্রিক পথে প্রগতির সূচনা হয়েছে এমনটা ধরে নেওয়া, খাল কাটা, জিয়াউর রহমানকে সীমিত অর্থে দেশপ্রেমিক বলা ইত্যাদি।

অর্ক: শেষ প্রশ্নটা করি। বাংলাদেশে যে ব্যাপক ভারত বিরোধিতা বেড়েছে, আপনি কীভাবে এটার কারণ ব্যাখ্যা করবেন?

ক্বাফী রতন: এটার একটা কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক। ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু চিন, পাকিস্তান। কিন্তু বলুন তো, পাকিস্তান বা চিন সীমান্তে কতজন লোক মারা যায়, আর বাংলাদেশ সীমান্তে কত লোক মারা যায়? আমরা তো ধারণা করতেই পারি যে অন্য দেশের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সময়ে আমরা ভারতের সমর্থন পাবো। কিন্তু আপনারা যখন আমাদের বিরোধিতা করেন বা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ খেপে যায়। আরেকটি দিক হচ্ছে ধর্মীয় গোঁড়ামি সংক্রান্ত বিদ্বেষ, যা থেকে কিছু লোক ভারতকে সমর্থন না করে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। কিন্তু ভারত বিরোধিতা আরও বেড়েছেঅগাস্টের পর থেকে, ভারতের গণমাধ্যম যখন নানারকম গুজব ছড়াচ্ছে, মিথ্যাচার করছে, তার প্রেক্ষিতে

ভারতের সম্পর্ক তো শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল না, ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। অথচ, শেখ হাসিনার পতনের পরে একবছর ধরে বাংলাদেশিদের ভারতের ভিসা দেওয়া বন্ধ। যাঁরা আগে থেকে ভারতে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, ভিসা না পাওয়ার কারণে মাঝপথে তাঁদের চিকিৎসা বন্ধ করতে হয়েছে। এমন অনেকগুলি বিষয় মিলে ভারতের প্রতি ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। এটা কিন্তু ভারতের জনগণের প্রতি ক্ষোভ নয়। খুব নির্দিষ্টভাবে বললে, ভারতের হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করেছে ভারত। একদম সরাসরি হস্তক্ষেপ। কংগ্রেস সরকারও একাজ করেছে, বিজেপি সরকারও করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এরশাদ অংশগ্রহণ করলেন না, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন। ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে উড়ে এলেন। হাসপাতাল থেকে এরশাদকে বের করে বাধ্য করলেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক আগে এরশাদের ভাইক ডেকে পাঠানো হলো দিল্লিতে। উনি দিল্লি থেকে ফিরে এসে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলেন। এবং তার কোনো কারণ দেখাতে তিনি অস্বীকার করলেন।

এমন ভাববেন না যে, আমরা বাংলাদেশিরা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের কারণে ভারতের বিরোধিতা করছি। তাহলে নেপাল কেন ভারতের বিরোধিতা করল? কারণ নেপাল নিজের স্বার্থ দেখেছে। বাংলাদেশেও, আমরা কমিউনিস্টরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ দেখছি, জাতীয় সম্মান দেখছি। আমাদের সীমান্তে হত্যা বন্ধ করার জন্য আমরা বলব, টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বলব। এই বাস্তবগুলি আমাদের মন খারাপ করে দেয়ার জন্য, আমাদের মধ্যে বিরুদ্ধতা আনার জন্য যথেষ্ট।

অর্ক: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

More Articles