বিরোধীদের বলতে দিন মাননীয়া

আনিস খানের মৃত্যু নাগরিক সমাজকে কতগুলি জোরালো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। যে প্রশ্নের উত্তর এখনই খোঁজা শুরু করতে হবে, নয়তো দেরি হয়ে যাবে।

২০২১ সালের মাঝামাঝি সুশাসন, ন্যায়বিচার ইত্যাদি নানা সোনার পাথরবাটি চেয়ে বাংলার মানুষ বিভেদকামী শক্তিকে রুখে দিয়েছিল ইভিএম-এর বোতাম টিপে। রাজ্যে তিন দশকের বেশি শাসন করা দলটির পাখির চোখ স্থির না হওয়ায় সিংহভাগ মানুষ বেছে নিয়েছিলেন নানাদোষে দুষ্ট হয়েও নির্বিঘ্নে দুই ইনিংস চালিয়ে নেওয়া দলকেই। জিততে মরিয়া শাসকশিবির স্লোগান তুলেছিল, বাংলা নিজের মেয়েকে চায়।  'নিজের' শব্দটিতে বড় বেশি জোর ছিল। নিজের লোক অর্থাৎ স্নেহ-শাসন দুইই করা যাবে। রক্ষিত হবে সকলের স্বার্থ। দেখা হবে না আর রঙ। তৃণমূল সর্বাধিনায়িকার থেকে এই বরাভয়ই চেয়েছিল রাজ্যের মানুষ। নাগরিকসমাজ  এবারের ভোটে যেন অনুঘটক হয়ে কাজ করেছিল স্রেফ দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের আশায়। আনিস হত্যা আজ তাদেরই আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করছে। এই যদি একটি থিতু সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো হয় তাহলে কথায় কথায় উত্তরপ্রদেশকে এক হাত নেওয়া কেন? হাথরাস কাণ্ডে পুলিশি ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুললে সেই আঙুল আনিস কাণ্ডেও তুলতে হবে।

আনিসের বাবা সালেম খান প্রথম দিন থেকেই দাবি করে আসছিলেন, পুলিশকর্মীরাই বাড়ি ঢুকে সদর দরজায় তাকে আটকে রেখে ছেলেকে নিয়ে উপরে উঠে গিয়েছিল। অথচ প্রাথমিক ভাবে তাঁর কথাকে আমল না দিয়ে নানারকম মনগড়া গল্প নির্মাণ করা হলো। এই সব গল্পের কারিগর কারা?  যারা নিয়মিত প্রসাদান্নভোগী? চারটি দিন নষ্ট করার পর জানা গেল আনিসের বাড়িতে সেদিন পুলিশ গিয়েছিল। কিন্তু কারা তারা, সে প্রশ্নের উত্তর আজো পাওয়া গেল না। আনিসের বাবাকে কেন স্কেচ করতে দেওয়া হলো না অভিযুক্তদের মুখাবয়ব? এই চারটি দিন প্রমাণ লোপাটের জন্যই নেওয়া হলো? আশপাশের সমস্ত থানায় কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিকদের জবানবন্দি কি নেওয়া হয়েছে? কোন থানায় সেই রাতে কারা দায়িত্বে ছিল? সন্দেহভাজনদের তালিকা করা হয়েছে? সেখান থেকেই ফোনের লোকেশান ট্র্যাক করে বিষয়টি সুনিশ্চিত করা- এটাই যে অপরাধী খোঁজার প্রথম পদক্ষেপ তা কমবেশি সকলেই জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াটাই ধোঁয়াটে। তদন্তের গতিপ্রকৃতি চাওয়াটা নাগরিক অধিকার। উত্তর চাইবে সে, যে বিশ্বাস করে একটি দলকে সিংহাসনে সুনিশ্চিত করেছিল তৃতীয়বার। প্রতিটি মানুষকেই উত্তর দিতে দায়বদ্ধ মাননীয়া পুলিশমন্ত্রী। কিন্তু তিনি কী করলেন!

ভোটে জিততে এই মুহূর্তে ভারতে অমোঘ অস্ত্র সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। একটি অখণ্ড ধারণাকে নানা স্বার্থ গোষ্ঠীতে ভেঙে ফেলা ছাঁচ সাজানোর পদ্ধতিকে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা চলে। দেশের রাজাধিরাজ নরেন্দ্র মোদী থেকে তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- সকলেরই এই পদ্ধতিটি পছন্দ। শুধু প্রয়োগে পদ্ধতিগত কিছু ফারাক রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তর্ভুক্তিকরণে বিশ্বাসী। অন্যদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের আসন্ন উৎসবের কথা বলতে গিয়ে ইদের কথা বলতে বেমালুম ভুলে যান। সে প্রসঙ্গ অবশ্য ভিন্ন। এখন স্তব্ধবাক করে দিচ্ছে, 'ও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত', এই উক্তি।  মৃত আনিস যেহেতু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত, তিনি যে বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন তা তৃণমূল নেত্রী হজম করতে পারছেন না? আমাদের বলতে তিনি নিশ্চয়ই প্রশাসনকে বোঝাননি। নিয়ে এসেছেন তাঁর দলকে, প্রশাসনিক কার্যকলাপ এবং দলীয় রাজনীতির মাঝের ব্যবধানটা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন হেলায়। রাজ্যের অভিভাবিকা যা বলবেন একপ্রকার বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বাধ্য লোকেরা সাহস করে বলে উঠতে পারছেন না, লাশ নিয়ে এই রাজনীতি অতি বিসদৃশ। আনিস তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত নাকি রাখত না- এই তত্ত্বের অবতারণা এখানে অর্থহীন। কারণ রাজার কাছে প্রতিটি প্রজাই সমদৃষ্টি প্রত্যাশা করে। আনিস বামসমর্থক হলে কি তার মৃত্যু জায়েজ! নাকি সমস্ত সংখ্যালঘুকে বাধ্যতামূলক ভাবে তৃণমূল মনোভাবাপন্নই হতে হবে!

কেউ কেউ বলছেন, আনিস নানা সময়ে স্ববিরোধিতায় ভরা পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। কিন্তু এইসব কুযুক্তি যারা দেন তারা কি বুঝবেন আনিস যাই করে থাকুন না কেন একটি মৃতদেহ ন্যায়বিচারের বেশি কিছু পেতে পারে না। তাকে সেটা পাইয়ে দেওয়া বিবেকবান জীবিতদের কর্তব্য। কারণ মৃত নিজের হয়ে সওয়াল করতে পারে না। আনিস কানহাইয়া কুমার, জীগনেশ মেবানিদের মতো বিরাট মাপের প্রশিক্ষিত ছাত্রনেতা ছিলেন না।  ছিলেন একজন সাধারণ ছাত্র যার গলায় বয়সোচিত প্রতিবাদী সুর ছিল। ছিল বিশেষ সামাজিক দায়বোধ, যেখান থেকে তিনি রক্তদান শিবির আয়োজন করতেন। সত্তর দশকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পুকুরে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এই আপাত সুস্থিত সময়ে সাধারণ এক ছাত্র কার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল যে তাকে এত নিখুঁত নীল নকশা সাজিয়ে মারতে হল! এবং আর কেউ নয়, স্বয়ং পুলিশই এই হত্যায় প্রশ্নের মুখে। ঘটনার অভিঘাতটা আর পাঁচটা সাধারণ খুন জখমের মতো নয়। এই পুলিশের দ্বারস্থই হয়েছেন আনিস ইতিপূর্বে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন বলে। নিরাপত্তা তো পানইনি,  পুলিশের উপস্থিতিতেই রাতের অন্ধকারে তাঁর অন্তিম শ্বাস পড়ছে। পুলিশি ব্যবস্থার উপর তাহলে সাধারণ মানুষ কী ভাবে আস্থা রাখবে, এ প্রশ্নের উত্তর তো পুলিশমন্ত্রীই দেবেন? ঠিক যেমন নন্দীগ্রাম পর্বে পুলিশি নৈরাজ্যের যাবতীয় উত্তর তদানীন্তন পুলিশমন্ত্রীর কাছে চাওয়া হতো বারংবার।  এই উত্তর চাওয়ার অধিকার রাজ্যের প্রতিটি মানুষের রয়েছে।

সেই অধিকার প্রয়োগ করতেই আজ পথে নামছেন কেউ কেউ। পথে নামছে বিরোধীরা। বিশেষত বামমনস্ক পড়ুয়ারা। কিন্তু সেখানেও শাসক তার মুখোশ খুলে ফেলে আসল মুখ দেখাচ্ছে। আমরা শহিদ দিবসের ঘটনার কথা ভুলিনি। মহাকরণ অভিযান ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করায় জ্যোতি বসু যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন তা জনতার মধ্যে থেকে উঠে আসা এক প্রবাদপ্রতিম নেতার মুখ নয়, বরং এক শাসকের শক্ত চোয়াল- যিনি বিরোধিতা সহ্য করবেন না। ইতিহাস নিজেকেই বারবার পুনরাবৃত্ত করতে থাকে। আজও বিরোধীরা রাস্তায় নেমে সেই একই শাসককে দেখতে পাচ্ছে। আটকে দেওয়া হচ্ছে প্রতিবাদীদের নবান্ন অভিযান। পুলিশ দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লালবাজারে। এই ধরনের কণ্ঠরোধ চেয়ে শাসককে ক্ষমতায় আনা হয়নি,  এই সত্যিটা নাড়াচাড়া করার সময় এসেছে। বিরোধিতার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ সুনিশ্চিত হবে এই ভেবে তারা এত কসরৎ করল কি না, নাগরিক সমাজ নিশ্চয়ই নিজের আত্মা খুঁড়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে। রিজওয়ানুর কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা গোটা রাজ্যবাসীকে লজ্জিত করেছিল। আমরা কি সেই জায়গাতেই দাড়িয়ে আজও? পুলিশ কি স্রেফ শক্তিমানের হাতের পুতুল হয়েই থাকবে?

এত দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো ভোটব্য়বস্থার প্রতিই মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে কেবলই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার মনে হয়, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানকে এ কথা জানিয়ে দেওয়ার দিন আজ। 

More Articles