প্রতিদিন একটু একটু করে অক্সিজেন, জেলে হেসেখেলেই সময় কাটছে কেষ্টর
Anubrata Mondal: মঙ্গলকোটে বেকসুর খালাস পাওয়া কতটা সুবিধে করল অনুব্রতর?
২০১৩ সাল। বঙ্গের রাজনীতিতে চড়াম চড়াম ঢাকের শব্দে, বাংলা সংবাদমাধ্যমে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটল অনুব্রত মন্ডলের। পশ্চিমবঙ্গের তাবড় রাজনৈতিক মুখকে পিছনে ফেলে বচন-হিরো হয়ে গেলেন বীরভূমের এই তৃণমূল নেতা। পুরনো মমতা-সৈনিক সংগঠনের কাজ বহুদিন যাবৎ করলেও হঠাৎ শোরগোল ফেলে সামনে আসেন ২০১৩-র নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে। রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন তখন আসন্ন। সেই সময়েই এক জনসভায়, তৃণমূলের প্রাক্তন কর্মী, নেতাদের নির্দল প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গ এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অনুব্রত বলেন, ''পুলিশের গাড়িতে বোম মারুন।'' যে 'নির্দল প্রার্থী বাধা দেবে' তাঁকেও আক্রমণের নিদান দেন অনুব্রত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তথাকথিত শান্ত বীরভূমে এহেন তৃণমূল নেতার খোঁজে শোরগোল পড়ে রাজ্যজুড়ে। এতদিন প্রায় প্রচারের আলোকের পিছনে থাকা অনুব্রত-বিতর্কে দল বেঁধে সরব হন বিরোধীরা। বয়ান-বিতর্ক গড়ায় আদালতেও। তারপর আর থামেননি অনুব্রত মন্ডল। বারবার চড়চড় করে বাড়িয়েছেন সংবাদমাধ্যমের টিআরপি। সকাল থেকে রাত, অনুব্রত হয়ে গিয়েছেন 'হট্ টপিক'। 'চড়াম-চড়াম', 'গুড়-বাতাসা', 'পাঁচন দাওয়াই' থেকে 'ভয়ংকর খেলা হবে'- এক একটি অনুব্রত-বচন যেন জায়গা করে নিয়েছে রাজনৈতিক অমোঘ বাণীর ইতিহাসে!
শত বিরোধিতাতেও তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। ভয়ংকর অনু-প্রভাবে প্রতি মুহূর্তে কুপোকাত হয়েছে বিরোধীরা। লাল মাটির দেশে অনুব্রতর 'লাল চক্ষুর' সামনে দাঁড়াতে পারেনি কেউ। কিন্তু কেন? এই বাড়বাড়ন্তর নেপথ্যে কী? বলা হয়, অনুব্রত মন্ডল মাছ ব্যবসার জীবন কাটিয়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার সময় থেকে বরাবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয়। 'কেষ্ট ভাই'-এর প্রতি আজীবন ভালবাসা রয়েছে দলনেত্রীর। তাই, শুধু বীরভূম নয়, পাশের বর্ধমানেও ক্রমশ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শান্তিনিকেতনের নিচুপট্টির সংগঠক অনুব্রত। মমতার এই পাশে দাঁড়ানোর প্রকাশ্য সূচনা হয় ২০১৩ সালেই। সেদিন বিধানসভার অলিন্দ তোলপাড়। বিতর্কিত মন্তব্যর অভিযোগে সিপিএম, কংগ্রেস একযোগে আক্রমণের পন্থা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় কেষ্ট-র বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ''কেষ্টকে নিয়ে এত শোরগোল কেন! ও চিঠি লিখে বলেছে এমনভাবে কথাটা (পুলিশের গাড়িতে বোম প্রসঙ্গে) বলতে চায়নি।'' অর্থাৎ, দলের নেতা সরকারের পুলিশকে বোম মারার কথা বলা নিয়ে যে সাফাই দিলেন, তা মানলেন স্বয়ং সরকারের প্রধান!
এই পাশে দাঁড়ানোর অভ্যেস জেলবন্দি কেষ্ট-র জন্যও বদলাননি মমতা। ৮ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে দলের বিশেষ অধিবেশনে মমতা বলেন, ''কেষ্ট যত দিন ফিরে না আসছে, লড়াই আরও তিনগুণ বাড়বে। বীরের সম্মান দিয়ে কেষ্টকে জেল থেকে বের করে আনতে হবে। এই মানসিকতা নিয়ে তৈরি থাকুন। বীরভূম জেলা হারতে শেখেনি, ওটা লাল মাটির রাস্তা, লাল মাটির দেশ। এটা সবসময় মাথায় রাখবেন।" 'বীর কেষ্ট' সম্পর্কে সম্প্রতি তৃণমূলের ছাত্র সমাবেশের মঞ্চেও 'পরোপকারী ছেলে' বলে মন্তব্য করেন মমতা।
আরও পড়ুন: কেষ্টর ‘বীরত্ব’ কেন জাহির করছেন মমতা? কতটা অপরিহার্য বীরভূমের বেতাজ বাদশা
কেষ্টকে আর পায় কে! জেলেই বিপুল দলীয় সর্মথন থুড়ি অক্সিজেনের জোগানে স্বাভাবিকভাবেই চনমনে কেষ্ট। প্রসঙ্গত, যতই একের পর এক অভিযোগ উঠেছে। কেষ্ট-র রাজনৈতিক বিচরণ ততই ব্যাপ্ত হয়েছে দিনের পর দিন। প্রত্যেক মুহূর্তে একের পর হুমকি, তোলা বাজি, বিরোধীদের আক্রমণ, কয়লা, পাথরের বেআইনি পাচার-সহ নানাবিধ অভিযোগ উঠলেও বীরভূমের বেতাজ বাদশাই বলেছেন শেষ কথা! যার কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন সময়ে-অসময়ে মমতা-স্তুতির কথা। বগটুই কাণ্ডে মমতার পাশে দাঁড়িয়েই কেস সাজানোর কথা বলেন কেষ্ট। অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরোধী হলেই গাঁজা কেস ফাঁসিয়ে দেওয়া নিয়ে। কিন্তু তিনি থেকেছেন অবিচল। দিদি মমতার স্পর্শে ভাই কেষ্ট থেকেছেন নিজের মেজাজেই! যদিও সময় ঘুরেছে, পরিবর্তন হয়েছে পরিস্থিতির। একটা সময় তীব্র দাপটশালী অনুব্রত মণ্ডল বারবার এড়িয়ে গিয়েছেন সিবিআই-ডাক। আদালতে গিয়েছেন। কখনও রক্ষাকবচ পেয়েছেন। আবার অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ণে।
কিন্তু রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার, তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যয়ের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পর আর 'সুবিধা' করতে পারেননি কেষ্ট। দশবার ডাকে ধরা দিতে হয়েছে তাঁকে। কেষ্ট-র দিদির প্রশংসার পরেও সিবিআই বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে তাঁকে। পার্থর মতো কেষ্ট-ইতিহাসে যবনিকা পতন হয়নি। 'নিঃসঙ্গ সম্রাট' পার্থ-র সারিতে কেষ্টর আগমন ঘটার আবহেই বদলে গিয়েছে সব। অনুব্রত-ইস্যুতে বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন তাঁর দিদি এবং তৃণমূল কংগ্রেস। সিবিআই-কে দুষে পার্থকে সরিয়ে অনুব্রত মণ্ডলের পাশে দাঁড়িয়েছেন মমতা। এখানেই বদলে গিয়েছে প্রেক্ষাপট। রাজনীতির সূক্ষ্ম পাতায় নতুন অধ্যায় সামনে এনেছেন কেষ্ট। কী ভাবে? বরাবর দুর্নীতি-অভিযোগের অস্বস্তির মধ্যেই পার্থর গ্রেফতারি আরও বেকায়দায় ফেলে তৃণমূলকে। সেখানে দাঁড়িয়ে জনমানসে কড়া অবস্থান প্রকাশ্যে আনতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় 'ঘনিষ্ঠ না হওয়া' পার্থকে সরিয়ে দেয় তাঁর প্রিয় দল। ক্রমশ নেতাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে একদা তৃণমূলের মহীরুহর সঙ্গে।
কিন্তু অনুব্রত-গ্রেফতারির পরে আর ধোপে টেকেনি অভিষেক-বার্তা। বরাবর মমতার কাছে ভাল থাকা সংগঠককে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বেকায়দায় ফেলেনি তৃণমূল। কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে যদি অনুব্রত মণ্ডল জেলে থাকেন, তাহলেও জেলাজুড়ে তাঁর যা সংগঠন এবং প্রভাব তা একই কাজ করবে, অর্থাৎ অনুব্রত স্বশরীরে থাকুন আর না থাকুন, তা সংগঠন এবং তৃণমূলের ভোটে জেতার ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা করবে না। মমতা খুব ভাল করেই জানেন, তৃণমূলের জন্মলগ্নের এই নেতা সংগঠক হিসেবে ঠিক কী কী করতে পারেন। সেখানে দাঁড়িয়ে কলকাতা নির্ভর পার্থ চট্টোপাধ্যায় ক্ষমতা আর পদ ছাড়া সংগঠনের জন্য মারাত্মক কিছু করতে পারেননি বলেই মনে করেন অনেকে। আর এই যুক্তিতেই অনুব্রতকে বরাবর সমর্থন দিয়ে এসেছে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। যেখানে দাঁড়িয়ে জেলবন্দি পার্থ এবং অনুব্রতর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, একের পর সম্পত্তির হদিশ, অনুব্রত মণ্ডলের একমাত্র কন্যা সুকন্যা মণ্ডলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি বিতর্ক, কোটি কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের তথ্য সামনে আসলেও প্রকাশ্যে অনুব্রত নিয়ে একই অবস্থান বজায় রেখেছে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় প্রত্যেক জনসভায় নিয়ম করে কেষ্ট-প্রসঙ্গ তুলে আনছেন। যেখানে দাঁড়িয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন তিনি, এমনও বলছেন কেউ কেউ। যেখানে, অনুব্রত-প্রসঙ্গ বজায় রেখে হঠাৎ আঘাতপ্রাপ্ত সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত এবং সমগ্র রাঢ়বঙ্গে তৃণমূলের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। দাবি, ঠিক এই পরিস্থিতির উপর নির্ভর করেই মমতা এবং তৃণমূল বারবার অক্সিজেন জোগান দিচ্ছে প্রিয় নেতা অনুব্রতকে। অনেকেই বলছেন, শুধুই সংগঠন আর দল নয়, দুর্নীতি ইস্যুতে একা অনুব্রতর পক্ষে এত অভিযোগের কারণ হওয়া সম্ভব নয়! সেখানে তিনি ফাঁসলে আরও কোনও রাঘব বোয়াল সামনে আসতে পারেন। ফাঁসতে পারে দলের কেউ! সেই পরিস্থিতে কেষ্ট-কে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতে পারে তৃণমূল।
এখানেই ফের চনমনে অনুব্রত মন্ডল। কারণ তিনি জানেন, যতই যা চলুক, দল বা দিদি তাঁর পাশেই। অর্থাৎ, অভিযুক্ত বা দোষী কোনও ক্ষেত্রেই যে তিনি বিচলিত নন, তা শুক্রবারের 'বডি ল্যাঙ্গুয়েজ'-এ বুঝিয়ে দিয়েছেন অনুব্রত। প্রথম দিকে সংবাদমাধ্যমে মুখ না খুললেও এখন প্রায়ই কথা বলছেন অনুব্রত। সকালে আদালতে যাওয়ার পথে জেলবন্দি অনুব্রত বলেন, ''দিদি পাশে আছে এটাই এনাফ!'' তারপরেই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক। তিনি বলেন, ''জেলে তো কেউ থাকে না, একদিন ছাড়া পাব!''
অনুব্রত-বয়ানের আবহেই মঙ্গলকোটে রাজনৈতিক হিংসার মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন তিনি। অনুব্রত মন্ডল-সহ ১৫ জন বেকসুর মুক্তি পান ৯ সেপ্টেম্বর। যে মামলায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন কেষ্ট। তথ্যপ্রমাণের অভাবে আদালতে এই ছাড় বলেই জানা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অনুব্রত না পার্থ কার পরিণতি সুদীপ্ত বা মদন মিত্রের মতো হবে, এমন জল্পনাও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেষ্ট-প্রশংসা এবং পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা জন্যই কি এই বাড়বাড়ন্ত। যদি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের পরে বারবার অস্বস্তিতে পড়ে দল, সেক্ষেত্রে সেই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আগেও ব্যবস্থা হয়নি কেন! কোন জাদুতে দলে বেঁচে গিয়েছেন অনাবৃত অনুব্রত!
তাহলে কি এতদিনের মতো অনুব্রত মন্ডলকে অন্য চোখে দেখেছে তৃণমূল। যাঁর সাত খুন মাফ হয়েছে নিমেষেই। যে ভুল বললে 'মাথায় কম অক্সিজেন'-এর তত্ত্ব সামনে আসলেও ভোটে জেতালে সেই তিনিই হন দক্ষ সংগঠক! বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেকেই বলেন, একজন দক্ষ সংগঠকের মাথায় যদি অক্সিজেন কম যায় তাহলে তাঁকে সরানো হয়নি কেন! সবটাই নাটক নয় তো! আসলে এখন জেলবন্দি অনুব্রতর পাশে নেত্রীর দাঁড়ানো সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। অনুব্রত আবহ এবং সিবিআই-গ্রেফতারির দোলাচলে বারবার কেষ্ট-র সঙ্গে মমতার সমর্থন থাকা, তৃণমূলের সহযোগিতা সেই প্রশ্নই তুলে দিচ্ছে। তাহলে কি একের পর এক অভিযোগের পরেও কেষ্ট-কে রাজনৈতিক অক্সিজেন জোগানোর কৌশল, আসলে দীর্ঘমেয়াদি কোনও রাজনৈতিক লাভের দিকেই ইঙ্গিত করে? যেখানে কি বীরভূমের মতো একদা শক্ত বাম ঘাঁটিতে ঘাসফুল ফোটানোর কারিগরের পাশে থেকে লাল মাটির দেশে লাল বা গেরুয়া উপস্থিতি খর্ব করতে চাইছে তৃণমূল। বিরোধী শক্তি যদি অনুব্রত-অনুপস্থিতিতে ফের মাথাচাড়া দেয়, তাহলে আখেরে অনুব্রত ফেরার পরেও অসুবিধায় পড়বে তৃণমূল, এই যুক্তিতেই কি সুকৌশলে কেষ্ট-র মাথায় শুধু নয়, কেষ্ট-র জেলবন্দি জীবনে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করছে তৃণমূল। এখানেই অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে তাঁর মন্ত্রিত্বহীন জীবনেও প্রভাবশালীর তত্ত্ব উঠে আসছে। অনুব্রত মন্ডলের সিবিআই-গণ্ডিতে বুমেরাং হবে কি না, মমতার প্রকাশ্যে পাশে দাঁড়ানো অনুব্রতকে আরও জড়িয়ে নিতে সিবিআইয়ে সুবিধে হবে কি না, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।