কেষ্টর 'বীরত্ব' কেন জাহির করছেন মমতা? কতটা অপরিহার্য বীরভূমের বেতাজ বাদশা

Anubrata Mondal: যেভাবে কেষ্টর বীরত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করলেন খোদ দলনেত্রী, তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কেন তাঁর প্রতি এত নরম দল?

আগেই কেষ্টর ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়নি দল। মিটিং করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, 'তোমার আসন শূন্য আজি...।' সেই আসন যে পূরণ করা হবে না, সেই বার্তাও দিয়েছিল দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁর বীরত্বের নমুনা আগেই দেখেছে দল, দেখেছে বীরভূম। পার্থর মতো বীরভূমের বেতাজ বাদশাকে ফেলতে না-পারার অনেক কারণ ছিল। তাই তাঁকে ঝেড়ে ফেলার সাহস দেখায়নি দল। এবার একেবারে তাঁকে বীরের তকমা! খোদ সুপ্রিমো জনালেন, বীরের সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে কেষ্টকে। নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকে এভাবে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডলকে নিয়ে সরব হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আদরের কেষ্টর পাশে আগেও দাঁড়িয়েছেন দিদি। তাঁকে বারবার সমর্থন করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এদিন যেভাবে কেষ্টর বীরত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করলেন খোদ দলনেত্রী, তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কেন তাঁর প্রতি এত নরম দল? 

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পর অনুব্রতর গ্রেফতারি তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে, তৃণমূলের 'কলঙ্কিত নায়ক’-এর তালিকায় দুই নম্বরে। পার্থর ডানা ছাঁটতে দল কোনওরকম রেয়াত করেনি, কিন্তু অনুব্রতর বেলায় জিরো টলারেন্স নীতি এখনও নেননি মমতা, অভিষেকরা। আসলে সামনে পঞ্চায়েত ভোট, তার ওপর বীরভূমে সংগঠন সামলাতে অনুব্রতর বিকল্প নেই বলেই কি তাঁর ডানা ছাঁটার সাহস দেখাল না দল? এদিন মমতা কীভাবে তাঁকে 'বীর’-এর সম্মান দেওয়ার কথা বললেন?

৮ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইনডোরে দলের পঞ্চায়েত সংক্রান্ত বিশেষ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে দিদি বুঝিয়ে দিলেন, কেষ্টকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। লোকসভা হোক কিংবা পঞ্চায়েত, কেষ্ট অপরিহার্য। কেষ্টকে জেলে আটকে রাখলেও বীরভূমের দুটো লোকসভা আসন কেউ দখল করতে পারবে না। সেই সঙ্গে বীরভূমের তৃণমূলকে নেত্রীর নির্দেশ— বীরের সম্মান দিয়ে কেষ্টকে জেল থেকে বের করে আনবেন।

আরও পড়ুন: কেষ্টর কতটা ডানা ছাঁটবে দল? বীরভূমের সিংহাসন থাকবে অনুব্রতর দখলেই?

পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর দায় নেয়নি দল। কিন্তু অনুব্রতকে সিবিআই ধরার পরেই দিদি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পার্থ আর অনুব্রত এক নন। তিনি তাঁর প্রিয় কেষ্টর পাশে রয়েছেন।

এদিন নেতাজি ইনডোরে মমতা বলেন, “ভাবছে কি জেলে বন্দি করে রেখে দু’টো লোকসভা সিট দখল করবে? সে গুড়ে বালি!” এরপরেই মমতা বলেন, “বীরভূম থেকে কারা এসেছেন? যতদিন কেষ্ট ফিরে না আসছে লড়াই তিনগুণ বাড়বে। বীরভূম শক্ত মাটি।”

তৃণমূল নেত্রী এদিন বোঝাতে চান, অনুব্রতকে অনেকদিন ধরেই টার্গেট করা হচ্ছিল। সেই ধারাবাহিকতাতেই প্রতি নির্বাচনে তাঁকে নজরবন্দি করে রাখা হতো। কিন্তু তাতে হাতি-ঘোড়া হয়ে যায়নি। বীরভূমে তৃণমূল থেকেছে নিরঙ্কুশ। কার্যত বিরোধীশূন্য। ঘটনা হলো, যতবার অনুব্রতকে ভোটের সময় নজরবন্দি করা হয়েছিল, ততবার হাসতে হাসতে তিনি বলতেন, ও এমনিই ভোট হয়ে যাবে। মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে নিলে কেষ্ট পান চিবোতে চিবোতে বলতেন, "ল্যান্ডফোন নাই নাকি?" দিদি যেন এদিন বুঝিয়ে দিলেন, অনুব্রতকে নজরবন্দি করে যেমন বীরভূমে তৃণমূলকে আটকানো যায়নি, তেমন ওঁকে জেলে আটকে রেখেও জোড়াফুলের জয়কে আটকানো যাবে না।

কেন অপরিহার্য কেষ্ট?
সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর এই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের একবার বাংলায় ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বিজেপি। এই অবস্থায় কোনও জায়গা ছাড়তে নারাজ তৃণমূল। তবে কি অনুব্রত মন্ডলের গ্রেফতারি সংগঠনে প্রভাব ফেলতে পারে, আর তা বুঝেই এহেন সিদ্ধান্ত? প্রশ্ন উঠছে।

একসময় বামেদের শক্ত ঘাঁটি ছিল এই বীরভূম। কিন্তু গত কয়েক বছরে তৃণমূল যেভাবে সংগঠন বিস্তার করেছে, তার নেপথ্যে যে অনুব্রত ছিলেন, সেকথা স্বীকার করে নেন দলের অনেক নেতাই। গরু পাচার মামলায় বোলপুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তৃণমূল নেতাকে। এদিকে আবার দল বলছে, দুর্নীতি কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।

এর আগে এখানে পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একাধিক আসন জিতিয়েছেন অনুব্রত। গত লোকসভা ভোটের আগে তাঁকে বলতে শোনা যায়, বীরভূমে সব আসনে না জিতলে দল ছাড়ব। এরপর দিদির ধমক খেয়ে সেই পথে পা বাড়াননি। এবার অনুব্রত-হারা বীরভূমে পঞ্চায়েতে যদি প্রভাব পড়ে, তাহলে তার জের গড়াবে লোকসভা ভোটে। কারণ সেই ভোটেরও আর বেশি দেরি নেই। দল ভালোই জানে, বীরভূমে সংগঠন তৈরিতে অনুব্রতর বিকল্প নেই, তাই তেতো পাচন খাওয়ার মতো কি তাঁকে হজম করতে হচ্ছে?

কেন দিদির প্রিয় কেষ্ট?
তিনি নাকি কোনও দিন মন্ত্রিত্ব চাননি। তিনি নাকি বড় কোনও দলীয় পদ চাননি। তাঁকে দিদির ডিফেন্ড করার পিছনে এটা বড় কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। এক্ষেত্রেও বালাই সেই পঞ্চায়েত আর লোকসভা ভোটের কড়া নাড়া।

তৃণমূল সূত্রের মতে, অনুব্রতকে না সরানোর সিদ্ধান্ত কৌশলগত। অনুব্রত মন্ডল গ্রেফতারের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা নিয়ে সরব হয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে দলের এক নেতার কথায় প্রকাশ, দিদি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, অনুব্রতর পাশে না দাঁড়ালে দলের অনেকেই হতাশ হয়ে পড়বেন। অনুব্রত ছিলেন দক্ষ সংগঠক। বীরভূমের জেলা সভাপতির পদে থেকে অতিরিক্ত কোনও পদ কখনও চাননি তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ঠিক, কিন্তু এও ঠিক, বীরভূমে তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে অনুব্রত জনপ্রিয়। সম্ভবত সেই কারণেই বীরভূমে জেলা সভাপতি পদে আপাতত কোনও বদল হবে না।

কেষ্টকে ডিফেন্ড করেন দলনেত্রী
পার্থর ক্ষেত্রে টাকার নির্লজ্জ প্রদর্শন দেখেছে রাজ্য। অনুব্রতর ক্ষেত্রে শোনা গেছে, কালো টাকার প্রাসাদ গড়েছেন তিনি। শোনা গেছে, দেখা যায়নি। তাই কি কেষ্টকে ডিফেন্ড করা সহজ হয়েছে দিদির পক্ষে?

পার্থর ক্ষেত্রে দল জিরো টলারেন্স নীতি নিলেও অনুব্রতর হয়ে ব্যাট করেন খোদ দলনেত্রী। বলেন, "অনুব্রতকে গ্রেফতার করলেন কেন? কী করেছিল কেষ্ট? কেষ্টকে জেলে আটকালে কী হবে? ওদের এজেন্সির কিছু লোক রয়েছে, তাঁদের টাকা দিয়ে পোষে। মাঝরাতে কেন সিবিআই বাড়িতে ঢুকছে? কেষ্টর বাড়িতে তাণ্ডব চালিয়েছে সিবিআই।"

জেলে যখন এই বার্তা পৌঁছবে যে, 'বীর’ কেষ্ট, তখন তিনি কি কিছুটা অক্সিজেন পাবেন না? তবে পার্থ যে মুষড়ে পড়বে, তা বলাই যায়। মোদ্দাকথা হলো, শহর উন্নততর তৃণমূলের বার্তা দিয়ে হোর্ডিংয়ে যেভাবে মুখ ঢেকেছে, এটা কি সেই ফরমুলা মেনে অভিষেকের কোনও পাশার চাল? পঞ্চায়েত এবং লোকসভার ঠেলা সামলাতে তাই কি বীরত্বের ঢাল দিয়ে কেষ্টকে আড়াল করা হচ্ছে?

More Articles