প্রচারের প্রলোভন সাহিত্যের জন্য মারাত্মক : মিলান কুন্দেরা

Milan Kundera Interview: খোমেনি, মাও, স্তালিন- এরা বাম নাকি ডান? সর্বগ্রাসীবাদ বামও নয়, ডানও নয়। এই সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যের মধ্যে দুই-ই ধ্বংস হয়ে যাবে।

১৯৮০-র দশক। মিলান কুন্দেরার বয়স তখন ৫৬। কুন্দেরা নিজের দেশ চেকোস্লোভাকিয়ার জন্য যা করেছেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ১৯৬০-এর দশকে ল্যাটিন আমেরিকার জন্য এবং আলেকজান্ডার সলঝেনিটসিন ১৯৭০-এর দশকে রাশিয়ার জন্য তাই করেছিলেন৷ কুন্দেরা পূর্ব ইউরোপকে পশ্চিমের পাঠকের নজরে এনেছেন কুন্দেরা। সত্যকে খুঁজেছেন। কুন্দেরার উপন্যাস, 'দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং এবং 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং' সংস্কৃতির মৃত্যুকে লিখে রেখেছে। ১৯৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সেই থাকতেন মিলান কুন্দেরা। প্রাগে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ছিল 'দ্য জোক'। 'দ্য জোক' ছিল কমিউনিজমের অধীনে জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অযৌক্তিকতার সমস্ত অভিযোগনামা। চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত আক্রমণের পর, মিলান কুন্দেরা প্রাগের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সিনেমাটোগ্রাফিক স্টাডিজের অধ্যাপকের পদটি হারান, তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়। নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয় তাঁকে। ওলগা কার্লাইলের নেওয়া মিলান কুন্দেরার এই সাক্ষাৎকারটি তাঁর জীবনের এক দলিল বলা যায়। পাঠকদের জন্য রইল সেই  কথোপকথনের এক অনুবাদ।

প্রায় ১০ বছর হতে চলল। ৪৬ বছর বয়স থেকে আপনি ফ্রান্সেই রয়েছেন। আপনার কী মনে হয় নিজেকে, একজন অভিবাসী, একজন ফরাসি, একজন চেক, নাকি কোনও নির্দিষ্ট জাতীয়তা ছাড়াই একজন সাধারণ ইউরোপিও মানুষ?

কুন্দেরা : ১৯৩০-এর দশকে যখন জার্মান বুদ্ধিজীবীরা নিজের দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাচ্ছিলেন, তাঁরা অন্তত একটা বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁরা একদিন না একদিন জার্মানিতে ঠিক ফিরে আসবেন। তাঁরা তাদের এই বিদেশে চলে যাওয়াটাকে 'সাময়িক' বলে মনে করতেন। আমার তো ফিরে আসার কোনও আশা নেই। ফ্রান্সে আমার থেকে যাওয়াটা চূড়ান্ত। তাই আমি অভিবাসী নই। ফ্রান্সই এখন আমার একমাত্র আসল দেশ।

আমাকে যে কোথাও থেকে উপড়ে এনে এখানে ফেলা হয়েছে এমনটাও আমার বোধ হয় না। ১০০০ বছর ধরে চেকোস্লোভাকিয়া পশ্চিমের অংশ ছিল। আজ, এটি পূর্ব দিকের সাম্রাজ্যের অংশ। আমি প্যারিসের চেয়ে প্রাগে থাকলে অনেক বেশি ছিন্নমূল অনুভব করব।

কিন্তু আপনি এখনও তো চেক ভাষাতেই লিখছেন?

কুন্দেরা : আমি আমার প্রবন্ধগুলি ফরাসি ভাষায় লিখি, কিন্তু আমার উপন্যাসগুলি চেক ভাষায়, কারণ আমার জীবনের অভিজ্ঞতা এবং আমার কল্পনা প্রাগের বোহেমিয়াতেই নোঙর ফেলে রয়েছে।

আপনার আগে মিলোস ফোরম্যান তাঁর 'দ্য ফায়ারম্যানস বল'-এর মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়াকে পাশ্চাত্যের জনসাধারণের কাছে পরিচিত করেছিলেন।

কুন্দেরা : একেবারেই! আমি প্রাগের 'আত্মা' বলতে যা ভাবি, তিনি তাই- তিনি এবং অন্যান্য চেক চলচ্চিত্র নির্মাতা যেমন ইভান পাসার এবং জান নেমেক। মিলোস যখন প্যারিসে আসেন সবাই অবাক, বিস্মিত! একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা এত মাটির মানুষ কীভাবে হতে পারেন? সম্ভব? প্যারিসে, যেখানে গ্যালারি লাফায়েটের একজন সেলসগার্লও স্বাভাবিক আচরণ করতে জানেন না, সেখানে ফোরম্যানের সারল্য সত্যিই ভাবায় বৈকি!

আপনার কাছে 'প্রাগের আত্মা' আসলে ঠিক কী?

কুন্দেরা : কাফকার 'দ্য ক্যাসেল' এবং জারোস্লাভ হাসকের 'দ্য গুড সোলজার শোইক' সেই চেতনায় পরিপূর্ণ। বাস্তবের এক অসাধারণ অনুভূতি। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। অনেক নিচু থেকে দেখা ইতিহাস। এক উত্তেজক সারল্য, অযৌক্তিক এক প্রতিভা, অসীম হতাশাবাদের সঙ্গে কৌতুকের সহাবস্থান।
ধরুন, একজন কেউ চেক দেশ ত্যাগের জন্য ভিসার অনুরোধ করল। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কোথায় যেতে চান?” লোকটা বলল, "তাতে কী এসে যায়?” তখন সেই লোকটাকে একটি গ্লোব দেওয়া হলো, বলা হলো, “বেছে নাও”। লোকটি গ্লোবের দিকে তাকাল, আস্তে আস্তে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, "অন্য গ্লোব নেই আর?”

প্রাগে আপনার শিকড় তো আছেই, এছাড়া আর অন্য কোনও সাহিত্য প্রেম কি আপনাকে ভাবিয়েছে?

কুন্দেরা : প্রথমত, ফরাসি ঔপন্যাসিক রাবেলাইস এবং ডিডেরট। আমার কাছে ফরাসি সাহিত্যের রাজা রাবেলাইস। ডিডরটের 'জ্যাকস লে ফ্যাটালিস্তে' রাবেলাইসের চেতনাকে ১৮ শতকে নিয়ে গিয়েছিল। ডিডেরট একজন দার্শনিক ছিলেন এই সত্যটা দ্বারা কিন্তু বিভ্রান্ত হবেন না। এই উপন্যাসকে দার্শনিক-আত্মিক আলোচনায় নামিয়ে আনা যায় না। এটা বিদ্রূপের নাটক। সর্বকালের সবচেয়ে মুক্ত উপন্যাস। স্বাধীনতা নিজেই যেন উপন্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি সম্প্রতি এটির একটি নাট্য রূপান্তর করেছি। ক্যামব্রিজ, সুসান সন্টাগ সেটা মঞ্চস্থ করে, 'জ্যাকস অ্যান্ড হিজ মাস্টার'।

আরও পড়ুন- ‘রসিকতা’ ও উত্তরাধিকার: এক ছিন্নমূলের ‘শো-অফ’

আপনার আর অন্য শিকড়?

কুন্দেরা : আমাদের শতাব্দীর মধ্য ইউরোপিয় উপন্যাস। কাফকা, রবার্ট মুসিল, হারম্যান ব্রোচ, উইটোল্ড গোমব্রোভিচ। আন্দ্রে ম্যালরাক্স যাকে 'লিরিক ইলিউশন' বলে অভিহিত করেছেন তার প্রতি আশ্চর্যজনকভাবে অবিশ্বাসী এই ঔপন্যাসিকরা। আমি তাদের দুঃখ ভাগ করে নিই। আবেগঘন দুঃখ নয়। বিদ্রূপাত্মক এক দুঃখ। আমার তৃতীয় শিকড় হচ্ছে, আধুনিক চেক কবিতা। আমার কাছে এটি কল্পনার এক দুর্দান্ত ঘরানা।

জারোস্লাভ সিফার্ট কি সেই আধুনিক কবিদের মধ্যেই একজন যারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেন? আপনার কী মনে হয়, তিনি কি ১৯৮৪ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলেন?

কুন্দেরা : হ্যাঁ, তিনি অবশ্যই অনুপ্রাণিত করেছেন। বলা হয়ে যে, তিনি প্রথম ১৯৬৮ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। কিন্তু বিচারকরাও বিচক্ষণ; তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন যে জারোস্লাভকে পুরস্কার দেওয়া হলে সদ্য দখল করা দেশের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হবে।

পুরস্কার দিতে অনেক দেরি হয়েছে। যে চেক জনগণকে অপমান করা হয়েছিল, তাঁদের জন্য তো ঢের দেরি। চেক কবিতার জন্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। সিফার্টের বয়স ৮৩, তাঁর জন্যও অনেক দেরি হয়ে গেছিল। সুইডিশ রাষ্ট্রদূত যখন সিফার্টকে সম্মানের কথা জানাতে হাসপাতালে তাঁর বিছানার কাছে এগিয়ে আসেন, সিফার্ট তাঁর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। শেষে একটাই কথা বলেছিলেন, "কিন্তু এত টাকা দিয়ে এখন কী করব?”

রাশিয়ান সাহিত্য সম্পর্কে কি মনে করেন? রাশিয়ান সাহিত্য কি আপনাকে এখনও ভাবায়? নাকি ১৯৬৮ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পর আপনার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে রাশিয়ান সাহিত্য?

কুন্দেরা : আমি তলস্তয়কে খুব পছন্দ করি। তিনি দস্তয়েভস্কির চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। তলস্তয়ই সম্ভবত প্রথম মানুষের আচরণের অযৌক্তিক ভূমিকা উপলব্ধি করেছিলেন। মূর্খতার ভূমিকা - কিন্তু বেশিরভাগই অবচেতন দ্বারা পরিচালিত মানুষের ক্রিয়াকলাপের দায়িত্বহীনত, অনিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রণহীন।

আনা কারেনিনার মৃত্যুর আগের অনুচ্ছেদগুলো আবার পড়ুন। কেন সে নিজে না চেয়েও আত্মহত্যা করল? কীভাবে তাঁর এই সিদ্ধান্তের জন্ম হলো? অযৌক্তিক এবং অধরা এই কারণগুলিকে বুঝতেই তলস্তয় আনার চেতনার প্রবাহের ছবি এঁকেছেন। সে একটি গাড়িতে আছে; রাস্তার ছবিগুলো তাঁর মাথায় মিশে যায় তাঁর অযৌক্তিক, খণ্ডিত চিন্তার সঙ্গে। অভ্যন্তরীণ একাকীত্বের প্রথম স্রষ্টা জয়েস নন, তলস্তয়। তবে ব্যাপারটা কমই স্বীকৃত কারণ তলস্তয়কে অত্যন্ত খারাপভাবে অনুবাদ করা হয়েছে। আমি একবার এই অনুচ্ছেদের একটি ফরাসি অনুবাদ পড়েছিলাম। অভিভূত হয়ে যাই। মূল বইটিতে অযৌক্তিক এবং খণ্ডিত তা ফরাসি অনুবাদে যৌক্তিক হয়ে ওঠে। যেন জয়েসের 'ইউলিসিস’-এর শেষ অধ্যায়টি আবার লেখা হয়েছে - মলি ব্লুমের দীর্ঘ মনোলগকে যৌক্তিক করা হয়েছে, প্রচলিত যতিচিহ্ন দেওয়া হয়েছে।

অনুবাদকরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাঁরা আমাদের পাঠ্যের নির্যাস, অস্বাভাবিকত্ব, অনুবাদ করার সাহস পান না। তাঁরা ভয় পান যে সমালোচকরা তাঁদের খারাপ অনুবাদের জন্য দায়ী করবেন। নিজেদের পিঠ বাঁচাতে, তাঁরা আমাদের লেখার বলি দেয়। আমার বইগুলির অনুবাদগুলি সংশোধন করতে আমি কতটা সময় এবং শক্তি যে ব্যয় করেছি আপনি ভাবতেও পারবেন না।

আপনি তো 'দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং'-এ আপনার বাবার সম্পর্কে কথা বলেছেন।

কুন্দেরা : আমার বাবা একজন পিয়ানোবাদক ছিলেন। আধুনিক সঙ্গীতের প্রতি টান ছিল - স্ট্রাভিনস্কি, বার্টোক, শোয়েনবার্গ, জানসেক শুনতেন। একজন শিল্পী হিসেবে লিওস জানাসেকের স্বীকৃতির জন্য তিনি খুব কঠিন লড়াই করেছিলেন। জনসেক একজন নজরকাড়া আধুনিক সুরকার, অতুলনীয়, তাঁকে কোনও খাপে ফেলা অসম্ভব। দস্তয়ভস্কির উপন্যাস অবলম্বনে কঠোর শ্রম শিবির সম্পর্কে তাঁর অপেরা, 'ফ্রম দ্য হাউস অব দ্য ডেড' কাফকার 'দ্য ট্রায়াল' বা পিকাসোর 'গুয়ের্নিকা'-র মতোই আমাদের শতাব্দীর এক মহান কাজ।

এই অপেরার কঠিন সঙ্গীত আমার বাবা কনসার্ট হলগুলিতে পরিবেশন করতেন। হলগুলি প্রায় খালিই ছিল। সেই বাচ্চা বয়সে আমি সেই সব জনগণকে মোটেই পছন্দ করতাম না যারা স্ট্র্যাভিনস্কি শুনত না, অথচ চাইকোভস্কি বা মোজার্টের প্রশংসা করত। আমি যে আধুনিক শিল্পের প্রতি আমার অনুরাগ ধরে রেখেছি; এটা বাবার প্রতি আমার বিশ্বস্ততা। কিন্তু আমি বাবার মতো সঙ্গীতকে পেশা করতে চাইনি। গান পছন্দ করতাম কিন্তু মিউজিশিয়ান পছন্দ করতাম না।

আমার স্ত্রী এবং আমি যখন চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে চলে যাই, তখন আমরা সঙ্গে করে খুব কমই বই নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। তাদের মধ্যে জন আপডাইকের 'দ্য সেন্টার' ছিল এমন একটি বই যা আমাকে গভীরে ছুঁয়েছিল - অপমানিত, পরাজিত বাবার জন্য এক বেদনাদায়ক ভালোবাসার কথা।

'দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এ আপনি আপনার বাবার স্মৃতিকে তামিনার গল্পের সঙ্গে মিলিয়েছেন, যিনি এমন একটি দ্বীপে থাকেন যেখানে শুধুমাত্র শিশুরা রয়েছে।

কুন্দেরা : এই গল্পটি একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের দৃশ্য যা আমাকে আচ্ছন্ন করে। ভাবুন তো, আপনার জীবনের বাকি দিনগুলি কোনও প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে আপনি আর কথা বলতে পারবেন না কেবল বাচ্চাদের সঙ্গেই থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই দুঃস্বপ্নের ছবিটা এলো কোত্থেকে? জানি না! আমি আমার স্বপ্ন বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করি না, বরং আমি সেগুলোকে গল্পে বদলে দিই।

আপনার বইয়ে শিশুরা এক অদ্ভুত জায়গা দখল করে আছে। 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং'-এ শিশুরা একটি কাকের উপর অত্যাচার করছে এবং টেরেজা হঠাৎ টমাসকে বলছে, "সন্তান না চাওয়ার জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।"

কুন্দেরা : ফ্রান্সে নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলেরই পোস্টার চোখে আসে, সর্বত্র একই স্লোগান! উন্নত ভবিষ্যত! সর্বত্র শিশুদের ছবি, শিশুরা হাসছে, দৌড়চ্ছে খেলছে। মুশকিল হচ্ছে, মানুষের ভবিষ্যৎ শৈশব নয়, বার্ধক্য। বার্ধক্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়েই সমাজের প্রকৃত মানবতাবাদ প্রকাশ পায়। কিন্তু বার্ধক্য, মানে আমাদের সেই একমাত্র ভবিষ্যত, প্রত্যেককে যার মুখোমুখি হতেই হবে, কোনও প্রচার পোস্টারে কখনই তা দেখানো হবে না। না বামে, না ডানে।

আরও পড়ুন- মহৎ সাজতে কোনও নির্বিষ লেখা লিখতে হয়নি কুন্দেরাকে

ডান এবং বাম বিষয়ে ঝগড়া হলে দেখছি এখন আর আপনি খুব উত্তেজিত হন না!

কুন্দেরা : যে বিপদটি আমাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে, তা হচ্ছে সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্য। খোমেনি, মাও, স্তালিন- এরা বাম নাকি ডান? সর্বগ্রাসীবাদ বামও নয়, ডানও নয়। এই সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যের মধ্যে দুই-ই ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি কখনই বিশ্বাসী ছিলাম না, কিন্তু স্ট্যালিনবাদী সন্ত্রাসের সময় চেক ক্যাথলিকদের নির্যাতন দেখার পর, আমি তাদের সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম বোধ করেছি। যা আমাদের আলাদা করেছে অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, তার সঙ্গে যা আমাদের বোধকে একত্রিত করেছে তার সম্পর্ক নেই। প্রাগে তারা সমাজতন্ত্রী ও পুরোহিতদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। এভাবে ফাঁসির মঞ্চেই ভ্রাতৃত্বের জন্ম হয়।

এই কারণেই বাম এবং ডানের মধ্যে একগুঁয়ে লড়াই আমার কাছে বেকার এবং বেশ প্রাদেশিক বলে মনে হয়। আমি রাজনৈতিক জীবনে ঢুকতেই ঘৃণা করি, যদিও রাজনীতি আমাকে মুগ্ধও করে।

কখনও কখনও বলা হয় যে, নিপীড়ন শিল্প ও সাহিত্যকে আরও গাম্ভীর্য ও প্রাণশক্তি দেয়...

কুন্দেরা : রোমান্টিক না হয়ে ভাবা যাক। নিপীড়ন দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি একটি সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে পারে। সংস্কৃতির প্রয়োজন জনজীবন, চিন্তার অবাধ আদান-প্রদান; প্রকাশনা, প্রদর্শনী, বিতর্ক এবং খোলা সীমানা। সংস্কৃতি খুব কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকতে পারে।

১৯৬৮ সালে রাশিয়ার আক্রমণের পরে, প্রায় সমস্ত চেক সাহিত্যই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও, ১৯৭০-এর দশকের চেক সাহিত্য দুর্দান্ত ছিল। হ্রাবাল, গ্রুসা, স্কভোরেকির গদ্য! অস্তিত্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়েই কিন্তু চেক সাহিত্য তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল।

ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে, সবাই জানে যে এই সময় একদিন না একদিন শেষ হবে। রাজনৈতিক নিপীড়ন আরেকটি বিপদ নিয়ে আসে, বিশেষত উপন্যাসের ক্ষেত্রে। সেন্সরশিপ এবং পুলিশের চেয়েও তা খারাপ। নৈতিকতার কথা বলছি। নিপীড়ন ভালো এবং মন্দের মধ্যে একটা খুব স্পষ্ট সীমানা তৈরি করে এবং লেখক সহজেই প্রচারের প্রলোভনে পড়েন। মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় মনে হলেও সাহিত্যের জন্য তা মারাত্মক।

হারমান ব্রোচ, আমার অত্যন্ত প্রিয় অস্ট্রিয়ান ঔপন্যাসিক। তিনি বলেছেন, "লেখকের একমাত্র নৈতিকতা হলো জ্ঞান।" লেখক হওয়া মানে সত্য প্রচার করা নয়; এর মানে সত্য আবিষ্কার করা।

আপনার মনে হয় না, যারা শান্তিতে আছে তাঁদের চাইতে নিপীড়নের শিকার যে সমাজ, সেই সমাজ একজন লেখককে অস্তিত্বের এক অজানা খণ্ড আবিষ্কার করার আরও বেশি সুযোগ দেয়?

কুন্দেরা : হয়তো। আপনি যদি মধ্য ইউরোপের কথা ভাবেন, ইতিহাসের কী অসাধারণ গবেষণাগার! ৬০ বছরের সময়কালে, আমরা একটি সাম্রাজ্যের পতন, ছোট ছোট জাতির পুনর্জন্ম, গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা সহ জার্মানের দখল, নির্বাসন সহ রাশিয়ার দখল, সমাজতন্ত্রের আশা, স্ট্যালিনবাদী সন্ত্রাস, দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছি। আমার ভেবেই অবাক লাগে, লোকজন কীভাবে এই পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে রেখেছিল!

মানুষ রহস্যময় হয়ে উঠেছে। সে নিজেই এক প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। আর সেই বিস্ময় থেকেই জন্ম নেয় উপন্যাস লেখার আবেগ।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন ১৯৫০ সালে, মহান ফরাসি কমিউনিস্ট কবি পল এলুয়ার্ড প্রকাশ্যে তাঁর বন্ধু, প্রাগ লেখক, জাভিস কালান্দ্রার ফাঁসি অনুমোদন করেছিলেন। যখন ব্রেজনেভ আফগানদের গণহত্যা করার জন্য ট্যাঙ্ক পাঠান, তখন এই ভয়ানক বিষয়টিকেও স্বাভাবিক বলা হয়। যখন একজন মহান কবি একটি মৃত্যুদণ্ডের প্রশংসা করেন, তখন সেই চরম আঘাত আমাদের বিশ্বকে খানখান করে দেয়।

অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ জীবনই কি আপনার উপন্যাসকে আত্মজীবনীমূলক করে তোলে?

কুন্দেরা : আমার উপন্যাসের কোনও চরিত্রই স্ব-প্রতিকৃতি নয়, আমার কোনও চরিত্রই কোনও জীবন্ত ব্যক্তির প্রতিকৃতি নয়। আমি ছদ্মবেশী আত্মজীবনী পছন্দ করি না। যে মানুষ অন্য কারও অন্তরঙ্গ জীবন প্রকাশ করে সে চাবুক মারার যোগ্য। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যখন ব্যক্তিগত জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কমিউনিস্ট দেশগুলিতে পুলিশ তা ধ্বংস করে, গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে সাংবাদিকরা এবং ধীরে ধীরে মানুষ নিজেরাই ব্যক্তিগত জীবনের স্বাদ এবং অনুভূতি হারিয়ে ফেলে।

প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞ; চিন্তা এবং শিল্পের পতন; আমলাতান্ত্রিকীকরণ, ব্যক্তিগত জীবনে সম্মানের অভাব- সব ঘটে গেছে। অথচ গোপনীয়তা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয় - প্রেম নয়, বন্ধুত্বও নয়।

 

অনুলিখন- মধুরিমা দত্ত

More Articles