রাষ্ট্রপতির কাছে সন্দেশখালির 'নকল' নির্যাতিতা, স্বীকারোক্তি খোদ রেখা পাত্রের!
Sandeshkhali Incident: সন্দেশখালির ঘটনার পরে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা নাকি সাজানো। আর এমনটা বলছেন সন্দেশখালির নির্যাতিতাদের মুখ তথা লোকসভা ভোটে বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র খোদ।
সন্দেশখালি। লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য-রাজনীতির সমস্ত সমীকরণ ঘেঁটে দেওয়া একটা ঘটনার নাম। কিন্তু ভোট যত এগোচ্ছে, ততই যেন একটা করে পর্দা উঠতে শুরু করে সন্দেশখালি মামলার উপর থেকে। কিছু দিন আগেই বিজেপির মণ্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়ালের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে সন্দেশখালির গোটা ঘটনা সাজানো বলে দাবি করেন সেই বিজেপি নেতা। আর তার পিছনে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারির হাত রয়েছে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। একটি স্টিং অপারেশনে ধরা পড়েছিল সেই তথ্য। সেই ভিডিওর রেশ ফিকে হতে না হতেই সামনে এল আরও একটি ভিডিও। সন্দেশখালির ঘটনার পরে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা নাকি সাজানো। আর এমনটা বলছেন সন্দেশখালির নির্যাতিতাদের মুখ তথা লোকসভা ভোটে বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র খোদ।
সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে যখন গোটা রাজ্য উত্তাল, সে সময় একদল নির্যাতিতা পৌঁছন রাইসিনা হিলে, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করতে। গত ১৫ মার্চ রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলেন মোট ১১ জন নির্যাতিতা। তার মধ্যে পাঁচ মহিলা ও ৬ জন পুরুষ ছিলেন। শাহজাহান এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদীর কাছে প্রতিকার চান ওই ১১ জন। রাষ্ট্রপতি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। এমনকি, দুঃখপ্রকাশও করেন। কিন্তু এতদিনে সামনে এল, রাষ্ট্রপতির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া সমস্ত মহিলাই নাকি সাজানো। তাদের সঙ্গে সন্দেশখালির প্রতিবাদীদের কোনও যোগই নেই। এমনই দাবি করা হয়েছে প্রকাশ্যে আসা ভিডিওতে। বুধবার রাতে প্রকাশ্যে আসা সেই ভিডিওয় দেখা গিয়েছে রেখা পাত্র-সহ তিন মহিলাকে। যেখানে এক মহিলাকে বলতে শোনা যায়, “আমরা সন্দেশখালি আন্দোলনে যুক্ত। আমরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাহলে আমাদের ছাড়া রাষ্ট্রপতি ম্যাডামের কাছে কারা গেল? আমরা তাহলে কারা?” এর পরই আরেক মহিলাকে বলেন, “শুনেছি অনুপ দাস নিয়ে গিয়েছিলেন। ভিতরে ভিতরে শিবুপ্রসাদ হাজরা ওরফে শিবু হাজরার থেকে মাসে-মাসে ১০ হাজার করে নিত। ওঁর সঙ্গে এক মহিলাও ছিলেন। তিনি কি তাহলে ভিতরে ভিতরে তৃণমূল করেন?” এর পরই বিজেপি প্রার্থী রেখাকে বলতে শোনা গিয়েছে,”আমরা নির্যাতিতারা সন্দেশখালিতে পড়ে আছি, তাহলে আমাদের হয়ে কারা গিয়েছে? তা জানা প্রয়োজন।” তাঁর আরও প্রশ্ন, “আর রাষ্ট্রপতি ম্যাডামের কাছে গিয়েছেন যে, আমাদের কিছু জানিয়েছিলেন? আমরা আন্দোলনের মুখ, আমাদের না নিয়ে গিয়ে অন্যদের সাজিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস কে দিয়েছে?” রেখা ছাড়া ওই ভিডিওতে একজনকে মাম্পি দাস বলে শনাক্ত করা গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের বাজারে এই ভিডিও সাড়া জাগানোর মতোই।
আরও পড়ুন: সন্দেশখালির ‘নির্যাতিতা’, অনভিজ্ঞ রেখা পাত্রই কেন মোদির বাজি বসিরহাটে?
একের পর এক এমন স্টিং ভিডিও হাতে আসায় তৃণমূল যেন হালে পানি পেয়েছে। একদিন আগেই সন্দেশখালি কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত শেখ শাহাজাহানকে মেয়ের সঙ্গে দেখা যায়। প্রিজন ভ্যানে উঠতে উঠতে শাহজাহান দাবি করেছিলেন, একদিন সব সত্য সামনে আসবে, সব প্রমাণ হয়ে যাবে। কী প্রমাণ হওয়ার কথা বলছিলেন শাহজাহান? সে সব সত্যই কি সামনে আসতে শুরু করেছে। অন্তত সেরকমটাই দাবি তৃণমূলের। সন্দেশখালির তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতো বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো। অর্থের বিনিময়ে এই আন্দোলন সংগঠিত করা হয়েছে। সন্দেশখালির মহিলাদের বাংলার বুকে, সারা ভারত এমনকী পৃথিবীর বুকে, তাঁদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল। বিজেপির মতো রাজনৈতিক দল গভীর ষড়যন্ত্র নোংরা রাজনীতি করেছে। এই নোংরা খেলায় মেতেছে এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত।”
বুধবার রাতের ভাইরাল ভিডিওর সত্যতা অবশ্য যাচাই করা যায়নি। কিছুদিন আগে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে ওঠা ভিডিওটিকে ডিপ ফেক বলে দাবি করেন শুভেন্দু অধিকারী। সেই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবার মেজাজ হারিয়েছেন বিরোধী নেতা। এমনকী ব্যবহার করে বসেছেন অশালীন শব্দও। আর তাতেই বিরোধীদের সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে শুভেন্দুর প্রতি। বুধবারের ভিডিওতে নকল নির্যাতিতা সাজিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে হাত রয়েছে বিজেপি নেতা অনুপ দাসের, এই তথ্য সামনে এসেছে ভিডিও থেকেই। এই অনুপ আবার শাহজাহান শেখের ‘ঘনিষ্ঠ’, অধুনা জেলবন্দি শিবপ্রসাদ হাজরা ওরফে শিবুর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে মাসোহারা নিতেন বলে ভিডিয়োয় অভিযোগ করেছেন মাম্পি। রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়া এক অভিযোগকারিণী ‘তৃণমূলের লোক’ কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রেখা-মাম্পিরা। ভাইরাল ভিডিয়োটিতে মাম্পি বলছেন, “খবর পেয়েছি যে অনুপ দাস নিয়ে গিয়েছেন। অনুপ দাস তো ভিতরে ভিতরে শিবু হাজরার কাছ থেকে মাস গেলে ১০ হাজার টাকা করে পয়সা নিত। খবর আছে ওঁর সঙ্গে পদ্মা মণ্ডলও গিয়েছেন। তা হলে কি এটা বুঝব যে, পদ্মা মণ্ডল টিএমসির লোক? উপরে উপরে বিজেপি করে?” বিজেপির একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, অনুপ এক সময় বিজেপি করলেও পরে তাঁকে দল থেকে ‘বার করে দেওয়া হয়’।
ইতিমধ্যেই এই ভিডিও প্রসঙ্গে মুখ খুলেছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “যে অনুপ দাসের কথা বলা হচ্ছে, তাঁকে আমি চিনি। উনি দীর্ঘ দিনের বিজেপি কর্মী।” সন্দেশখালির আন্দোলনে কোনও রাজনৈতিক দল ছিল না বলে দাবি করে শমীকের সংযোজন, “যাঁরা (ভিডিয়োয়) এই বক্তব্য রাখলেন, তাঁরা এই আন্দোলনের মধ্যে নতুন এসেছেন। রেখা পাত্রও নতুন এসেছেন। ছোট ছোট দ্বীপে মহিলারা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন করেছিলেন। এর মধ্যে কোনও বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম ছিল না। ভবিষ্যতেও এই আন্দোলন হবে।” বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা বর্ধমান দুর্গাপুরের পদ্মপ্রার্থী দিলীপ ঘোষ এই প্রসঙ্গে বলেন, “কে জানে যে, যাঁদের সামনে আনা হয়েছে, তাঁরাই নির্যাতিতা? যাঁরা প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না, তাঁরা কি নির্যাতিতা নন? তাঁরা রাষ্ট্রপতির সামনে মুখ খুলেছেন। এখানে খোলেননি। সন্দেশখালিতে পাড়ায় পাড়ায় নির্যাতিতা রয়েছেন।”
এ নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্য রাজনীতির আঙিনায় কোন্দল শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপিকে তোপ দেগে তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, “রাজ্য সরকার এবং তৃণমূলকে বদনাম করার জন্য সন্দেশখালির চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছিল। মহিলাদের সম্ভ্রমকে ভোট বৈতরণী পার করতে ব্যবহার করেছিল বিজেপি। সেই মুখোশ খুলে গিয়েছে। আরও বেআব্রু হচ্ছে।” সিপিএম অবশ্য বিজেপি এবং তৃণমূল কাউকেই ছাড়তে নারাজ। সন্দেশখালির প্রাক্তন বাম বিধায়ক তথা এ বারে বসিরহাটের প্রার্থী নিরাপদ সর্দার বলেন, “আন্দোলন বাস্তবসম্মত ছিল। ওখানে জমি লুট হয়েছে, ১০০ দিনের কাজের টাকা লুট হয়েছে। মা-বোনেরা এর প্রতিবাদ করলে তাঁদের উপরে অত্যাচার হয়েছে। তাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তৃণমূল আর বিজেপি মিলে এই আন্দোলনটাকে ভাঙল।”
এদিকে আবার এরই মধ্যে সন্দেশখালিতে ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা ছিল বলে দাবি করেছেন আর এক মহিলা। ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে আরও একটি ভিডিও। যেখানে তিনি জানান, তাঁকে দিয়ে জোর করে মিথ্যে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করানো হয়েছিল। তাঁকে না জানিয়ে সাদা কাগজে সই করানো হয়েছিল বলেও নালিশ। এক সপ্তাহ পর তিনি সবটা জানতে পারেন। ভিডিওয় মহিলা এ-ও জানান, পরে মামলা তুলতে চাইলে তাঁকে হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। তাঁর দাবি, এর নেপথ্যে ছিল মাম্পি দাস ও পিয়ালি দাস। যাদের একজনকে রেখা পাত্রের সঙ্গে দেখা গিয়েছে ওই ভিডিওটিতেও। পিয়ালি অবশ্য় সেই সমস্ত দাবিই অস্বীকার করেছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রেখা পাত্রের সঙ্গে থানায় গিয়ে উনি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। পরে হয়তো পারিপার্শ্বিক চাপে উনি মামলা তুলে নিতে চান। তুলেও নেন। সাদা কাগজে সই করানোর যে কথা হচ্ছে, তা মিথ্যে। থানায় তো সিসিটিভি আছে। সেটা দেখা হোক। শাসকদলের লোকেরা টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে মহিলাদের দিয়ে এ সব বলিয়ে ভিডিয়ো ভাইরাল করছে। এ সবের কোনও সত্যতা নেই। তদন্ত হোক। যদি দোষী প্রমাণিত হই, তা হলে আইন যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব। আর যদি তা না হয়, তা হলে কিন্তু আমি এদের নামে মানহানির মামলা করব।’’ মাম্পির বক্তব্য অবশ্য এখনও জানা যায়নি।
আরও পড়ুন: সন্দেশখালিতে সরব! কেন যৌনহেনস্থায় অভিযুক্ত রেভান্নার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিজেপি?
এর আগেই স্টিং ভিডিওয় বিজেপির মণ্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়ালকে বলতে শোনা গিয়েছিল, সন্দেশখালিতে টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের ‘মিথ্যে’ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। এমনকী বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রও ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন পুলিশের কাছে দু'হাজার টাকার বিনিময়ে। বিজেপি অবশ্য ওই ভিডিওতে বিকৃত বলেই দাবি করেছেন। তবে সন্দেশখালির মামলায় কার দাবি যে সত্যি, আর কারটা মিথ্যে, তা ক্রমশ গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ভোটের আগে যে সন্দেশখালিকে কেন্দ্র করে প্রবল অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল তৃণমূলকে, ভোট চলতে চলতেই সেই সব দান পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। মণ্ডল সভাপতির বিরুদ্ধে ওই স্টিং অপারেশন ভিডিওয় উঠে আসা প্রতিটি কথা সত্যি বলেই সিলমোহর দিয়েছে সন্দেশখালি কাণ্ডে ধৃত শেখ শাহজাহান। সত্যিই কি সন্দেশখালি নিয়ে উঠে আসা একের পর এক ভিডিও, দাবি-পাল্টা দাবি পাল্টে দিতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির পাশা। এর প্রভাব কতটা পড়তে চলেছে লোকসভা ভোটের ফলাফলে। বসিরহাট লোকসভায় ভোটগ্রহণ একেবারে শেষ দফায়। আগামী ১ জুন সেখানে ভোটগ্রহণ। যে রেখা পাত্রের উপর লোকসভা ভোটে এত ভরসা করেছিল বিজেপি, তা-ই ব্যাকফায়ার করবে না পদ্মশিবিরের জন্য? উত্তর মিলবে ৪ জুন।