এর নাম ভক্তি! নির্লজ্জ! অযোধ্যায় কেন নিজেদের মধ্যে লড়ছেন সাধুরা!
বিতর্কের নাম অযোধ্যা। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। এখনও দেশের কাছে ত্রাস সেইদিন। বাবরি মসজিদ ধ্বংস। বহুদিন ধরে দেশের অন্দরে বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিতর্কের চোরা স্রোত বইতে থাকে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়। বিতর্কের নিষ্পত্তি। অযোধ্যার বুকে তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। বারবার এই রাম জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। আর তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বিজেপি। একসময়ে লালকৃষ্ণ আদবানিরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার উত্তরাধিকার নিপুনভাবে বহন করছেন আজকে মোদি, যোগীরা। ফলে অযোধ্যায় রামমন্দির হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এই রাম জন্মভূমি সাক্ষী থাকল এক নির্লজ্জ ঘটনার। এর সঙ্গে বিজেপির যোগ নেই, যোগ নেই রাম মন্দিরের ঠিকই, তবে যোগ আছে সাধু সন্তদের। মন্দিরের আয়ের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে তাঁরা যে কাণ্ড ঘটাল তাতে লজ্জায় মুখ লোকাতে হচ্ছে দেশকে। কী ঘটল এদিন?
মন্দিরের অধিকার এবং আয়ের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদে জড়াল সাধুদের দুই গোষ্ঠী। বৃহস্পতিবার সকালে বোমাবাজি চলল রাম জন্মভূমি অযোধ্যায়। অযোধ্যা কোতায়ালি থানা জানিয়েছে, নরসিংহ মন্দিরে আয়ের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে গত ২ মাস ধরে পরিচালন সমিতির দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ চলছিল। বৃহস্পতিবার ভোরে সেই বিবাদের জেরেই সংঘর্ষ বাধে। তাতে জড়িয়ে পড়েন মন্দিরের মহন্ত, পুরোহিত এবং সাধুদের অনেকে। স্থানীয়দের একাংশ জানাচ্ছেন, ভোর ৪টে নাগাদ গোলমাল শুরু হওয়ার পর মন্দির চত্বর থেকে শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে। যা সম্ভবত বোমার।
এমনকী অশান্তির জেরে সাধুদের আটক করেছে পুলিস। (পুলিসের জালে সাধু! ভাবা যায়!) সার্কেল অফিসার রাজেশ তিওয়ারি জানান, মন্দিরের পরিচালন ক্ষমতা, আয়ের ভাগ বাঁটেয়ারা নিয়ে বিবাদ বাধে। অনেক দিন ধরে বিবাদ চলছিল। এদিন তা চরমে ওঠে। বিবাদমান দুই গোষ্ঠীর কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তবে বোমাবাজির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে পুলিস। তাদের দাবি, বোমা নয়, শক্তিশালী পটকা ফাটানো হয়েছে। এখনও কোনও এফআইআর দায়ের হয়নি। তবে ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। অযোধ্যায় তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। এবার সেখানেই মন্দিরে আয়ের ভাগ নিয়ে চরম বিবাদের সাক্ষী রইল সেই অযোধ্যা। স্বাভাবিকভাবে এই ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগেই নিজেদের ইস্তেহারে রামমন্দির তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শুরু হয়েছে সেই মন্দির নির্মাণের কাজ। সেই কাজ শেষ হতে ২০২৫। কিন্তু ২০২৪ সালে লোকসভা ভোটের আগেই পুন্যার্থীদের জন্য মন্দিরের একাংশ খুলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সেখানে তাঁর পুজোর্চনা সারতে পারবেন। এমনটাই জানিয়েছেন রামমন্দির ট্রাস্টের সাধারণ সচিব চম্পত রাই। এদিন তিনি জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে পুন্যার্থীদের জন্য রামমন্দিরের গর্ভগৃহ খুলে দেওয়া হবে।
বাবরি মসজিদ না রাম জন্মভূমি? ৪০টি শুনানির পর এই নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। পাঁচ বিচারপতির একটি বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে এই রায় দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের পাশাপাশি সেই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি এসএ বোবডে, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি অশোক ভূষণ, বিচারপতি এস আবদুল নাজির। ৪০ দিন শুনানি হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট এই রায় ঘোষণা করে। এই রায়ে বলা হয়েছে-
১. সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি রামলালাকে দিয়েছেন। সেখানেই তৈরি হবে রাম মন্দির।
২. সুপ্রিম কোর্ট উত্তরপ্রদেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারকে মুসলিমদের জন্য পাঁচ একর জমি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। সেখানেই তৈরি হবে মসজিদ।
৩. সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে তিন মাসের মধ্যে মন্দির গঠনের ট্রাস্ট প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছে। অযোধ্যার বিতর্কিত অঞ্চলে ছিল বাবরি মসজিদ। সেখানেই রাম মন্দির হবে।
৬. সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জানানো হয়েছে, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খননে মসজিদের আগে অন্য কোনও স্থাপত্যের প্রমাণ পেয়েছে। তবে সেখানে কোনও ইসলামিক স্থাপত্য ছিল না।
অযোধ্যার বুকে তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। এটা বিজেপির তুরুপের তাস। অনেকেই বলেন যোগী আদিত্যনাথের দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পিছনে রয়েছেন রামলালা। বিরোধী শিবির বলে, নতুন ভারত কাজ চায়। হিন্দুত্বে এই ভারতের মন ভিজবে না। তাই বারবার উন্নয়নের কথা বললেও আবার সেই রামলালাতেই আত্মসমর্পণ করে বিজেপি। অযোধ্যার কথা যখন উঠল, তখন প্রাসঙ্গিকভাবে আসে রামমন্দির নির্মাণ এবং বিজেপির হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রসঙ্গ। তবে মন্দিরে সাধু সন্তরা আজ যা করছেন করলেন, তার সঙ্গে বিজেপির রাজনীতির প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই ঠিকই, তবে এর সঙ্গে নাম জড়িয়ে আছে অযোধ্যার মতো একটা বহু আলোচিত পীঠস্থানের। আর সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, তাঁদের কাণ্ডকারখানা নিয়েও।
গীতায় আছে নিষ্কাম ধর্মের আদর্শ। এই দেশেই আছে শ্রীরামকৃষ্ণের কালী সাধনার সর্বত্যাগী আদর্শ। আর সাধু মানে তো যাঁরা পার্থিব সুখ দুঃখের ঊর্ধ্বে জীবনকে প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে থাকে না ,স্বার্থের বোঝাপড়া। কালে কালে কি এই চিরকালীন বিশ্বাসের ব্যতিক্রম ঘটছে? কেন আজ দেখতে হল মন্দিরের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে সাধু সন্তদের মধ্যে এমন নির্লজ্জ লড়াই?
স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক চিঠিতে লিখেছিলেন,
আমি গৃহস্থ বুঝি না, সন্ন্যাসীও বুঝি না, যথার্য সাধুতা, উদারতা এবং মহত্ম যেথায়, সেই জ্ঞানেই আমার মস্তক চিরকালই অবনত হউক- শান্তিঃ, শান্তিঃ, শান্তিঃ।
নিরাভরণ এই সাধুতা, উদারতার কাছেই তো চিরকাল মাথা নত করে এসেছে সমাজ। আজ কি এই সব আদর্শ চুলোয় দিয়ে এক স্বার্থান্বেষী সমাজব্যবস্থাকে লালন করার সময় এসেছে? যেখানে সাধুতার মধ্যেও স্বার্থের উৎকট গন্ধ!