মুক্তি পেয়ে যায় ধর্ষকরা, হিংসা-পাচারের অন্ধকারে কেমন আছে ভারতীয় মেয়েরা?
যেখানে এখনও রাতের রাস্তায় ধর্ষিতা হন নারী, গার্হস্থ হিংসাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয় আদালত- সেখানে ৭৫ বছরের আনন্দ উদযাপন কিছু অস্বস্তিকর অথচ জরুরি প্রশ্ন উসকে দেয় বটে।
‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’। দেশজুড়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর মহাসমারোহে পালন করছে মোদি সরকার। কিন্তু ৭৫ বছরের স্বাধীনতার অমৃতভাণ্ডে কি মিশে নেই একফোঁটাও গরল? ইতিহাস কিন্তু বলছে, এই উৎসবের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এক অন্য ভারত। যেখানে এখনও রাতের রাস্তায় ধর্ষিতা হন নারী, গার্হস্থ হিংসাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয় আদালত- সেখানে ৭৫ বছরের আনন্দ উদযাপন কিছু অস্বস্তিকর অথচ জরুরি প্রশ্ন উসকে দেয় বটে।
যেমন ধরুন, বিলকিস বানোর কথা। আমাদের গণস্মৃতি খুবই ক্ষীণ। একের পর এক নতুন ঘটনার আমদানিতে আমরা সহজেই ভুলে যাই অতীতের ঘটনা। কিন্তু ইতিহাস ভোলে না। ২০০২-এর ৩ মার্চ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জ্বলছে গুজরাত। নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পরিবারের লোকেদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন বছর উনিশের বিলকিস। বিলকিস তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সঙ্গে ছিলেন বিলকিসের পরিবারের ১৭ জন সদস্য ও বিলকিসের বছরদুয়েকের শিশুকন্যা। হঠাৎই একদল অস্ত্রধারী দুষ্কৃতী হামলা চালায় সম্পূর্ণ নিরস্ত্র পরিবারটির ওপর। বাধা দিতে গেলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গণধর্ষিতা হন বিলকিস। তার দু'বছরের শিশুকন্যা-সহ পরিবারের ১৪ জনকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। আক্রান্ত বিলকিস আইনের ওপর আস্থা রেখেই ছুটে গিয়েছিলেন স্থানীয় থানায়। থানার অফিসার অস্বীকার করেছিলেন বিলকিসের অভিযোগ নিতে। নিজের ওপর অন্যায়ের বিচারের আশায় বিলকিসকে ছুটতে হয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সুপ্রিম কোর্ট অবধি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তভার হাতে নিয়েছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে বম্বে হাইকোর্ট ১১ জন অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডর নির্দেশ দেয়। স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব'-এ সেই ১১ জন দোষীকে বেকসুর খালাস করে দিল গুজরাতের বিজেপি সরকার। এই প্রসঙ্গে গুজরাতের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব রাজ কুমার সরকারের সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, "দোষীরা ইতিমধ্যেই ১৪ বছর জেল খেটেছে। তাদের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে। তাদের অপরাধের ধরন, জেলে তাদের ব্যবহার, ইত্যাদি নানা বিষয় পর্যালোচনা করে সরকার স্বাধীনতার ৭৫ বছরে তাদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
মোদি জমানায় এমন ধর্ষণের ঘটনা ভারতে বিরল নয়। হাথরস থেকে উন্নাও, উঁচু জাতের পুরুষ দ্বারা নিচু জাতের মহিলাকে ধর্ষণ, ৭৫ বছরের ভারতে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গও। সেখানে পার্ক স্ট্রিটের মতো অভিজাত এলাকায় সুজেট জর্ডনের গণধর্ষণ নিয়ে স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বলেন ‘সাজানো ঘটনা’। ‘৭৫-এর স্বাধীনতায়’ এও আমাদের প্রাপ্তি। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৯-এ ২,৯৫০ জন, ২০২০-তে ২,৯৮৪ জন, ২০২১-এ ৩,৩২৭ জন এবং ২০২২-এর এপ্রিল অবধি ৮৬৮ জন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। সংখ্যাটা বছরের পর বছর ধীরে ধীরে বেড়েছে। আর খোদ রাজধানী দিল্লিতে প্রতিদিন ছ'টি ধর্ষণ এবং ন্যূনতম সাতটি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন: শিশুর তেষ্টা মেটানোর শাস্তি মৃত্যু! স্বাধীনতার ৭৫ ও লজ্জার দলিত ভারত
শুধু ধর্ষণ নয়, তালিকায় আছে গার্হস্থ হিংসা, নারী ও শিশুপাচারের মতো বিষয়ও। জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ সংক্রান্ত দপ্তর ২০১৮ সালেই জানিয়েছিল নারীদের জন্য বাইরে যেমন অপেক্ষা করছে বিপদ, ঠিক তেমনই নিজেদের ঘরেও নিরাপদ নন মেয়েরা। গোটা বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ জন নারী গার্হস্থ হিংসার শিকার হন। আর ভারতের ক্ষেত্রে ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে গার্হস্থ হিংসার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে ভারতের প্রায় ১০০ জন নারীর মধ্যে ১৮ জনই বিভিন্নভাবে পারিবারিক হিংসার শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এল করোনা। করোনার সংক্রমণ রুখতে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু এই লকডাউনে বাড়িতে থাকাকালীন পুরুষদের হাতে নিয়মিত অত্যাচারের শিকার হতে পারেন মহিলারা, সে-ব্যাপারে ভাবেননি ‘অমৃত মহোৎসব'-এর রূপকাররা। কিন্তু দীর্ঘ লকডাউনেই ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মেয়ে গার্হস্থ হিংসার কবলে পড়েছেন। ২৪ মার্চ ভারতে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে ভারতের মহিলা কমিশনের কাছে ইমেল মারফত ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ আসতে থাকে। বেশিরভাগ অভিযোগই এসেছিল উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাতের মতো রাজ্যগুলি থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লকডাউনে গৃহবন্দি স্বামী স্রেফ ‘কিছু করার নেই’ বলে স্ত্রীর ওপর অত্যাচারের রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন। যারা অভিযোগ জানাতে পেরেছিলেন, তারা বিচার পেলেও ভারতের প্রান্তিক শ্রেণির বেশিরভাগ মহিলাই সেই অত্যাচার সহ্য করেছিলেন এবং এখনও করছেন নীরবে। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবেনি রাষ্ট্র।
শুধু তাই নয়, নারী ও শিশু পাচারে ও পিছিয়ে নেই ভারত। ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো-র তথ্য বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে লাফিয়ে বেড়েছে মানব পাচার তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশুপাচার। নারী ও শিশুপাচারে প্রথমেই আছে পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থানের মতো রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সুন্দরবন ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত শিশু ও মহিলা পাচারের মতো ঘটনা ঘটে। নেপাল ও বাংলাদেশ থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের ভারতে পাচার করা হয়। পরে এদেরকেই বিভিন্ন বেশ্যালয়ে বাধ্যত যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিতে হয়। করোনা অতিমারীর সময় লকডাউনে এই নারী ও শিশুপাচার বহুগুণ বেড়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থার রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও বেশি নারী ও শিশু পাচার হয় আমাদের দেশে। কাজ দেওয়ার লোভ বা বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়েই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচার করা হয় এদের। লকডাউনের সময় আর্থিক দুর্দশা ঘোচাতে বহু প্রান্তিক পরিবারই মেয়েদের পাচার করে দিয়েছে। ২০২০-'২১ সালে পাচার হওয়া নারীদের মধ্যে তাই বেশিরভাগই নাবালিকা, স্কুল ড্রপআউট।
আইনের ফাঁক
নারীস্বাধীনতা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে যেমন আইন আছে, তেমনই আইনের ফাঁকও আছে। ভারতে ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে আইন ছিল, তার অবস্থা ছিল ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’-র মতোই। কিন্তু ২০১২-র দিল্লিতে নির্ভয়ার গণধর্ষণ ও মৃত্যু প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ভিত টলিয়ে দিয়েছিল। এক পাঁচ বছরের শিশুর গণধর্ষণ আরও জোরদার করে সেই ধাক্কা। শিশু ধর্ষণের ঘটনাকে সিলমোহর দিয়ে লাগু হয়েছিল নতুন আইন প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশে ধর্ষণ বা শিশু ধর্ষণের ঘটনা থানা অবধি পৌঁছয় না। আবার গার্হস্থ হিংসার ক্ষেত্রে ৪৯৮/এ দায়ের হয় না বেশিরভাগ গৃহহিংসার ক্ষেত্রে। কোনও ক্ষেত্রে থানা থেকেই উপযুক্ত প্রমাণের অভাবের কারণে ফিরিয়ে দেওয়া হয় অভিযোগকারিণীকে বা পরিবার ও নারীর মধ্যে মধ্যস্থতা করে পুলিশ। যেহেতু ভারতীয় আইনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হয় ‘beyond reasonable doubt’-এর শর্তে, তাই অভিযোগকারিণীকেই অভিযোগের প্রমাণ দিতে হয়। বহু ক্ষেত্রে অত্যাচারিত নারী চার দেওয়ালের মধ্যে হিংসা প্রমাণ করে উঠতেই পারে না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সুবিচার পায় নির্ভয়া, তেমনই একই অপরাধে দোষী হয়ে বেকসুর খালাস পান বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীরা। শাস্তি হয় না আসিফার ধর্ষণকারীদের, প্রভাবশালী তত্ত্ব খাটিয়ে ছাড়া পেয়ে যান কুলদীপ সিং সেঙ্গারের মতো ধর্ষণকারীরা।
ভারতে ঘরে-বাইরে দু'জায়গাতেই নারীকে স্বাধীনতার লড়াই লড়তে হয়। ‘স্বাধীনতার পঁচাত্তর'-এও তাঁর মুক্তি নেই।