বাংলাদেশ ভোট জালিয়াতি! কীভাবে টিকে ছিল দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন?

Bangladesh Vote Manipulation: বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যে প্রকাশ্যে ভোটচুরি ও জালিয়াতি করে পার পেয়ে গেল, যাবতীয় বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দিয়ে উড়িয়ে দিল, তার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক।

SA

বাংলাদেশ বিগত দেড় দশক ধরে যে স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রত্যক্ষ করেছে, যার বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে, তার পটভূমিতে রয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের এক দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য এই এক নিদারুণ করুণ ঘটনা, যে জনগোষ্ঠী ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে আসছে, তারা এখনও পর্যন্ত টানা দুটো সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। সাতচল্লিশ থেকে ইতিহাস টানি, বা একাত্তর থেকে ইতিহাস টানি, তবু এই করুণ সিদ্ধান্তে কোনো নড়াচড়া হবে না। যিনি বা যারা ক্ষমতায় যান, তারা যেন আর নামতে চান না, কোনোমতে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। রাজপথে রক্ত ঝরানো ব্যতীত ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীনকে নামানোই যেন এক বিরাট রাজনৈতিক সংগ্রাম, যদিও আধুনিক গণতন্ত্রে এটা খুব বেসিক বিষয় বলেই বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল। মনে হতে পারে, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচন-বিরোধী, বা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইতেন না; আদতে তা না। যিনি বা যে-দলই ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন, ‘জনগণ’-কে ব্যবহার করেই নিজেদের ক্রিয়াকর্ম বজায় রেখেছেন। এ-ক্ষেত্রে কেউ ‘নির্বাচন’ বিরোধী নয়। কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের বগলদাবা করতে হেন কোনো ক্রিয়াকর্ম নেই যা ক্ষমতাসীনদলসমূহ করেনি। উদ্দেশ্য একটাই, যেন আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেন। শেখ হাসিনার শাসনামলের নির্বাচনী ম্যাকানিজমকে বোঝার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক পটভূমি স্মরণে রাখা অতীব জরুরি।

১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের পর সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব ব্যবস্থা তৈরি করে : তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এটা ছিল একপ্রকারের শাসন ব্যবস্থা, যার অধীনে দুটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী কালে সাময়িকভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ কেবল নির্বাচন পরিচালনার জন্য দেশের শাসনভার গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু বেশিদিন সময় লাগেনি, বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগ সবাই যে যার  মতো করে, যে যখন ক্ষমতায় ছিলেন, এই ব্যবস্থাকে নিজেদের সুবিধে মতো ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। এমনভাবে সব গড়ার চেষ্টা করতেন, যেন সেখানে নিজের দলের লোকই বসে থাকেন। এটা বোঝা জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনে কখনও সরকারিদল ব্যতীত অন্য কেউ জয়ী হয়নি, অন্যদিকে, নিরপেক্ষ ব্যবস্থান অধীনে কখনও সরকারি দল নির্বাচনে জয়ী হয়নি। ফলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নষ্ট করতে সবাই সচেষ্ট ছিলেন। শুনতে কৌতুকময় হলেও আরেকটি ঘটনা মনে রাখা জরুরি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনে আওয়ামীলীগ ছিল তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে, বিএনপি যেহেতু সরকারি দল, তখন তারা এর বিপক্ষে ছিল। সে সময়ে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে লীগ যা যা বলত, তার সব কথার অনুরণন শোনা গিয়েছে বছর দুয়েক আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলনরত বিএনপি-র মুখে। আবার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিএনপি যা যা তখন বলতো, তা শোনা গিয়েছিল আওয়ামী লীগের মুখে। নব্বইয়ের দশক থেকে ক্ষমতায় থাকা সব সরকার যা চেষ্টা করেছিল, আওয়ামী লীগ সেটা সফলভাবে করে ফেলেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিল। বলা যায়, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু কর্তৃত্ববাদের পথে যাত্রা; দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসন।

আরও পড়ুন-বিশ্বজুড়ে ভোট কারচুপি! গণতন্ত্র টিকবে?

আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এই ব্যবস্থা ‘গণতান্ত্রিক চেতনার’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাৎযাত্রা নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা এই তত্ত্ববধায়ক সরকার বাতিলের ঘটনাকে সেই ‘মূহুর্ত’ হিসেবে চিহ্নিতি করেছেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটতে থাকে, এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঘটতে থাকে। এই ঘটনার পর আর কারও বুঝতে বাকি ছিল না যে, নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল বিরোধী মতের দমন-পীড়ন। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলো বুঝে নিয়েছিল, পুরো ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করে ফেলা হয়েছে, সেখানে আওয়ামীলীগই জিতবে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছেন, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা প্রথমেই খেলার রীতি পালটে দিয়ে জয় সুনিশ্চিত করার পর নির্বাচন আয়োজন করে। কিন্তু আধুনিক জমানাতে লোকদেখানো হলেও নির্বাচন করতে হয়, নিজেদের ‘বৈধতা’র জানান দিতে হয়। ফলে, এই নির্বাচনে প্রায় সকল বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে। মোট ৩০০ আসনের অর্ধেকেরও বেশি আসনে (১৫৩) কোনো ধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি প্রথমে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে নির্বাচনে যোগ দেন। এই ঘটনার পেছনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং-এর হাত আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এই বিষয়ে কিছু কথা একেবারে শেষে বলা হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম; সরকার অনেক কষ্টেসৃষ্টে বাড়িয়ে দেখানোর পরও সেটা ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। কার্যত সেই নির্বাচনের পর বাংলাদেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়ে যায়।

জুলাই অভ্যুত্থান

আওয়ামী লীগ আমলের দ্বিতীয় নির্বাচন হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু ততদিনে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গায়েবি মামলা, নির্যাতন- মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটাকে বিশ্লেষকরা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ বলে রায় দিয়ে দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এই শিরোনামে এক ভয়াবহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়। এই পরিস্থিতিতে আবারও দলীয় অধীনেই নির্বাচন আয়োজন করা হয়। সবাই জানতো এইবারও ফলাফল কী হবে, তবু নাগরিক সমাজের কিছু অংশের সমর্থনে, জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট তৈরি করে বিরোধী দলসমূহ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এই নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘রাতের ভোট’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্যাটায়ার করে লোকে বলে ‘লাইলাতুল ইলেকশন’। এটা বলার কারণ হচ্ছে, নির্বাচনের আগের রাতেই প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা সুপরিকল্পিতভাবে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে প্রশাসনের টপ টু বটম সবার অংশগ্রহণে এত বড় কারচুপি হয়েছে কিনা জানা নেই। বলা হয়ে থাকে যে, সরকার সমর্থিত মসজিদের ইমাম থেকে জেলা প্রশাসক সবাই জড়িয়ে পড়েছিলেন এই ভোটচুরিতে। সকালবেলা ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পরপরই বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। ভোটকেন্দ্রগুলোর দরজা বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ ভোটারদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় এবং আওয়ামী লীগের কর্মীরা নিজেরাই ব্যালটে জাল ভোট দেয়। ডেইলি স্টারের প্রতিনিধিরা ঢাকার ২৫০ টি ভোটকেন্দ্র এবং ঢাকার বাইরে ৩৫০টি কেন্দ্রের ভোট পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন, প্রতিটি কেন্দ্রেই তাঁরা অনিয়মের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভোট প্রদানের প্রকাশ্য প্রমাণ পান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ৫০টি সংসদীয় আসনে জরিপ চালিয়ে কমপক্ষে ৪৭ টি সংসদীয় আসনে ভোটচুরি-সহ নানাবিধ অনিয়ম খুঁজে পান। এর মধ্যে কমপক্ষে ২০টি আসনে আগেই ভোট শুরুর আগেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়, কমপক্ষে ৩৩টি আসনে রাতে ভোট দেওয়া হয়, কমপক্ষে ৩০টি আসনে ভোটের দিনে কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া হয়। অধিকাংশ আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন ভোটচুরিতে সহায়তা করে। কিছু কিছু কেন্দ্রে শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি ভোট গণনা করা হয়। কীভাবে শতভাগ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে হাস্যরসাত্মক সব গল্প চালু হয়েছিল বাজারে। যেমন, একজন জানিয়েছিলেন, এক নেতা ভোট দিতে হাজির হয়ে দেখেছিলেন, তার অতি-উৎসাহী কর্মীরা তাঁর ভোটও দিয়ে দিয়েছেন। ‘লাইলাতুল ইলেকশন’-এর এই নির্বাচনে প্রায় শতকরা ৯৬ ভাগ ভোট দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের ২৮৮ আসনের বিপরীতে মাত্র ৬টি আসনে বিরোধী দল বিএনপি জিততে পারে।

উল্লেখ্য, এই নির্বাচনের আগের তিন সপ্তাহে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে ৩ লক্ষ রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল, ৮২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে সময়ে ঐক্য ফ্রন্টের শতকরা ৬১ ভাগ প্রার্থীর নামে রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় আসে ২০২৪ সালের নির্বাচন। বাংলাদেশে আর গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রা নয়, বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ দোআঁশলা রেজিম বলছেন, কেউ বলছেন স্বৈরাচারী। দেশের ভেতরে বলা হচ্ছে একে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই নির্বাচনের কিছুদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলেও সেটা ব্যর্থ হয়। এই নির্বাচন সর্বোতভাবে সকল রাজনৈতিক দল বয়কট করে। ২০১৮ সালের অভিজ্ঞতায় এই ব্যবস্থার অধীন আর কেউ নির্বাচনমুখী হতে রাজি হয়নি। বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ-সহ সকল বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে এবং বয়কট করার জন্য নাগরিকদের মধ্যে ক্যাম্পেইনও চালায়। ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের পর আওয়ামীলীগ ভোটচুরির নতুন কৌশল হাতে নেয়। যেহেতু, কোনো বিরোধী দল নেই, আবার লীগের উপর নির্বাচনে বিরোধী দল আছে ও নির্বাচন সুষ্ঠু, আন্তর্জাতিক মহলে সেটা দেখানোর একটা চাপও ছিল, সেহেতু তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। নিজেদের দলের কাউকে প্রার্থী দিয়েছে, আবার আরেক প্রার্থীকে বিরোধীদল আকারে দাঁড় করিয়েছে। দেখা গিয়েছে, একই আসনে পাঁচ/ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামীলীগের। এই যে ডামি প্রার্থী বা নিজের দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তৈরি করে প্রতিদ্বন্দ্বীতার একটি ভুয়া আবহ তৈরি করেছিল, সেহেতু এই নির্বাচনকে বিশ্লেষকরা ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

নির্বাচন বয়কটের ক্যাম্পেইন জনপ্রিয় হওয়াতে আওয়ামীলীগ আরেকটা পদক্ষেপ নিয়েছিল। ভোট না দিতে আসলে বয়স্ক ভাতার মতো সুবিধাবঞ্চিতদের প্রাপ্য ভাতাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। তাতেও লাভ হয়নি। ভোটের দিনে সাধারণ ভোটাররা ভোট বর্জন করে, সারাদেশ জুড়েই ভোট কেন্দ্রগুলো থাকে ফাঁকা। ভোটার সংকট কাটাতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে এসে ভোট দেওয়ানো হয়। ভোট শুরু হবার পর থেকে শেষ পর্যন্ত ভুয়া ও জালভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়। ভোটচুরি এত প্রকাশ্য ও প্রবল হয়ে ওঠে যে, খোদ ডামি প্রার্থীরাই তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ভোটারের হার ছিল সর্বনিম্ন। নির্বাচন কমিশন হিমশিম খায় ভোটার হার বাড়াতে। আন্তর্জাতিক অধিকাংশ গণমাধ্যম এই নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে।

২০২৪ সালের নির্বাচনের মাস সাত/আটেক পরেই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করলে কী হয় তার উজ্জ্বল নজির হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপ্রবাহ। বাংলাদেশে যে সংস্কার ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বদলের এক বিরাট শ্লোগান উঠেছে, সেটাও এই ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা-জাত। তবে, হাসিনার শাসনামলের এই তিন ‘জালিয়াতিপূর্ণ’ নির্বাচন এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাদযাত্রায় ভারতের ভূমিকা উল্লেখ না করলে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এটা উল্লেখ করা এই কারণেও জরুরি যে, পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে কেন দিল্লি আশ্রয় দিচ্ছে এবং ‘গণতান্ত্রিক’ ভারত রাষ্ট্রের সরকারি ও বিরোধীমহল কেন একজন পতিত স্বৈরাচারকে বন্ধুর খেতাব দিচ্ছে- এই দুই সওয়ালের জবাব পাওয়া যাবে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র গায়েব হওয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ইতিহাসের মধ্যে। ভারত-বাংলাদেশের অসম চুক্তি ও সম্পর্কের কথা আমরা সবাই বারেবারে বললেও হাসিনা ও লীগের সঙ্গে তাদের সখ্যতা আরও গভীর। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনতে ভারত যে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল সেটা প্রণব মুখার্জির ভাষ্য থেকে জানা যায়। তখনকার সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদ উদ্বিগ্ন ছিলেন, হাসিনা মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে বরখাস্ত করবেন কিনা। প্রণব মুখার্জি, তাঁর আত্মজীবনীতে জানাচ্ছেন, নিজেই দায়িত্ব দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, হাসিনা ক্ষমতায় গেলে তিনিও টিকে থাকবেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগকে আমলে নিয়ে ভারতকেন্দ্রিক বিদ্রোহী দলগুলিকে ভেঙ্গে দিয়েছিল, বিদ্রোহী ও আঞ্চলিক ‘সন্ত্রাসী’ দলের সদস্যদের ভারতের কাছে হস্তান্তরও করেছিল। উলফার বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এটা ঘটেছিল, যখন ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।

২০১৪ সালের নির্বাচন যখন বিরোধীদলগুলো বর্জনের হুমকি দেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দেয়, যদিও ততদিন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছিল তারা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়েছিল, তারা যেন ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের বোঝাপড়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভাল হবে। আওয়ামীলীগ যখন বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন আয়োজন অব্যাহত রাখে, তখন ভারত তাতে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তখন বাংলাদেশ সফর করে জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরশাদের দল তখন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সুজাতা সিং-এর বৈঠকের পর এরশাদ মত বদলান। এরশাদ বৈঠক শেষে ঘোষণা দেন, ‘ওঁরা বলেছেন, নির্বাচন করুন। আমি নির্বাচন না করলে নাকি জামায়াত-শিবিরের মতো মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসবে।’ এরশাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই নির্বাচনে বিরোধী দল আছে, তা দেখানোর সুযোগ পেয়ে যায় আওয়ামীলীগ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারা আরও একটু বদলে যেতে থাকে এই নির্বাচনের মাধ্যমে।

এরপর ভারতে ক্ষমতায় এলেন মোদি। দিল্লির মসনদে কংগ্রেসের স্থলে বিজেপি এলেও মসনদের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও লীগের সম্পর্ক আগের মতোই থাকে। বরঞ্চ আরও বেশি অসাম্য তৈরি হয় দুই দেশের মধ্যে। ২০১৬ সালে একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিল, দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক মালিক-খদ্দেরের সম্পর্কে পর্যবসিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর যেমন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তেমন। বেশি তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না; বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি ও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের তেলচিটচিটে প্রেমময় বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ধরন আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা যখন বাংলাদেশীদের নিয়ে ডিহিউম্যানাজিং বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন প্রতিক্রিয়া দেখানো দূরে থাক, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বলে অভিহিত করেছিলেন। বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো খোলামেলা স্বীকার করেই ফেলেছিলেন, যে কোনো মূল্যে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার অনুরোধ নাকি তিনি ভারতের কাছে করেছেন।

আরও পড়ুন- ভারতে কি জনগণের ভোটে সরকার গড়া হয়?

২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে যখন ওয়াশিংটন বারেবারে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছিল, তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। গত বছরের ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ভারত নাকি তখন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত গণতন্ত্র নিয়ে বেশি কথাবার্তা না বলা। কারণ, তাতে নাকি ইসলামপন্থীদের উর্বরজমিন হয়ে উঠবে বাংলাদেশ, এবং ভারতের জন্য তা হুমকিস্বরূপ। এরপর তো আমরা দেখেছি, ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে লীগের নেতারা খোলামেলা স্বীকার করছেন, তলে তলে চুক্তি হয়ে গেছে, বিএনপি যখন নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করছিল, তখন ভারত পাশে দাঁড়িয়েছে। এমনকি একজন প্রার্থী তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন, আমি হাসিনার প্রার্থী। আমি ভারতের প্রার্থী।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যে প্রকাশ্যে ভোটচুরি ও জালিয়াতি করে পার পেয়ে গেল, যাবতীয় বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দিয়ে উড়িয়ে দিল, তার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক, এবং আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে ভারতের সহযোগিতা। ভোটচুরির পাশাপাশি আরেকটি ঘটনা বলে এই আলাপের ইতি টানা যেতে পারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০১৪ সালে যখন এরশাদকে রাজি করানো হচ্ছে, বা ২০২৪ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, ভারত বারেবারে সবাইকে ইসলামপন্থীদের ভয়/জুজু দেখিয়েছে। অর্থাৎ, সহজ কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র থাকে তাহলে মৌলবাদীরা ক্ষমতায় চলে আসবে, ফলে এই জুজুকে রুখতে হলে হাসিনার মতো স্বৈরাচারকে সমর্থন করতে হবে। ভারত ও আওয়ামী লীগের এই নীতি বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের জন্য মারাত্মক অপমানজনক ছিল। বাংলাদেশের নাগরিকমাত্রই তাঁদের কাছে ‘মৌলবাদী’, গণতন্ত্রের জন্য ‘আনফিট’। ফলে, গণতন্ত্রের চেয়ে তাঁদের কাছে ‘মৌলবাদ’ দমানো বেশি জরুরি কাজ হয়ে পড়েছিল। ফলে দেখা যায়, হাসিনার পতনের পর ভারতের মিডিয়া, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং পতিত স্বৈরাচার- সবাই সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নিয়ে যে বিষাক্ত প্রপাগান্ডামূলক রাজনীতিতে নেমে পড়লেন, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে ‘মৌলবাদী’ ঠাহর করা এবং গণতন্ত্রের জন্য ‘আনফিট’ বিবেচনা করা।

গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ কয়েক দশক যাবত ধারাবাহিক সংগ্রাম করে যাওয়া এই ভূখণ্ডের বাসিন্দারা এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। যে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতাহস্তান্তরের টানাপোড়েন থেকে এত রক্ত ঝরাতে হচ্ছে, সেটাকে ঠিকঠাক করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলার দিকেই সবাই চেয়ে আছেন। অভ্যুত্থানের এক বছরের পর অনেক দুর্দশা জন্ম নিলেও, এটা সত্যি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক সমাজ কনসেনসাসের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্কটগুলি সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যে আমূল সংস্কারের দাবি উঠেছে, সেটাকে এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নিরিখে না বুঝলে এই জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক কর্মতৎপরতাকে ঠাহর করা যাবে না।

More Articles