বাংলার প্রাচীন চালচিত্র শিল্পকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন খয়রাশোলের মৃৎশিল্পী সুভাষ সূত্রধর
Chalchitra art Bengal: চালচিত্র নির্মাণে তিনি ব্যবহার করেন গুঁড়ো রঙ। চালচিত্রের পাশাপাশি দুর্গা প্রতিমাও তৈরি করেন তিনি। যে সব বনেদি বাড়ির চালচিত্র করেন, তাদের প্রতিমাও তিনি নিজে নির্মাণ করেন।
কদমতলায় শ্রীকৃষ্ণ-রাধিকা। তার ঠিক পাশেই ব্রহ্মা। ব্রহ্মাণ্ডের রচয়িতা ব্রহ্মা মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছেন দেবাদিদেব মহাদেবের দিকে, আর সেই দৃশ্যে রয়েছে নন্দী ও ভৃঙ্গী। বাংলার চালচিত্র শিল্পে পৌরাণিক দেবতারা এভাবেই লোকজ রূপে প্রস্ফুটিত হয়েছেন।
আধুনিক সময়ে চালচিত্র নির্মাণ ক্রমশ অবনবনের দিকে এগোচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও বীরভূম জেলার খয়রাশোলের ৬২ বছর বয়সী মৃৎশিল্পী সুভাষ সূত্রধর এই শিল্পকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে প্রতিমা নির্মাণের পাশাপাশি তিনি চালচিত্র আঁকছেন। তাঁর তুলির টানে মা দুর্গার চালিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে পৌরাণিক দেবতারা। সেখানে যেমন আছে শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক, তেমনি আছে ত্রিশূলহীন হাতে রুদ্রবীণা নিয়ে বসে থাকা মহাদেব।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চালচিত্র নির্মাণ করেছেন— বোলপুরের সুরুল রাজবাড়ীর বড় ও ছোট তরফের শতাব্দী প্রাচীন দুর্গাপুজো, একই অঞ্চলের বামাপদ পালের বাড়ির আশি বছরেরও বেশি পুরনো পুজো, এছাড়াও সিউড়ি ও রামপুরহাটের বনেদি বাড়ির পুজোর চালচিত্র।

সুভাষ সূত্রধর
চালচিত্র নির্মাণে তিনি ব্যবহার করেন গুঁড়ো রঙ। চালচিত্রের পাশাপাশি দুর্গা প্রতিমাও তৈরি করেন তিনি। যে সব বনেদি বাড়ির চালচিত্র করেন, তাদের প্রতিমাও তিনি নিজে নির্মাণ করেন। সাধারণত কাঠামোর প্রতিমার মুখ অনেক শিল্পী ছাঁচ দিয়ে বানালেও সুভাষ সূত্রধর মুখ গড়েন হাতে, ছাঁচ ব্যবহার করেন না।
তাঁর চালচিত্রে স্পষ্ট বাঙালিয়ানার ছাপ। রাম, লক্ষণ, সীতা, কালী, দুর্গা, বিষ্ণু, নারদ, জয়া-বিজয়া কিংবা অসুর—সব চরিত্রের অভিব্যক্তিতে ধরা পড়ে নমনীয় মরমী মনোভাব। তাঁর তুলির সরু টানে সহজিয়া লোকায়ত রূপ ফুটে ওঠে। ফর্সা স্থূল শিব রুদ্রবীণা বাজাচ্ছেন, সাদা দাড়ি গোঁফহীন স্থূল ব্রহ্মার মুখে শান্ত ভাব। দুর্গা বা সীতার শাড়ি পরার ভঙ্গিমায়ও দেখা যায় সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণির নারীদের শৈলী। সবুজ বর্ণের রামচন্দ্রকে তিনি এঁকেছেন হাঁটু পর্যন্ত কুর্তা-পাজামা পরা জমিদারের রূপে, যেখানে কুর্তার ওপর সুন্দর নকশাও করেছেন শিল্পী।
আরও পড়ুন- কেবল রথের মেলাতেই কেন পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদের এই মাটির পুতুল?
দ্বিমাত্রিক চালচিত্রে আরও প্রাণ সঞ্চার করতে তিনি গোটা ছবিজুড়ে আঁকেন ছোট সাদা ফুল। তাঁর কথায়, প্রথমে কাঠে মার্কিন কাপড় লাগিয়ে মাটি লাগানো হয়, তারপর খড়িমাটি দিয়ে তৈরি হয় সাদা ভিত্তি। এর ওপর রঙের কাজ শুরু হয়। নীল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর একে একে ফুটে ওঠে দেবমূর্তির ছবি। প্রতিটি মূর্তি চওড়া আকারের, যাতে পুরো চালচিত্র ভরাট হয়ে ওঠে। মুকুট ও গয়না আঁকার সময় ব্যবহার করেন খড়িমাটি রঙ। টেপারি ফল দিয়ে তৈরি হয় পুষ্পবৃষ্টির দৃশ্য—খড়িমাটি মিশিয়ে তার ছাপ ছড়িয়ে দেন পুরো চালচিত্রে। তাঁর ব্যাখ্যা, মহিষাসুর বধের পর দেবতারা স্বর্গ থেকে মা দুর্গার ওপর পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন, সেই ভাবনাই এখানে রূপ পেয়েছে।

চালচিত্রে যেমন রামের রাজ্যাভিষেক উঠে এসেছে, যেখানে সস্ত্রীক রাজা রামের মাথায় ছত্র ধরে আছেন তাঁর দুই ভাই, সীতার মুখে স্পষ্ট লাজুক বাঙালি রমনীর ভাব, তেমনি সিংহাসনের সামনে ক্ষুদ্র আকারে রয়েছে হনুমান— অর্থাৎ রাজা রামের সামনে তিনি নিতান্তই ক্ষুদ্র।
আরও পড়ুন- ডাইনোসরের মুখে সরলতার হাসি, বাংলার কোথায় তৈরি হয় ঝুলন যাত্রার পুতুল?
অন্যদিকে, ষাঁড়রূপী সাদা নন্দীর ওপর বাঘের ছাল পরে বসে আছেন মহাদেব, চোখে নেশাতুর দৃষ্টি, গলায় ও কব্জিতে রুদ্রাক্ষমালা। পাশে ত্রিনয়না পার্বতী, যিনি বাঙালি রমণীর মতো ঘোমটা টেনেছেন। ষাঁড়রূপী নন্দীর পাশে মানবরূপী নন্দী ও ভৃঙ্গী। শিল্পীর মতে, পুরনো বনেদি বাড়ির পুজো ছাড়া আজ আর কোথাও চালচিত্রের এই ধারা টিকে নেই।
লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরার পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ বইতে বলা হয়েছে, পটের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো দুর্গা প্রতিমার চালচিত্র। সাবেকি এক চালার দুর্গা প্রতিমার ওপর অর্ধগোলাকৃতিভাবে বসানো হতো দেবদেবীর ছবি আঁকা চালচিত্র। প্রাচীনকালে যেমন পাথরের মূর্তির ওপর অর্ধবৃত্তাকার মোটিফ উৎকীর্ণ হতো, অনুরূপভাবে দুর্গামূর্তির ওপরও অর্ধচন্দ্রাকৃতির চালচিত্র অঙ্কনের রেওয়াজ ছিল।
(বিশেষ কৃতজ্ঞতা : গবেষক বিধান বিশ্বাস মহাশয়কে)
গ্রন্থঋণ : পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ, তারাপদ সাঁতরা

Whatsapp
