সারদা দেবী: নারীমুক্তির প্রশ্নে আজও সমান প্রাসঙ্গিক
Sarada Devi: লেডি ডাফরিন হাসপাতালে একটি নার্সের পদ খালি হয়। মা সারদা তখন একটি মেয়ের নাম সেই কাজের জন্য প্রস্তাব করেন। কিন্তু সমাজ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।
বাঁকুড়ার জয়রামবাটীতে, ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাড়িতে, ১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে একটি কন্যাসন্তান। নাম রাখা হল 'ক্ষেমঙ্করী'। পরে ক্ষেমঙ্করী নামটি পালটে 'সারদামণি' রাখা হয়। কে জানত, এই সাধারণ গ্রাম্য বালিকা একদিন 'মা সারদা' নামে পরিচিত হয়ে উঠবেন?
ভগিনী নিবেদিতা একবার বলেছিলেন, "Is she the last of an old order? Or a beginning of a new?" অর্থাৎ, তিনি কি পুরনো যুগের শেষ প্রতিনিধি? না কি নতুন যুগের শুরু? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে, মা সারদার জীবন আমাদের নিয়ে যায় এক অসাধারণ যাত্রায়– যেখানে পুরনো রীতি-নীতি এবং আধুনিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
সেই যাত্রার শুরু হয় জয়রামবাটীর সেই ছোট্ট বাড়িতে। সারদামণির বাবা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক ও পুরোহিত, আর মা শ্যামাসুন্দরী দেবী ছিলেন গৃহিনী। দরিদ্র হলেও রামচন্দ্র ছিলেন পরোপকারী ও দানশীল। ছোটবেলা থেকেই সারদামণি ছিলেন অসাধারণ। সারদা দেবীর প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা একেবারেই ছিল না বললেই চলে। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় যেতেন, তখন তাঁর অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে রামকৃষ্ণদেবের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী দেবী ও শ্যামপুকুরে একটি মেয়ের কাছে পড়াশোনা শেখেন।
১৮৫৯ সালের মে মাসে, সেকালে প্রচলিত গ্রাম্য প্রথা অনুসারে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে। তিনি তখন কামারপুকুরের ২৩ বছর বয়সি এক যুবক। কিন্তু এই বিয়ে সাধারণ দাম্পত্যের মতো ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখতেন মায়ের রূপে। আর সারদা দেবী হয়ে উঠলেন তাঁর আধ্যাত্মিক সঙ্গিনী। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে এসে তিনি শুরু করলেন এক নতুন জীবন– পূজা-পাঠ, ধর্মকর্ম, সেবা। একদিকে দেখলে মনে হয়, এ তো পুরনো যুগের ছবি। মেয়েরা ঘর সামলাবেন, পূজা করবেন, স্বামীর সেবা করবেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ভগিনী নিবেদিতার প্রশ্ন এখানেই চিন্তার জন্ম দেয়। মা সারদা কি সেই পুরনো ব্যবস্থার শেষ প্রতিনিধি? না, তিনি তো নতুন যুগের প্রথম আলো!
আরও পড়ুন - রামকৃষ্ণ-সারদা-স্বামীজির স্মৃতি ছড়িয়ে, উইকএন্ডে ঘুরে আসুন ঘরের কাছের এই তীর্থে
সেই সময়, লেডি ডাফরিন হাসপাতালে একটি নার্সের পদ খালি হয়। মা সারদা তখন একটি মেয়ের নাম সেই কাজের জন্য প্রস্তাব করেন। কিন্তু সমাজ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। "হিন্দু ঘরের মেয়ে গিয়ে রোগীদের মল-মূত্র ঘাঁটবে? এটা অসম্ভব!" কিন্তু মা সারদা? তিনি তখন শান্তভাবে বললেন, "না না, ও গিয়ে শিখুক না, তারপর শিখে এসে তো আমাদেরই সেবা করবে।" এই কথায় লুকিয়ে ছিল এক নীরব বিপ্লব। সেই মেয়েই ছিলেন পরবর্তীকালের সারদা মঠের প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রভাজিকা ভারতীপ্রানা মাতাজী। যেখানে, আজকের দিনেও অনেকে নার্সিং নিয়ে নাক সিটকোন। সেখানে, তখনকার দিনে তো, ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়েরা ঘরের বাইরে পা রাখত না, মা সারদা ভাঙলেন সেই ট্যাবু। সেই মেয়ে গেলেন নার্সিং শিখতে, এবং পরে প্রেসিডেন্ট হয়ে জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। মা সারদা যেন দেখিয়ে দিলেন, আধুনিকতা মানে শুধু পশ্চিমী পোশাক বা চাকরি নয়, আধুনিকতা মানে সমাজের সেবা, দৃঢ়তা, এবং সমাজের পুরনো বাধা, চিন্তা-ভাবনা ভাঙা।

মা সারদার কথা হলেই,সঙ্গে আসে মাতৃত্বের কথা। এ এক অন্তর্নিহিত গুণ। তাঁর জীবনে দেখা যায়, কীভাবে তিনি সকলকে মায়ের মতো আদর, যত্ন, স্নেহ, ভালবাসায় মুড়ে রাখতেন। তিনি কাউকে জন্ম না দিলেও, সকলের মা ছিলেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে তিনি একইরকম স্নেহ করতেন, সকলেই ছিল তাঁর সন্তান। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যরা, স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিরা– সবাই তাঁকে 'মা' বলে ডাকতেন। এবং এই 'মা' ডাক গুরুপত্নী হওয়ার কারণে ছিল না। তাঁর মাতৃত্ব সুলভ আচরণই এর কারণ ছিল। অচেনা মানুষকেও তিনি আপন করে নিতেন।
আরও পড়ুন - স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু রহস্য!?
উনিশ শতকের গ্রামীণ বাংলার এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল যুগোত্তীর্ণ এবং আধুনিক। তাই, মা সারদার গল্প শুধু এখানে থেমে থাকে না। স্বামী বিবেকানন্দ একবার তাঁর ভাতৃস্থানীয় একজনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, "দাদা, মা ঠাকরুন কী বস্তু, তোমরা এখনও কেহই বুঝতে পারনি, ক্রমে পারবে। তিনি ভারতে এসেছেন মহাশক্তি জাগাবেন বলে, তাঁকে কেন্দ্র করে গার্গী, মৈত্রেয়ী, আবার সব জগতে জন্মাবে।"
অর্থাৎ, তিনি বলতে চেয়েছেন, গার্গী এবং মৈত্রেয়ী– প্রাচীন যুগের সেই দুই কিংবদন্তী নারী দার্শনিক ও ঋষি, যাঁরা খোলা মনে, সভায় সকলের সামনে ঋষি-মুনিদের সঙ্গে তর্ক করতেন, দার্শনিক চিন্তাভাবনা ভাগ করতেন। আজকের দিনে, যাকে আমরা বলি 'মাথা উঁচু করা মহিলা'– যাঁরা বুদ্ধি, দৃঢ়তায় পুরুষদের থেকে কোনও অংশে কম নন, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। মা সারদা যেন সেই শক্তির প্রতীক। তাঁর শান্ত, কোমল রূপের আড়ালে ছিল অটল দৃঢ়তা। এক যুগোত্তীর্ণ নারী, যিনি ভারতে নারীজাগরণের আলো জ্বালিয়েছেন। তাঁর কর্ম এবং উপদেশে নারী-পুরুষের সমতা, নারীশিক্ষা, সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা এবং নারীর স্বাধীনতার প্রতি গভীর বিশ্বাস প্রকাশ পায়।
আধুনিক ভারতের মেয়েরা– যাঁরা বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত নারীবাদী চিন্তাভাবনার আধিকারী– তাঁদের মধ্যে গার্গী-মৈত্রেয়ীর ছায়া দেখা যায়। সারদা দেবী নীরবে যে বিপ্লব করেন, তাই আজকের মেয়েদের নারীবাদী হওয়ার রশদ। তিনি কি কেবল একটি পুরনো যুগের শেষ? না, নতুনের অগ্রদূত। তাঁর জীবন যেন এক গল্প, যা আমাদের বলে, পরিবর্তন ধীরগতিতে আসে, কিন্তু তা অটল।
মা সারদার জীবন ছিল নারী জাগরণের এক জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক, যা নারীদের শিক্ষা, স্বাধীনতা এবং সমতার পথ দেখায়। তাঁর দর্শনের সার পুরনো বন্ধন ভেঙে নতুন আলোর যুগের সূচনা করে। মা সারদা শুধু একজন মাতৃস্বরূপা নন, তিনি নারীমুক্তির পথপ্রদর্শক।

Whatsapp
