২ মিলিয়নের পথে এগোচ্ছে হুব্বা: বাংলা ওটিটি-র বাজার খাবে ব্রাত্যর মডেল?
Hubba YouTube release: থিয়েটারে রিলিজের পর ইউটিউবে মুক্তি পায় ব্রাত্য বসু পরিচালিত, মোশারফ করিম অভিনীত এই ছবি। এবং ফল, ৫ দিনে ১০ লাখ দর্শক দেখেছেন এই ছবি।
আমির খান, তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ছবি 'সিতারে জামিন পর' থিয়েটারে রিলিজের পর ওটিটি রিলিজ না করে, ইউটিউবে পে-পার-ভিউ মডেলে রিলিজ করেছিলেন। তিনি ইউটিউবে ছবিটি রিলিজ করে থিয়েটার এবং ওটিটি-র মাঝখানে আরেকটি দরজা খোলার চেষ্টা করলেন। তথ্য বলছে, ইউটিউবে রিলিজ করার পর ছবি সাধারণ ভাবে যা ব্যবসা করে, তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি রোজগার করেছে। বাংলায় ব্রাত্য বসু, আমির খানের দেখানো পথেই হাঁটলেন তাঁর ছবি 'হুব্বা'কে নিয়ে। ২০২৪-এর গোড়ায় বড় পর্দায় মুক্তি পেয়েছিল কোন্নগরের ত্রাস হুব্বা শ্যামলের (হুগলির দাউদ ইব্রাহিমের) বায়োপিক। থিয়েটারে রিলিজের পর ইউটিউবে মুক্তি পায় মোশারফ করিম অভিনীত এই ছবি। ফলও এল হাতেনাতে, ১১ দিনে ১৩ লক্ষ দর্শক দেখেছেন এই ছবি।
বাংলা ছবি দেখতে সিনেমাহলে আর ভিড় জমায় না দর্শক, নতুন প্রজন্ম বা জেন-জি বাংলা সিনেমার নাম শুনলেই নাক সিটকোয়— এই সব অভিযোগের মধ্যে হুব্বা-র দর্শক পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। ব্রাত্য বসুর পরিচালনায়, হুব্বার চরিত্রে ওপার বাংলার 'বিগ বি' মোশারফ করিমের অভিনয়ে, তরুণ হুব্বার চরিত্রে এপার বাংলার গম্ভীরা ভট্টাচার্যের অভিনয়ের গুণমুগ্ধ নেটাগরিক। নেটফ্লিক্স, প্রাইম এবং অন্যান্য ওটিটি-র ছবি ছেড়ে এই ছবি ইউটিউবে তাঁরা দেখছেন এবং দেখে যে ভীষণ খুশি, তা সকলের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়।
বাংলা ছবি তৈরি, ছবি তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর থিয়েটারে মুক্তি— এই সমস্ত বিষয় নিয়ে নির্মাতাদের বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়ার খবর প্রায়শই খবরের হেডলাইনে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এখানেই একটি ছবির লড়াই শেষ হয় না। এরপর আরেক দফা যুদ্ধ চলে, ছবির স্যাটেলাইট স্বত্ব বিক্রি এবং ওটিটি রিলিজ নিয়ে। হুব্বার ক্ষেত্রেও, হল পাওয়া নিয়ে একটি রেষারেষি দেখা দেয়। ছবিটি মোটামুটি ব্যবসাও করে থিয়েটারে। তারপর স্যাটেলাইট স্বত্বও বিক্রি করা হয়। কিন্তু বাদ সাধে ওটিটি-তে মুক্তির পাওয়ার সময়। প্রযোজক চাইছিলেন ওটিটি-তে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ছবিটি বিক্রি করতে। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ দিতে রাজি হয়নি কোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।

তখনই পরিচালকের মাথায় আসে 'সিতারে জমিন পর'-এর ইউটিউবে রিলিজের কথা। ফ্রেন্ডস কমিউনিশনের ইউটিউব চ্যানেলের একটি বিবৃতিতে ব্রাত্য বসু বলেন,
"প্রযোজক সংস্থা ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন চাইছিল নির্দিষ্ট কোনো অ্যাপে 'হুব্বা' রিলিজ করতে। সর্বভারতীয় বা আঞ্চলিক কোনো অ্যাপে। কিন্তু ফিরদৌস উল হাসান যে টাকাটা চাইছিলেন এর বিনিময়ে, সে টাকাটা ওনারা পাচ্ছিলেন না। এই অ্যাপগুলির যারা কর্মকর্তা, তারা যেটা দারুণ জানেন, তা হল ইন্টারনেট বা কম্পিউটারের ব্যবহার এবং ইংরেজী। কিন্তু যেটা জানেন না তা হলো, শিল্প কী জানেন না, সাহিত্য কী বোঝেন না। রিলিজ করার পর থেকেই আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এই বিষয়ে যে, আমরা আধুনিক ভাষায় যাকে বলি জেন-জি, যাদের হাতে স্মার্ট ফোন আছে, এটা তাদের কাছে ব্যাপক হারে জনপ্রিয় হবে। তখন আমি হাসানকে বললাম, যে, ইউটিউবে রিলিজ করার ঝুঁকিটা নেওয়া যেতে পারে কারণ- কিছুদিন আগে আমি কাগজে পড়েছিলাম আমির খান তাঁর 'সিতারে জমিন পর' ইউটিউবে রিলিজ করার কথা ভাবছেন। আমির খানের মতো সর্বভারতীয় তারকা যখন এই ঝুঁকি নিয়েছেন, তখন এই ঝুঁকিটা আমরাই বা নেব না কেন? এবং সেই মোতাবেক কথা এগোল, আমি তাঁদের বললাম, ইউটিউবকে মেল করে এই ব্যবস্থা করতে, যাতে যদি কেউ পাইরেট করে কপিও করে, তার টাকাটা ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশনের অ্যাকাউন্টে আসে। অর্থাৎ, হুব্বা কেউ যদি এখন পাইরেট করে চালায়ও, কেউ চালাতেই পারে, কিন্তু তার ভিউয়ারশিপের যে টাকাটা হয়, সেটা ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন পাবে।"

'হুব্বা' ইউটিউবে রিলিজ করার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ দিনে এক মিলিয়ন ভিউ হয়। বাংলা ছবিতে এরকম ঘটনা ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই, পরিচালক ভীষণ খুশি। তিনি বলেন,
"এটা আমার কাছে ভীষণ আনন্দের। এর একটা কারণ নিশ্চয়ই মোশারফ করিম এবং বাংলাদেশে মোশারফ করিমের জনপ্রিয়তা। কিন্তু আপনি যদি অন্যান্য বাংলা সিনেমা, অ্যাপে যে ছবিগুলো রিলিজ করে, তার ভিউয়ারশিপ দেখেন, তার ভিউয়ার সংখ্যা এতটা পাবেন না। এটা একেবারে যাকে বলে জনতার দরবারে এনে ফেলা এবং হাতে গরমে তার ফলাফল পাওয়া। আপনি যদি ইউটিউবে অন্যান্য বাংলা সিনেমার সঙ্গে হুব্বার ভিউয়ারশিপ পাশাপাশি রাখেন, তাহলে দেখতে পাবেন হুব্বাকে নিয়ে মাতামাতিটা কোন পর্যায়ে চলছে। আমার ধারণা, প্রযোজকরা, ওদের কাঙ্খিত মুনাফাটা খুব দ্রুতই এটার ফলে পেয়ে যাবে।"
হুব্বার ইউটিউবে এই জনপ্রিয়তা জন্ম দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার। পরবর্তী ক্ষেত্রেও একই পথে হাঁটার ইচ্ছে আছে পরিচালক-প্রযোজক জুটির।
"আমার পরবর্তী ছবি 'শেকড়' নিয়েও আমি খুব আশাবাদী। 'শেকড়ে'রও প্রযোজক ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন, আমি তাদের বলেছি 'শেকড়ে'র ক্ষেত্রেও 'হুব্বা'র মডেলটিই রাখতে চাই। ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশনের আরেক ছবি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'পদাতিক', মৃণাল সেনের বায়োপিক। কিছুদিন পর মুক্তি পাবে এই ছবি। এই ছবিটিও আমরা ইউটিউবে রিলিজ করতে চাই।"
আরও পড়ুন - খোলনলচে বদলালেই একমাত্র বাঁচতে পারে বাংলা ছবি
অর্থাৎ মুখে না বললেও, ওটিটিগুলির মৌরসিপাট্টা ভাঙতে চাইছেন ব্রাত্যরা। স্বাধীন পরিচালকের মাথায় গল্প সাজানো থাকলেও, তা দর্শককে দেখাতে পারেননা অনেক সময়, শুধুমাত্র একটি মঞ্চের বা প্ল্যাটফর্মের অভাবে। এক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত দেখতে পাচ্ছেন ব্রাত্য। বাংলার স্বাধীন পরিচালকদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা,
"যে সমস্ত অটোনমাস ডিরেক্টররা কোনো নির্দিষ্ট প্রযোজনা সংস্থা থেকে, বা তার বাইরে গিয়ে কাজ করতে চাইছেন, অন্য রকমের ছবি করতে চাইছেন, তাদের কাছে কিন্তু এটা একটা নতুন পথ খুলে দিতে পারে এবং ফিরদৌস উল হাসান যেভাবে আঁটঘাট বেঁধে, ইউটিউবকে মেল করে, তাদের স্লট লক করে যে কৌশল অবলম্বন করলেন, এটা একটা নতুন পথ খুলে দিতে পারে।"
এই মডেলটিকে সিলমোহর দিয়েছিলেন আমির খান। 'সিতারে জমিন পর' ইউটিউবে রিলিজ করার সময় তাঁর প্রেস কনফারেন্সে আমির খান, তাঁর এই অভিনব ভাবনার কারণ জানান,
১৫ বছর আগে একসময়, আমি শুনেছিলাম, আমাদের জনসংখ্যার মাত্র ২-৩ শতাংশ সিনেমাহলে গিয়ে ছবি দেখতে পারে। অর্থাৎ বর্তমান হিসেবে, ১৪০ কোটির মধ্যে মাত্র ৩-৩.৫ কোটি দর্শক সিনেমাহলে গিয়ে একটি ছবি দেখতে পারে। তখন থেকেই আমার মাথায় এটা চলত যে, কীভাবে সকলের কাছে একটি ছবি নিয়ে যাওয়া যায়। তারপর যখন ইউপিআই ভারতে এল, তখন ডিজিট্যাল পেমেন্ট খুব সহজ হয়ে গেল। বর্তমানে সকলেই ইন্টারনেটের ব্যবহার করছে। আমি যে প্রশ্নের উত্তর চাইছিলাম এতদিন ধরে, অবশেষে তার উত্তর পেলাম। ইউটিউব স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ফোন, ট্যাবলেট প্রায় সমস্ত ডিভাইসে প্রিলোডেড থাকে। ভারতের প্রায় ৫৫ কোটি মানুষ ইউটিউব দেখে প্রতিদিন। ইউটিউবে সাবস্ক্রিপশন, ফ্রি ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন মডেল রয়েছে। ১০০ বছর থেকে ভারতে সিনেমার যে মডেল চলে আসছে, তা হল পে-পার-ভিউ মডেল। অর্থাৎ, আমরা একবার যাই সিনেমাহলে, একবার টিকিট কাটি, আর একবারই ছবি দেখতে পারি। তাই ভাবলাম, আমরা যেরকম ভাবে সিনেমা দেখে থাকি, ওই মডেলেই আমি আমার দর্শকের কাছে ছবি পৌঁছে দেব। এই একই উদ্দেশ্যে আমি 'আমীর খান টকিজ' লঞ্চ করলাম কয়েক মাস আগে। আমি 'টকিজ' রেখেছিলাম নামে, কারণ আমি জানতাম, কিছুদিন পর এখানেই আমার ছবি রিলিজ করব। এখানে কিছু কন্টেন্ট ফ্রি আছে এবং কিছু পে-পার-ভিউ।"

"থিয়েটারে ছবিটি চলে এসেছে, আমি সবসময় চাই সকলে থিয়েটারে দেখুন। কিন্তু, 'সিতারে জমিন পর', থিয়েটারে চলাকালীন হয়তো ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি মানুষই দেখতে পারবেন, কিন্তু ভারতবর্ষের বাকিরা কোথায় দেখবে? আমার পক্ষ থেকে এই চেষ্টা থাকবে, যে সকলে এই ছবি দেখুক। আমি যে কাজ করছি, যে সিনেমা বানাচ্ছি, সেটা যেন প্রত্যেকটি ভারতবাসীর কাছে সহজে এবং সহজলভ্য ভাবে পৌঁছয়, এটাই আমার স্বপ্ন। যাতে দর্শক এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারে যে, সে কখন দেখবে, আদৌ দেখবে কিনা? কমপক্ষে আমরা একটা পথ খুলে দিচ্ছি। এটা একটা প্রচেষ্টা, যেহেতু সিনেমা করোনার মহামারীর পর থেকে একটু কম ব্যবসা করছে, এটি সকলের ক্ষেত্রেই লাভদায়ক হতে পারে। নবাগতদের জন্য এটি বেশ উপকারী হতে পারে, তাদের কাজ যদি ভালো হয়, দর্শক তাদের পছন্দ করবে, তাদের কাজ সকলের কাছে পৌঁছতে পারবে এবং টাকাও রোজগার করতে পারবে।"
অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট, আমির খান চেয়েছিলেন, যত বেশি সম্ভব দর্শকের কাছে পৌঁছতে, তার সিনেমা নিয়ে। যেহেতু ভারতবর্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিনেমাহল নেই, ইউটিউবই এর জন্য শ্রেষ্ঠ উপায় বলে তিনি মনে করেন। ইউটিউব হলো নির্মাতা এবং দর্শকের মাঝখানের সেতু। দর্শকরা একটি সিনেমা দেখলে যে পরিমাণ মুনাফা হয়, তা সরাসরি নির্মাতাদের কাছে পৌঁছে যায়। এখন আমিরের দেখানো পথেই হাঁটতে চাইছেন ব্রাত্য। ফলও মিলছে হাতেনাতে। 'হুব্বা' রিলিজ করা হয় ইউটিউবে এবং তার ফল, ১১ দিনে ১৩ লক্ষ দর্শক দেখেছেন ছবিটি। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই ২ মিলিয়ন পেরিয়ে যাবে ভিউয়ারের সংখ্যাটা। ২ মিলিয়ন লোক যদি একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা দেখেন, তা যে লগ্নিকারীর মুখে হাসি ফোটাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Whatsapp
