হেরিটেজ স্রেফ তকমাই, অক্ষয়কুমারের বাড়ি এখন সাপের আস্তানা
Akshay Kumar Datta residence: সারা দেশের মধ্যে প্রাচীন এক ঐশ্বর্যশালী সংগ্রহশালার রূপ নিতে পারত এই বাড়ি। কিন্তু কালের গর্ভে সেই সংগ্রহশালা আজ সাপের রাজত্বে পরিণত হয়েছে।
এই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসের পনেরো তারিখ। দুপুর বেলায় জেসিবিটা এসে দাঁড়ায়, বালি দেওয়ানগাজী তলায় গঙ্গার পাড়ে পাঁচিল ঘেরা একটি দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটা এমনিতে ভগ্নস্তূপ। ইট-কাঠ-লোহার বিমের কঙ্কালের শরীর ফুঁড়ে আকাশ ঢেকেছে পরগাছারা। রিক্ত ইটগুলো কোনোক্রমে এখনও একে অপরকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য যুঝে চলেছে। ভগ্নপ্রায় পাঁচিল ঘেরা পরিসরে আগাছার জঙ্গলের অবরোধহীন বৃদ্ধি, সেখানেই বিষধরদের নিশ্চিন্ত আবাস। তবে দেখলে বোঝা যায়, হতশ্রী চূর্ণ পলেস্তরার ধুলোয় দুই শতকের ইতিহাসের ভার বহন করে চলেছে এই বাড়ি। এলাকাবাসী জানেন এই পোড়ো বাড়ির ইতিহাস। তাই উদ্ধত সেই জেসিবি দেখেই স্তম্ভিত হয়ে যান প্রাচীন জনপদটির বাসিন্দারা। বহু মানুষ জড়ো হন, শুরু হয় বিক্ষোভ, অতঃপর পুলিশি হস্তক্ষেপে ফিরে যায় জেসিবি।
একটা জঙ্গলাকীর্ণ পোড়ো বাড়ি নিয়ে মানুষের এত আবেগ কেন? আর হঠাৎ জেসিবি আগমনেরই বা কারণ কী? গঙ্গাপাড়ে বালির এই বাড়িতেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান অক্ষয়কুমার দত্ত। যে নামটা শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যই গৌরবের। বাংলার নবজাগরণের অগ্রণী সৈনিক, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তাবিদ-দার্শনিক, গদ্যকার, অনুবাদক, ভাষাবিদ, গণিতজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাড়ি– ‘শোভনোদ্যান’।
১৮৭৬ সালে ‘সোমপ্রকাশ’-এ এই বাড়ির বিবরণে লেখা হয়েছিল,
“…বাড়িটি বালীগ্রামে গঙ্গার অতি সন্নিকটে অবস্থিত। ঘরগুলি অতি পরিষ্কার ও বায়ু সঞ্চালনের উপায় আছে। তিনি (অক্ষয়বাবু) যে স্থানে বসেন, তাঁর চারদিকে নানা প্রকার সিন্ধুজাত শঙ্খ, শামুক, প্রাণীদেহ, জীব কঙ্কাল ইত্যাদি অতি পরিপাটি ভাবে সজ্জিত দেখিলাম।”
১৮৮৫ সালে মহেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা ‘বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবন বৃত্তান্ত’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
“উদ্যানটি ছোট বটে, কিন্তু তরু-রাজি-সংগম ও সুচারু রূপ পরিপাট্য…বিভিন্ন জাতীয় আর্কেরিয়া, থুজা, সাইপ্রেস, জুনিপেরস, পাইনস, কপ্রেসস, পামন, সেলাজেনিলা, ফরম (নানা বর্গ), এন্থেরিয়াম, পোথোস, মনস্টেরা ক্রোটন, কোলিয়স, বিগোলিয়া, মেরেন্টা, কেলেথিয়া, হফমেনিয়া, সেন্ট্রাডেনিয়া, কুরমেরিয়া, পেপোরামা…ইত্যাদি বিবিধ বর্গের অন্তর্গত সুশোভন বৃক্ষজাতি, এবং এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, লোবা, তেজপত্র, কাবাব চিনি, খদির, হিঙ্গু, কর্পূর, চন্দন, ভুর্জ্জপত্র, হরীতকী, সাগু, আমলকী, পান্থপাদপ ইত্যাদি নানা জাতীয় অশেষ প্রকার পরম রমণীয় অসাধারণ বৃক্ষরাজি সমূহ…চিত্রপটের ন্যায় দৃশ্যমান।”
আশীষ লাহিড়ীর বইতেও এই বিষয়ে জানা যায়। এছাড়াও শোভনোদ্যানে বহুবিধ জীবাশ্মেরও বিশাল এক সংগ্রহশালা তৈরি করেছিলেন অক্ষয়বাবু। নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব অক্ষয়কুমার এই উপমহাদেশের প্যালিওন্টোলজিরও পথিকৃৎ। আরও বহু বিষয়ের মতোই জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা ও চর্চার শুরু তাঁর হাতেই; আর তার সাক্ষ্য বালির পূর্ব দিকে গঙ্গার ধারের এই বাড়ি।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও বহুবার এসেছেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্তের শোভনোদ্যানে। তিন পর্বে লেখা চারুপাঠের লেখকের এই অপূর্ব উদ্যান দেখে বিদ্যাসাগর তার নাম দিয়েছিলেন ‘চারুপাঠের চতুর্থ পর্ব’। চারুপাঠ বিক্রির টাকা দিয়েই এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন অক্ষয়কুমার। পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল, কলকাতার সুধী মহলের প্রতিও হয়ে উঠছিলেন বীতশ্রদ্ধ; পরিবার থেকে বৌদ্ধিক মহল– সব ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকট হচ্ছিল। তাই জীবনের বাকি সময়টা নিজের মতো করে জ্ঞানচর্চার পরিসর বানিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তারই পরিণাম ছিল ‘শোভনোদ্যান’। যেখানে ১৮৫৬ থেকে ১৮৮৬ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ তিরিশ বছর কাটিয়েছেন জ্ঞানবিশ্বের মহীরুহ হয়ে ওঠা বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত। ১৮৮৬ সালের ২৮মে বালিতেই প্রয়াত হন তিনি। বালি শ্মশান ঘাটেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
বাড়িটি হয়ে উঠেছিল আদতে বিপুল সম্ভারের এক অমূল্য মহাফেজখানা। উপমহাদেশে সম্ভবত আধুনিক মহাফেজখানা বা আর্কাইভ তৈরির দিশারীও অক্ষয়বাবু। সারা দেশের মধ্যে প্রাচীন এক ঐশ্বর্যশালী সংগ্রহশালার রূপ নিতে পারত এই বাড়ি। কিন্তু কালের গর্ভে সেই সংগ্রহশালা আজ সাপের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। প্রখ্যাত অক্ষয় গবেষক আশীষ লাহিড়ীর কথায় “পুরোদস্তুর এক হানাবাড়ির চেহারা”।
এই বাড়িতেই তিনি ধীরে ধীরে ব্রাহ্ম ধর্মের একেশ্বরবাদী দর্শনের প্রতি আস্থা হারান, এবং যুক্তিবাদী অজ্ঞেয়বাদ চর্চা করতে থাকেন। তাঁর তত্ত্ববিশ্বে প্রার্থনা হয়ে দাঁড়ায় অপ্রয়োজনীয়। বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রখর যুক্তিবাদী অবস্থান তাঁকে কার্যত একঘরে করে দেয়, এমনকি তৎকালীন বঙ্গ সমাজের নমস্য ব্যক্তিত্বরাও তাঁর থেকে দূরত্ব তৈরি করেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে,
“…বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে যাতে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বলে তাচ্ছিল্য করা না হয়, তার জন্য অক্ষয় কুমার তাঁর জীবনসায়হ্নে ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার মূল খুঁজতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতা ও অকাল প্রয়াণের ফলে সে অনুসন্ধান অসমাপ্ত থেকে যায়।”
সেই অনুসন্ধানেরই ফলশ্রুতি ছিল ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যা লেখা হয়েছিল এই বাড়িতেই।
কিন্তু সরকারি বদান্যতায় এই ঐতিহাসিক কর্মভূমির অস্তিত্বই আজ সংকটে। যেভাবে অক্ষয়কুমার দত্ত ও তাঁর চিন্তাজগতকে বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেওয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টা জারি আছে, তেমনই তাঁর কর্মভূমিকে ধ্বংসের মাধ্যমে শেষ চিহ্নটাও মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলছে। বহুদিনের দাবির স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছিল ২০০৬ সালের মে মাসে; রাজ্য সরকার শোভনোদ্যানকে হেরিটেজ ঘোষণা করে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল,
“…এই ঐতিহ্য সম্পন্ন পুরাকীর্তিটি সংরক্ষিত ও ঐতিহ্য সম্পন্ন পুরাকীর্তি রূপে ঘোষিত হয়েছে। যে কেউ চৌহদ্দি সহ এই স্মারকের ধ্বংস, ক্ষতি, পরিবর্তন, বিকৃতি, সৌন্দর্যহানি, অপসারণ বা বিলুপ্তি ঘটাইবেন, তিনি আইনত দায়বদ্ধ থাকবেন।”
কিন্তু ঘোষণা ও বিজ্ঞপ্তিই সার! হেরিটেজ ঘোষণার নীল সাইনবোর্ডটা একপাশে কাত হয়ে মাটিকে আলিঙ্গন করেছে। এলাকাবাসীর কথায়, আগে যে ক'টা দরজা, জানালা অবশিষ্ট ছিল সেগুলোও কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে। এখন শুধুই একটা বাড়ির কঙ্কাল রয়ে গেছে। হেরিটেজ ঘোষণার পরেও বিগত কুড়ি বছরে একবারও এই ঐতিহাসিক সম্পদের সংস্কার করার কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যায়নি। এখন এগিয়ে এসেছে জমি হাঙররা; কীভাবে দখল করা যায় অক্ষয় দত্তের সাধের শোভনোদ্যান, সেটাই তাদের উদ্দেশ্য।
অক্ষয়কুমারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বলি হয়েছিল শোভনোদ্যান। ছেলের সঙ্গে বনিবনা হয়নি, নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন আলোর সন্ধানে সারাজীবন ছুটে চলা মানুষটি। তাঁর মৃত্যুর পরেই এই বাড়ি বেচে দেন পরিবারের লোকেরা। ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ বইতে কেদারনাথ মজুমদার লিখছেন,
“অক্ষয়বাবুর শেষ জীবন এই বালী গ্রামে অতিবাহিত হয়। তাঁহার এখানকার বসতবাটি শোভনোদ্যান দর্শনার্থে কলিকাতা ও সুদূর পল্লিগ্রাম হইতে বহু লোক আসিত।…তাঁহার মৃত্যুর পর তদীয় পৌত্র তাঁহার শোভনোদ্যান এক ইংরেজ সওদাগরকে বিক্রয় করিয়া দরিদ্র গ্রামবাসীর হৃদয়ে দাগা দিয়াছেন।…অক্ষয়কুমারের সুযোগ্য বংশধরের চেষ্টায় সেই শোভনোদ্যান এখন জাহাজ মেরামতের বৃহৎ কারখানায় পরিণত হইয়াছে।”
অক্ষয় দত্তের পৌত্র নিজেও একজন বিখ্যাত মানুষ, ‘ছন্দের জাদুকর’ হিসেবে পরিচিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।
সময়ের সঙ্গে সেই জাহাজ মেরামতির কারখানা বন্ধ হয়েছে দীর্ঘদিন। পরে অনেকগুলো ছোট ছোট কারখানা তৈরি হয়েছিল, সেগুলোও সব নিয়মিত নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের তরফে প্রথম শ্রেণির হেরিটেজের তকমা পেলেও কেন এই সরকারি ঔদাসীন্য? কেন এই ঐতিহাসিক স্মারককে সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলো না এতদিনেও? কেন এখানে তৈরি হবে না গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র? আগামীদিনে চর্চার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হবে, সেই স্বপ্নেই তো বহুবিধ বিপুল সম্ভারে শোভনোদ্যানকে সাজিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার।
২০১১ সালে সরকার বদল হলো, কিন্তু শোভনোদ্যানের অবস্থার কোনো বদল হয়নি। উল্টে প্রোমোটার চক্র সক্রিয় হয়েছে মুনাফার লোভে। ‘স্বাধীনতার অমৃতকালে’ জমি হাঙরদের গরলগ্রাসে চলে যেতে বসেছে এই ঐতিহাসিক স্মারক, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই কেন? নাকি অমৃতকাল আদতে সিনেমায় কিছু বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপনাতেই সীমাবদ্ধ!
নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল চর্চার ইতিহাস, নিজেদের কৃষ্টির অস্মিতা, জ্ঞানের ঐতিহ্যকে রক্ষার দায় তো আমাদেরই। গণচেতনা সেই কাজে তৎপর রয়েছে, কিন্তু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারগুলোর ভূমিকা নেতিবাচক। সুধী সমাজের যারা হেরিটেজ কমিটির মাথা হয়ে বসে আছেন, তাঁদেরও কোনো উদ্যোগ নেই। অক্ষয়কুমারের অসুস্থতাকে সেই সময় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ জাতীয় বিপর্যয় বা ‘national calamity’ আখ্যা দিয়েছিল। আজ জমি হাঙরদের থাবার সামনে, প্রায় ধ্বংসস্তুপ হয়ে যাওয়া এই ঐতিহাসিক স্মারকের অস্তিস্ত্ব বিপন্ন হওয়াটাও কি জাতীয় বিপর্যয় নয়?
Whatsapp
