হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যের প্রাঙ্গণ রজিম ফকিরের মেলা

Festival: সাতদিনের এই মেলা হিন্দু ও মুসলিমের মহামিলনের প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে। প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মনস্কামনার মঞ্চ হয়ে উঠেছে এই মেলা।

সারিবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন রঙের ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে শান্ত হয়ে। তাদের শরীরে কোথাও ধর্ম ও জাতপাতের বিভেদ নেই। সাধারণ মানুষের মনের ইচ্ছে ও শিল্পীর সুষমামণ্ডিত সরল তুলির টানে শীতের মিঠে রোদের মধ্যে ভালোবাসা ও আশ্বাসের বার্তা দিয়ে চলেছে ঘোড়াগুলো। প্রতিবছর ৭ অগ্রহায়ণে নদীয়ার পূর্ব শিমুলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় রজিম ফকিরের মেলা। রানাঘাট রেলস্টেশন থেকে বনগাঁগামী ট্রেনে মাঝেরগ্রাম স্টেশন নেমে টোটো করে যেতে হয় এই মেলায়। সাতদিনের এই মেলা হিন্দু ও মুসলিমের মহামিলনের প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে। প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মনস্কামনার মঞ্চ হয়ে উঠেছে এই মেলা।

কোনও এক কালে রজিম ফকির নামে এক পীরের বাস ছিল এখানে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সকলের চিকিৎসা করতেন। লোকসংস্কৃতি গবেষক আকাশ বিশ্বাসের মতে, "সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের আরোগ্য নিকেতনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন রজিম ফকির। তিনি সকলের চিকিৎসা করতেন। লোকবিশ্বাস মতে ৭ অগ্রহায়ণে তাঁর তৈরি করা ওষুধগুলো অলৌকিক ভাবে সবথেকে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতো। মানুষ দ্রুত আরোগ্য লাভ করত। রজিম ফকিরের মৃত্যুর পর একটি নিম গাছের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সমাধি চত্তরের মধ্যেই একটি থান তৈরি করা হয়। সেখানেই প্রতিবছর ৭ অগ্রহায়ণ মানুষ নিজের মনের ইচ্ছে পূরণের জন্য জোড়া ঘোড়া রেখে মনস্কামনা ও প্রিয়জনের দ্রুত আরোগ্যের কথা জানায়। কালক্রমে এই বিশ্বাস মেলায় পরিণত হয়।"

Rajim Fakir Than

রজিম ফকিরের কবরের পাশে অবস্থিত থান।

আর এই মেলাকে কেন্দ্র করেই বাংলার প্রান্তিক শ্রেণীর শিল্পীরা নিজের শিল্পসম্ভার নিয়ে আসেন। যেহেতু রজিম ফকিরের উদ্দেশ্যে নিজের মনস্কামনা পূরণের জন্য জোড়া ঘোড়া দেওয়া হয়, তাই স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা প্রতিবছর ৭ অগ্রহায়ণের সকাল থেকে বিভিন্ন রঙ ও উচ্চতার ঘোড়া নিয়ে বসে। লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি রঙের ঘোড়ার গায়ে সরু তুলির টানের রেখা দিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলেন শিল্পীরা। বাস্তবধর্মী ও বিমূর্ত দুই শৈলীর ঘোড়া এখানে পাওয়া যায়।

Thaner Ghora

থানের ঘোড়া।

পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, হুগলি ও অবিভক্ত মেদিনীপুরে রঙহীন ঘোড়া গ্রামীণ দেবতার থানগুলো আলো করে থাকে। সেগুলোর মধ্যে পুতুল সুলভ আকর্ষণ নেই। কিন্তু এই ঘোড়াগুলোর মধ্যে সেই আকর্ষণটি রয়েছে। একেবারে নিজস্ব শৈলীতে শিল্পিরা এই ঘোড়াগুলো তৈরি করেন। ধর্মগুরুদের ভিড় এখানে নেই। বিশেষ ভিআইপি পাসের চাহিদা এখানে দেখা যায় না। দক্ষিণার জন্য জোড়াজড়ি করা পরিবেশ এখনও এই থানকে স্পর্শ করতে পারেনি। নির্ভুল মন্ত্রচারণ ও রীতিনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকার অবয়বহীন পরিবেশ এই তীর্থভূমিকে আরও মানবিক করে তুলেছে। মনের ইচ্ছে আর হৃদয়ের চাওয়াই জোড়া ঘোড়ার মধ্যে দিয়ে রজিম ফকিরের কাছে পৌঁছে দিতে চায় মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের ভরসা ও ভালোবাসা নিয়ে আজও এগিয়ে চলেছে এই মেলা।

Ghora Bikreta

মৃৎশিল্পী।

বছর ৭৫-এর মৃৎশিল্পী নারায়ণ পাল প্লাস্টিকের চাদরের উপর তার তৈরি লাল রঙের ঘোড়া পেতে বসে রয়েছেন। তিনি এসেছেন আদিত্যপুর থেকে। ঘোড়ার পাশাপাশি রঙিন মাটির খেলনা বাটি ও সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত মাটির হাড়ি, কলসি, লক্ষীর ভান্ডার নিয়ে বসেছেন। শিল্পীর কথায়, প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মেলায় নিজের শৈল্পিক সম্ভার নিয়ে তিনি বসেন। বিশ্বায়নের যুগে মেলার গায়েও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। চিনা পণ্যের দাপট প্রবেশ করেছে এই মেলার মাঠে। কিন্তু পরিচ্ছন্ন মাটির রাস্তার ক্ষণস্থায়ী দোকানের পসরাগুলো গ্রাম বাংলার লৌকিক ও সরল সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে চলে।

Matir Rannabati

রঙিন মাটির খেলনা বাটি।

উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া থেকে বেতের তৈরি ধামা, কূলো, ঝাঁপি, কঙ্কে, ঝুড়ি, ফুলের ঝুড়ি নিয়ে আসেন শিশির দাসের মতো শিল্পীরা। আবার নদীয়ার সিলিন্দা, দরাপপুর থেকে কৃষকদের জন্য বিশেষ ভাবে নির্মিত গোল টুপি নিয়ে বসেন রমলা বিশ্বাস। উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের প্রথাগত শৈলীতে তৈরি হওয়া হুকো বা মেদেবাজারের শিল্পীদের তৈরি করা কাঠের তৈরি খেলনা গাড়িগুলো সরল শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়।

Village Fair

মেলায় গ্রামীণ হস্তশিল্পের সমাহার।

সোনালী হাল্কা রোদের তলায় সদ্য ফসল কেটে তোলা ধানক্ষেতের মধ্যে বসেছে মেলার আসর। এর থেকে কিছুটা দূরে হাল্কা জঙ্গল পেরিয়ে দেখতে পাওয়া যায় রজিম ফকিরের সমাধিস্থল। নিমগাছের তলায় সমাধিটি রয়েছে। তারই পাশে থান। আর সেখানেই আলো করে রয়েছে ঘোড়াগুলো। এখানে যেন অখণ্ড অবসর।

Rajim Fakir Kabar

রজিম ফকিরের কবর।

স্নেহশীল অনুভূতির কাছে পৌঁছতে গেলে মনকে এই হালকা সবুজে ঘেরা জঙ্গলের মতই নবীন ও প্রাণবন্ত রেখে দিতে হয়। কার কি গোত্র বা কে বেশি অর্থবান ও ক্ষমতাশালী সবই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে গ্রাম্য সরলতা ও বিশ্বাসের কাছে। তাই রজিম ফকিরের মেলা ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবকেই আরও স্পষ্ট ও সুতীব্রভাবে প্রতিষ্ঠা করে চলে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা লোকসংস্কৃতি গবেষক আকাশ বিশ্বাস মহাশয়কে

More Articles