'সভ্যতা' থেকে বিচ্ছিন্ন আজও | টোটোপাড়ায় এসআইআর যে প্রশ্ন তুলছে

Totopara fears sparked by SIR: ধনঞ্জয় টোটো বলেন, আমরা ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি, আমরা হিন্দু নই, তবু আমাদের হিন্দু সাজানো হচ্ছে! এটা এক নতুন বিপদ টোটোদের কাছে।

তিনটে নদীর বুকের উপর দিয়ে হেঁটে বা কোনো ছোট গাড়িতে চড়ে  নুড়ি পাথরের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠী টোটো সম্প্রদায়ের গ্রাম পশ্চিমবাংলার টোটোপাড়ায়। পিছনে ভুটানের তাদিং পাহাড়, পূর্বে তোর্সা নদী, দক্ষিণ পশ্চিমে হাওড়ি নদী আর দু'টো নদী পার করে আলিপুরদুয়ার জেলার এই গ্রাম। এ পথে কোথাও কোথাও পাকা রাস্তা হলেও বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন জনজাতিদের গ্রামে ঢুকতে নদীর উপর কোনো কজওয়ে সেতু এখনও হয়নি। ভোটের আগাম প্রতিশ্রুতি ভোটের শেষে হারিয়ে গিয়েছে।

এ গ্রামে নৃ-তাত্ত্বিক গবেষকরা টোটো সম্প্রদায়ের উপর গবেষণা করতে এখনও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন।ইন্দো-ভুটানি উপজাতি সম্প্রদায়ের টোটো সম্প্রদায়ের মানুষদের রোজের জীবন সংস্কৃতি বসবাস সবটাই আলাদা ছিল। কয়েক বছর আগেও তারা মাটির উপর বাঁশের খুঁটি পুঁতে, তার উপর বাড়ি করে থাকতেন, কিন্তু পরিবেশ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুরনো প্রথাতেও বদল এসেছে। শিক্ষার সুযোগ পাওয়ায় মাত্র ১% মানুষ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন, তবে এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। কারণ অবশ্যই এসআইআর।

টোটোপাড়ায় এসআইআর যে প্রশ্নগুলোর জন্ম দিচ্ছে

•বিশ্বের সবথেকে বিরল প্রজাতির এই গ্রামের সাথে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কেন এখনও?
•টোটো সম্প্রদায়ের মানুষরা সংখ্যায় কেন কমছে?
•প্রকৃতির উপাসক টোটো সম্প্রদায়ের মানুষদের কেন হিন্দু সাজানো হবে?
•শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থানে উপেক্ষিত থাকবেন কেন টোটোরা?
•টোটোভাষায় স্হানীয় স্তরে সরকারি শিক্ষাদানের মতন প্রক্রিয়া কেন হবে না?

টোটোপাড়ার একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র (ছবি জয়দীপ সরকার)

এ গ্রামের ধনীরাম টোটো ২০২৩ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন। টোটোদের মধ্যে শিক্ষার প্রভাব বাড়াতে ইন্দো বর্মান ভাষায় বর্ণলিপি তৈরি করেন ধনীরাম টোটো। ২২ টি ব্যাঞ্জনবর্ণ, ৯ টি স্বরবর্ণ, ৬ টি ডিফথং-সহ মোট ৩৭ টি লিপি নিয়ে বর্ণমালা। যা নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহ বাড়ে টোটোদের। সেই টোটোবর্ণে পড়ানো গ্রামের দু'টি বেসরকারি স্কুল চালু করেছে, তবে সরকারি স্তরে এখনও আমল পায়নি এই প্রয়াস।

আরও পড়ুন

এসআইআর: ভোটের আগে ‘ব্র‍্যান্ড মমতা’র হাতে চাঁদ?

ধনীরাম টোটো দ্য ওয়্যার-কে বলেন,

আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। বাম আমলে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমায় একটি সরকারি চাকরি দেয়। আমি প্রথম টোটো সম্প্রদায়ের মধ্যে সরকারি চাকরি পাই। এর পরে একজন ব্যাঙ্ক এবং কয়েকজন সেনা পুলিশ এসব দপ্তরে চাকরি পেয়েছিলেন। এসআইআর-এর কাগজ আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে এক বিএলও। এ গ্রামে আমরা আদিম জনজাতি, আমার হিসেবে এ গ্রামে বসত গড়ার পর টোটোদের অষ্টম প্রজন্ম চলছে, ফলে আমাদের বহিরাগত কেউ বলতে পারবে না। বরং এ গ্রামে ধীরে ধীরে ভুটান এবং নেপালের মানুষরা এসে বসবাস করে তাদের বসতি বাড়াচ্ছেন, আমরা কমছি। ২০১১-র হিসেবে জনসংখ্যা ছিল ২০৯৬ জন টোটো সম্প্রদায়ের মানুষ, এখন সব মিলে প্রায় ১৬০০, ভোটার ৭৫০। টোটো সম্প্রদায়ের পুরুষরা এখন পরিযায়ী শ্রমিক, তারা আসেন কত বছর পর ঠিক নেই, অনেক পরিবার হারিয়ে যাচ্ছে। 

ধনঞ্জয় টোটো বলেন,

পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে কাজ করতে দুবাই অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতি বাড়ির পুরুষরা চলে গেছে। টোটোপাড়ায় টোটোরা কমছে। আমরা ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি, আমরা হিন্দু নই, তবু আমাদের হিন্দু সাজানো হচ্ছে! এটা এক নতুন বিপদ টোটোদের কাছে। আর ৭৫০ জন ভোটার কি ভাবছে, আমলও দিতে চান না নেতামন্ত্রীরা! 

৮.০৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার টোটোপাড়ায় কোনো মন্দির মসজিদ বা ধর্মস্থান নেই। বড় গাছের নিচে ধূপ প্রদীপ জ্বলে। সুপুরি এবং এলাচ সাথে কমলালেবু চাষ ছিল জীবিকা। কিন্তু পণ্য বাজারে নিয়ে যাওয়ার পথ নেই, ফলে ফড়েরা গাড়ি নিয়ে এসে কমদামে পন্য কিনে নিয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে সেই চাষ ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক টোটোরা।

বর্ষা টোটো এবার নবম শ্রেণির পড়ুয়া, তার কথায় ,

বেলা ১২ টায় স্কুল ছুটি হয়ে যায়। কোনো মাস্টার নেই, কে পড়াবে? 

টোটোপাড়ার স্থানীয় রেশন দোকান (ছবি জয়দীপ সরকার)

এই গ্রামের উচ্চ শিক্ষিত মানুষ ভক্ত টোটো। ব্যাঙ্ককর্মী ছিলেন এখন অবসর নিয়েছেন। আক্ষেপ করে তিনি দ্য ওয়্যার-কে বলেন,

আপনারা লুপ্তপ্রায় আমাদের জনজাতির খবর নিতে তিনটে নদী পার করে এলেন কিন্তু সরকার আসে না ভোট ছাড়া, আর এবার একটা এসআইআর ফর্মকে বা কারা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বলেছে স্কুলে গিয়ে গ্রামের এক নেতার কাছে জমা করতে। কে একজন বিএলও এভাবে বাড়ি বাড়ি ফর্ম পৌঁছে দিয়ে উধাও। এ গ্রামে কতজন মানুষ শিক্ষিত সেটা ভাবেনা সরকার! বাড়ির পুরুষরা বছরের পর বছর বাইরে পড়ে আছেন। অনেক পরিবারে মোবাইল ফোন নেই, আমাদের নম্বরে যোগাযোগ করে খবরাখবর নেয়, আমরা তাদের বাড়ি গিয়ে জানাই। কিন্তু এই উপেক্ষা অবহেলা কেন সরকারের? 

আরও পড়ুন

জলবায়ু সঙ্কটে জনশূন্য গ্রাম! একাকিত্ব যেভাবে গ্রাস করছে পুরুলিয়ার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের

গ্রামে পানীয় জলের সঙ্কট আছে। সরকারি পাইপলাইন কল বসলেও জল নেই, ভুটানের পাহাড়ি ঝর্ণার জলই ভরসা গ্রামবাসীদের। গ্রামে শুধু মোবাইল ফোন ইন্টারনেটে অবাধ গতি এসেছে, কিন্তু ব্যবহারকারী সংখ্যায় কম। গ্রামের বিএলও পরেশ নেওয়ার কিছুতেই সামনে এলেন না, ফোন করলে কেটে দেন। এত সংকোচ কেন তাঁর? গ্রামের শেষে বাজারে বসে এক প্রবীণ মানুষ সুরেন টোটো বলেন,

বিএলও যে হয়েছে সেতো স্কুলের মাস্টার। কী ভাবে চাকরি পেল এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। টোটোপাড়ায় টোটোদের শিক্ষিত এত ছেলে থাকতেও তাদের বাদ দিয়ে নেপালি ছেলেটিকে শিক্ষকের চাকরি দিল, কারণ তাঁকে দিয়ে ভোট করায় শাসক দল। ফলে সে এড়িয়ে চলে এলাকাবাসীদের। 

কিন্তু এড়িয়ে চললে তথ্য দিয়ে ফর্ম ফিল আপ করবে কে? উত্তর আসে,

 ওরাই সরকার, ওরাই শিক্ষক, ওরাই সব! 

অনটনের ছবি গ্রাম জুড়ে। ভক্ত টোটো বলেন,

আশির দশকের শেষে গ্রামে প্রথম দু'টো স্কুল হয়, এখন সে স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। নব্বইয়ের শুরুতে টোটোপাড়ায় সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয় বিরাট জায়গা নিয়ে। এখন সেখানে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার বেশি কিছু করার সুযোগ নেই, কারণ চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী পরিকাঠামো কিছুই নেই। নেতা মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক সবাইকে বহুবার বলেও কোন সাড়া পাইনি। টোটোরা এরপর হয়তো হারিয়ে যাবে, কারণ এখানে হতাশা ছাড়া কিছু নেই, যেটা আছে তা নিজেদের ঐতিহ্য। সেটা রক্ষার চেষ্টা করছি। 

টোটোপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা (ছবি: জয়দীপ সরকার)

কিন্তু টোটোপাড়ায় এত বহিরাগত অন্য দেশের মানুষ এলেন কী করে? নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষরা মুখ খুলতে নারাজ, ছবিও তুলতে বাধা দেন তাঁরা। তবে এক স্থানীয় এক প্রবীণ বলেন,

২০ বছর আগেও আমরা পাহাড় টপকে কমলালেবু এলাচ সুপারি এসব বোঝা বয়ে এ গ্রামে এনে এখানে থাকতাম তারপর শহরে বিক্রি করতে যেতাম। আমাদের গ্রামে নিজের বাড়ি থেকে নুন আনতে গেলেও পাহাড় বন টপকে ১৫ ঘন্টা হাঁটতে হয়। ফলে সবাই ভালো থাকার আশায় এখানে বসতি করেছি। এটা সত্যি যে আমাদের কোনো দলিল বা জমির রেকর্ড কিছুই নেই। এখন শাসক দল সহায়তা করায় খাস জমির উপর বাড়ি করে বসবাস করছি, আমাদের লোক নেতা হচ্ছে মাস্টার হয়েছে। কিন্তু এখন এসআইআর-এর ভয়ে অনেকে বাইরে চলে গেছে। ২০০২-এর ভারতীয় ভোটার লিস্টে নাম নেই আমাদের কারও!

টোটো সম্প্রদায়ের মানুষের লুপ্তপ্রায়, অনটন আর সামাজিক রাজনৈতিক চাপে তাদের আরও সঙ্কটে ফেলছে।এসআইআর কি নিজের মাটিতে বেঁচে থাকার হদিশ দিতে পারবে টোটোদের? প্রশ্ন টোটোপাড়ার।

 

(মূল প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ভাবে দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশিত হয়েছিল।)

More Articles