লুইজ থেকে লোডিং ক্রেন: খিদিরপুর ডকের ১৩৩ বছরের যাত্রাপথ

Khidirpur Dock: সুকুমার সেন, 'বাংলার স্থাননাম' গ্রন্থে, খিদিরপুরের নামের ব্যাখ্যা হিসেবে বলেছেন, এটি খিঞ্জিরপুরের অপভ্রংশ। আরবি শব্দ খিঞ্জিরের অর্থ হল শুয়োর। একসময় গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে শুয়োর দেখা যেত।

 ১৮৯২ সাল...

উদ্বোধন হয়  খিদিরপুর ডক-I-এর... ব্রিটিশ স্কুনার ‘লুইজ’ প্রথম জাহাজ হিসেবে প্রবেশ করে...হাজারো মানুষের উল্লাস...জাহাজের পাল খোল... এবং হুগলির জলে তার প্রতিফলিত আলো।

২০২৫ সাল... 

হুগলি নদীর জলে সূর্যাস্তের লাল আভা পড়ছে... দূর থেকে ভেসে আসছে জাহাজের ভোঁ...  ক্রেনের ধাতব শব্দ মিশে যাচ্ছে শহরের কোলাহলে...আধুনিক খিদিরপুর ডকে কার্গো হ্যান্ডলিং...জাহাজ আর ক্রেনের ব্যস্ততা।

 কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন খিদিরপুর ডক,

ভারতের সবচেয়ে প্রাচীনতম নদীবন্দর, যার গল্প শুরু হয়েছে প্রায় এক শতাব্দী আগে...

ষোড়শ শতাব্দীতে যখন পর্তুগিজ নাবিকরা এই নদীপথে এসে বাণিজ্য শুরু করে। কিন্তু আসল গল্পের শুরুটা হয়  ১৬৯০ সালে, যখন জব চার্নক কলকাতা প্রতিষ্ঠা করেন। হুগলির তীরে ছোট-ছোট ঘাট থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলো চা, পাট, তুলা নিয়ে আসত ইউরোপ থেকে, আর ফিরে যেত ভারতীয় মশলা এবং রেশম নিয়ে। আজকের কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা আধুনিক বন্দর। বন্দর হওয়ার আগে গঙ্গাপাড়ে জাহাজ নোঙর ফেলত ঠিকই, কিন্তু ব্যবসার প্রসার ঘটানোর জন্য বৃহৎ আকৃতির জাহাজের প্রবেশের প্রয়োজন ছিল। চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল ১৮৪২ সাল থেকে। চিন্তাভাবনা শুরু করে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স। ১৮৫৩ সালে চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠিত হলেও, ১৮৩৩-৩৪ সাল থেকেই এরা অল্প-বিস্তর কাজ করা শুরু করেছিল। ১৮৭০ সালে ভারতের প্রথম পোর্ট ট্রাস্ট, কলকাতা পোর্ট কমিশনার্স (Calcutta Port Commissioners) গঠিত হয়। যদিও এর এক বছর আগে থেকেই ভারী যন্ত্রের সাহায্যে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়েছিল খিদিরপুর ডকে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৮৪ সালে খিদিরপুর অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হয়েছিল বন্দর তৈরি করার জন্য। জমি পাওয়ার পর জোর কদমে কাজও শুরু হয়েছিল, অবশেষে ১৮৯২ সালে বন্দর নির্মাণ শেষ হয়। লর্ড কাইড নামক একজন প্রকৌশলী এই ডকের লক-গেট সিস্টেম ডিজাইন করেন, যা জোয়ার-ভাটার প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করে  জাহাজগুলোকে নিরাপদে রাখত। 

আরও পড়ুন- যে বাসে বসে শহর দেখত কলকাতা: লাল ডাবল ডেকারের স্মৃতিচারণ

এই সময়ে যান্ত্রিক উপায়ে জলের গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিও শুরু হয়েছিল। ২০ই জুন, ১৮৯২ সাল... বিশাল আকৃতির ব্রিটিশ জাহাজ লুইজ প্রবেশ করেছিল কলকাতা বন্দরে। তখন থেকেই কলকাতা বন্দর হয়ে উঠল ব্যবসা-বাণিজ্যের আঁতুড় ঘর। ১৯০২ সালে খিদিরপুর ডক II -এর কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জর্জের নামে কলকাতা বন্দরে গড়ে তোলা হয়েছিল আরও একটি বৃহৎ আকৃতির ডক, স্বাধীনতার পর তার নাম হয়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র ডক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্দর আরও আধুনিক হয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন উপনিবেশে, আখ উৎপাদনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তার জন্য বিপুল পরিমাণে শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ত।  বন্দর গড়ে ওঠার আগেই, ১৮৩১ সাল থেকে, ভারতীয় শ্রমিকদের প্রেরণ করা হতো বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে। বন্দর আধুনিক হয়ে উঠলে শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যাও  বাড়তে থাকে। লাখ লাখ শ্রমিক পাঠানো হতো মরিশাস, ত্রিনিদাদ, জামাইকা, পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের অন্য দেশে পাঠানোর আগে শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হতো গঙ্গার পাড়েই।

প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কলকাতা বন্দর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা গ্রাস করেছিল খিদিরপুরকে। আসলে এই বন্দর ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের দূর প্রাচ্যের 'সাপ্লাই লাইন'। আর এই 'সাপ্লাই লাইন'টিই বন্ধ করতে চেয়েছিল জাপান। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৪২ সালের ২০ই ডিসেম্বর এয়ার স্ট্রাইক করেছিল জাপান বোমা ফেলে। কলকাতা বন্দর এলাকাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। এরপর বেশ কয়েকবার বোমাবর্ষণ করা হয়। খিদিরপুর ডক ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ধ্বংস হয়েছিল একাধিক ঘরবাড়ি, মৃত্যু মিছিল দেখেছিল সেই সময়ের কলকাতা। মূলত সূর্যাস্তের পর বোমাবর্ষণ করা হতো। তাই, সারা কলকাতাকে অন্ধকার করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। বোমা পড়ে, কিন্তু বন্দরটি টিকে যায়। পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে এটি টিকে থাকে। স্বাধীনতার পরও এটি ছিল ভারতের প্রধান দ্বার। চা-পাটের রপ্তানি, কয়লার আমদানি– সবটাই হতো এই ডকের মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালে মেজর পোর্ট ট্রাস্ট অ্যাক্টের অধীনে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট গঠিত হয়। ২০২০ সালে এটির নামকরণ করা হয় 'শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট'। আজও খিদিরপুরের আকর্ষণ অমলিন। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে আজকের খিদিরপুরের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কিন্তু, আজকের খিদিরপুর ডক এক শতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষী। 

পুরনো খিদিরপুর অঞ্চল

খিদিরপুরের নাম এল কীভাবে, এই নিয়ে রয়েছে বিস্তর চর্চা- 

সালটা ১৭৫৭...

পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছেন...কলকাতায় ইংরেজরা জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে...

এই অঞ্চলের জন্ম হয় পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, কলকাতা তখনও কল্লোলিনী হয়ে ওঠেনি। পলাশির যুদ্ধের পর বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর, পাকাপাকি ভাবে কলকাতা সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে ইংরেজদের  সবথেকে শক্তিশালী ঘাঁটি হয়ে উঠল, কিন্তু তখনও পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষ দখল করে উঠতে পারেনি ইংরেজরা। এরপর ঠিক হল ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ তৈরি করবে, যা আজকের ফোর্ট উইলিয়াম নামে পরিচিত। যার জন্য জমির বন্দোবস্তও করা হলো, ১৭৬৭-৬৯ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন হ্যারি ভেরেলেস্ট এবং তার দেওয়ান হিসেবে পরিচিত ছিলেন জয়নারায়ণ ঘোষাল, যে অঞ্চলটিতে আজকের ফোর্ট উইলিয়াম স্থাপিত, তা আসলে ঘোষাল পরিবারেরই জমি ছিল। গভর্নরসাহেব ঘোষাল পরিবারের থেকে জমি সংগ্রহ করলেন এবং তার পরিবর্তে জয়নারায়ণের পরিবারকে খিদিরপুর অঞ্চলের জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন খিদিরপুর ছিল জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকা, প্রায় ১০৮ বিঘা জঙ্গল পরিষ্কার করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঘোষালদের রাজবাড়ি। যার নাম দেওয়া হয়েছিল 'ভূমি কৈলাশ রাজবাড়ি'। 

ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে কিড সাহেব এখানে একটি ছোট-খাটো ডক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হয়তো সেই থেকেই, এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল 'কিডারপুর', জনমুখে যা ধীরে ধীরে খিদিরপুরে পরিণত হয়েছিল। 

আরও একটি জনমত অনুযায়ী, এখানে নাকি খাজা খিজির নামে জনৈক এক পীর বসবাস করতেন, যাকে কমবেশি দইয়ার পীর বলা হয়ে থাকে, এই খিজির শব্দ থেকেই পরবর্তী কালে খিদির শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। অথবা, বন্দরের নাম 'খিদিরপুর' এসেছে ইসলামী সাধু খিদর থেকে, যিনি জলের রক্ষক হিসেবে পরিচিত। 

অনেকের মতে আবার, একসময় এই অঞ্চলে খয়ের ব্যবসার রমরমা ছিল, ঘটনাচক্রে, খয়েরের বিশুদ্ধ নাম খিদির, সেখান থেকেই নাকি খিদিরপুর নাম এসেছে।

সুকুমার সেন, তাঁর 'বাংলার স্থাননাম' গ্রন্থে, তিনি খিদিরপুরের নামের ব্যাখ্যা হিসেবে বলেছেন, এটি খিঞ্জিরপুরের অপভ্রংশ। আরবি শব্দ খিঞ্জিরের অর্থ হল শুয়োর। একসময় এই গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে শুয়োর দেখা যেত। তা থেকেই হয়তো প্রথমে খিঞ্জিরপুর এবং তা পরে খিদিরপুরে পরিণত হয়েছে।

গঙ্গাপাড়ের এই অঞ্চল বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থান। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেম চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতো মানুষজন এখানে বসবাস করতেন।

আজকের খিদিরপুর ডক

এই বন্দরটি শুধু বাণিজ্য নয়, জীবনের অংশ। একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। এখানে মন্দির, মসজিদ এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। জয়নারায়ণ ঘোষালের নির্মিত শিব মন্দিরটি ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো। এলাকাটি বহুসাংস্কৃতিক, যেখানে বাঙালি, মারোয়াড়ি, মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা বাস করেন। প্রাচীন শিব মন্দির, মসজিদ, আর রাস্তায় চায়ের দোকানে বসে শোনা যায় খিদিরপুর ডকের পুরনো সব গল্প।

বিশ্বে হাজার হাজার বন্দর রয়েছে– সাংহাইয়ের বিশালতা, সিঙ্গাপুরের ব্যস্ততা, মুম্বইয়ের আধুনিকতা। কিন্তু খিদিরপুরের মতো ঐতিহ্য আর আবেগ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খিদিরপুর বন্দর কলকাতার ঐতিহ্যের প্রতীক, যা ঔপনিবেশিক যুগ থেকে আধুনিক ভারতের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এর ইতিহাস বাণিজ্য, যুদ্ধ এবং উন্নয়নের গল্প বলে। নদীর গভীরতা কমছে, পরিবেশগত অসুবিধে বাড়ছে, কিন্তু সরকারের আধুনিকীকরণ– নতুন টার্মিনাল, নদীর পলিখনন– এটিকে নতুন প্রাণ দিচ্ছে। নেপাল, ভুটান থেকে পূর্ব ভারত– ভারতবর্ষের সকল স্থানের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে এই বন্দর। ভবিষ্যতে পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এই বন্দরটি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, কলকাতার জীবনধারার অংশ। এটি শুধু একটি বন্দর নয়, কলকাতার হৃদস্পন্দন। খিদিরপুর একমাত্র নয়, কিন্তু অনন্য। এর গল্প বাণিজ্যের, সংগ্রামের, আর অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের। হুগলির জলে ভাসতে ভাসতে এই বন্দর যেন বলে ওঠে– আমি এখনও জীবিত, আমি কলকাতার আত্মা।

More Articles