'মিরাকল' না কি বিজ্ঞান, ঐন্দ্রিলা ফিরে এলেন মানুষের ইচ্ছাশক্তিতেই?
Oindrila Sharma Fights Back: চিকিৎসকরাও কোথাও ‘মিরাকল’ ঘটার আশা করেন। দাঁতে দাঁত চেপে, হাতের মুঠো শক্ত করে “যেন সব ঠিক হয়ে যায়” বলা চরম যুক্তিবাদী মানুষের ওই একটি শব্দে লুকিয়ে থাকে উইল পাওয়ার, ‘যেন’।
হার্টরেট ৪০-এর নীচে। রক্তচাপ ৬০/৩০। ভেন্টিলেশনের শীতে রোগীর ‘কোল্যাপস’ করে যাওয়ার জন্য সমস্ত মাপকাঠিই একটা খাদের ধারে। এতটাই ধারে যে আঙুলের নরম ধাক্কাতেই তলিয়ে যেতে পারে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে একফালি উপত্যকা যেন। এখান থেকে ফিরব বললেই ফেরা যায় না কি! যায়, ঐন্দ্রিলা ফিরলেন। তাবড় তাবড় আশাবাদীও যখন মৃদু ঘাড় নাড়িয়েছেন ডাইনে-বাঁয়ে, ঐন্দ্রিলার রক্তহীন ফ্যাকাশে হাত নড়ে উঠেছে। ভেন্টিলেশনের শীতের মধ্যে জেগে উঠেছে জীবনের এক ছটাক রোদ্দুর! ঐন্দ্রিলা জেগে উঠেছেন। জেগে উঠেছে সব্যসাচীর ‘ফিরিয়ে আনবই’ বলা দীপ্তি!
রোমিও-জুলিয়েট, হীর-রাঞ্ঝা, সেলিম-আনারকলি- এসব প্রেমের জুটির উদাহরণের পাশে সারা বাংলা দিন কয়েক আগে নিজস্ব বাঙালি অমর প্রেমগাথা খুঁজে পেয়েছে। ঐন্দ্রিলা-সব্যর মধ্যে পৃথিবীর যা কিছু শুভ তার আদল খুঁজতে শুরু করেছেন মানুষ। ভালোবাসায় ধাক্কা খাওয়া বহু মানুষ, চোট সামলে আইকনিক প্রেমের দোয়া পড়েছেন। সব্বার ভালোবাসা, প্রার্থনা মিলে যে বলয় তৈরি করেছে ঐন্দ্রিলাকে ঘিরে তারই মাঝে, দেহে অজস্র নল লাগানো, বিছানায় প্রায় মিশে যাওয়া ফ্যাকাশে মেয়েটি চোখ মেলেছে। ঐন্দ্রিলা ফিরলেন, তাঁকে ফেরাল কে? প্রেমিক-বন্ধু সব্যসাচী দীর্ঘ পোস্টে জানিয়েছেন কীভাবে ‘মিরাকল’ ঘটেছে! সব্যসাচীর কথা অনুযায়ী,
আরও পড়ুন- ঠিক কী হয়েছে ঐন্দ্রিলার, প্রাণঘাতী এই রোগ হানা দিতে পারে যখনতখন, উপসর্গ কী
“পরশুদিন সকালে ঐন্দ্রিলার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, চোখের সামনে দেখলাম ওর হার্টরেট ড্রপ করে চল্লিশের নিচে নেমে তলিয়ে গেল, মনিটরে ব্ল্যাঙ্ক লাইন, কান্নার আওয়াজ, তার মাঝে ডাক্তাররা দৌড়াদৌড়ি করছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে হৃদস্পন্দন ফের ফিরে এল বিভিন্ন সাপোর্টে, হার্টবিট ১২০। তারপরই কে যেন একটা অদৃশ্য বালিঘড়ি উল্টো করে ঝুলিয়ে দিল, ঝুরো বালির মতোন সময় ঝরে পড়ছে, সাথে স্থিরভাবে একটা একটা করে হার্টবিট কমছে, কমছে রক্তচাপ, কমছে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস। ডাক্তাররা জবাব দিয়েছেন, হসপিটালের নিচে পুলিশ পোস্টিং, বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ এসে সমবেদনা জানাচ্ছেন, কিছু উত্তেজিত ইউটিউবার এবং মিডিয়ার লোকজন নিচে ঘোরাঘুরি করছেন। শেষ চেষ্টার জন্য অন্য হাসপাতালের এক নামকরা নিউরোসার্জনকে ডেকে আনা হলো, তিনি খানিক নাড়াচাড়া করে জানালেন যে,
“ও চলে গেছে অনেক আগেই, শুধুশুধু এইভাবে আটকে রাখছেন কেন? এমনিতেও কালকের মধ্যে সব থেমেই যাবে। লেট্ হার গো পিসফুলি।”
রাত বাড়ল, দাঁতে দাঁত চিপে একটা ছোট্ট অসাড় হাত ধরে বসে আছি, চোখ দুটো অনেক আগেই ডাইলেটেড হয়ে গেছে, একটা করে বিট কমছে আর অসহায়তা বাড়ছে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আগেই দেখা করে গেছে। লোকজন মাঝেমধ্যেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে যে ‘আজ রাতেই হবে? নাকি সকালে আসব?’
ইতিমধ্যে ফেসবুকের কল্যাণে কারা যেন মাঝরাতে ছড়িয়ে দিয়েছে যে ঐন্দ্রিলা আর নেই। বানের জলের মতোন হুহু করে ফোন ঢুকতে শুরু করল, সৌরভ শুটিংয়ে বাইরে গেছে, দিব্য একা সামলাতে পারছে না। অগত্যা ঠেকা দেওয়ার জন্য আমি পোস্ট করতে বাধ্য হলাম, মিনিট কুড়ির মধ্যে আবার সব শান্ত। সকাল থেকে রক্তচাপ কমতে শুরু করলো, ওর বাবা-মা কে ডাকলাম, বাকিদের খবর দিলাম। গতকাল আর বাধা দিইনি কাউকে, সারাদিন ধরে কাছের মানুষরা এসেছে, ওকে ছুঁয়েছে, ডুকরে কেঁদেছে। কত স্মৃতিচারণ, কত গল্প। বিকেলের পর দেখলাম হাত, পা, মুখ ফুলছে ঐন্দ্রিলার, শরীর ঠান্ডা। হার্ট রেট কমতে কমতে ৪৬, বিপি ৬০/৩০। আগের দিনের ডাক্তারের কথাটা কেবলই আমার মাথায় ঘুরছিল, ওর শরীরটাকে এভাবে আটকে রাখার জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে, থাকতে না পেরে ওর মাকে বললামও যে এত কষ্ট আর দেখতে পারছি না, কী দরকার ছিল এত কিছু করার, শান্তিতে যেত। মুখে বলছি বটে, কিন্তু ছাড়তে কি আর পারি, মায়ার টান বড় কঠিন।
ঠিক রাত আটটায় যখন আমি বিমর্ষমুখে নিচে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ হাত নড়ে ওঠে ঐন্দ্রিলার। খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি হার্টরেট এক লাফে ৯১, রক্তচাপ বেড়ে ১৩০/৮০, শরীর ক্রমশ গরম হচ্ছে। কে বলে মিরাকেল হয় না? কে বলে ও চলে গেছে? এক প্রকার অনন্ত শূন্য থেকে এক ধাক্কায় ছিটকে ফিরে এল মেয়েটা। গেছে বললেই ও যাবে না কি, যেতে দিলে তো যাবে।
এই মুহূর্তে ঐন্দ্রিলা একপ্রকার সাপোর্ট ছাড়াই আছে, এমনকী ভেন্টিলেশন থেকেও বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আগে ক্লিনিক্যালি সুস্থ হোক, নিউরোর কথা পরে ভাবব।
ঈশ্বর ফেসবুক করেন না আমি জানি, তাই লিখেছিলাম মন থেকে প্রার্থনা করুন, ‘ফোন’ থেকে করুন লিখিনি।
চিকিৎসাশাস্ত্রে যে বিজ্ঞানই শেষ কথা, আমি সে কথাও জানি। তবে পরপর তিনজন নিউরোসার্জন যদি বলেন ‘ঈশ্বরকে ডাকুন’, তাহলে আর না ডেকে উপায় কী? ওঁদের তুলনায় আমি নিতান্তই অশিক্ষিত। তবে কেবল আমি একা নই, মুর্শিদাবাদের প্রতিটা মন্দির, প্রতিটা মসজিদে মানুষ ওর জন্য প্রার্থনা করেছে। বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন প্রসাদ এবং অজস্র আশীর্বাদী হাসপাতালে এসেছে নিয়মিত। তোমাদের সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ছোট করতে পারব না। অনেকে অবশ্য হেসেছে বা অপমান করেছে, তাতেও আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করিনি। এই ক্ষুদ্র জীবনে বহুবার কাদায় পড়েছি তো, তাই গায়ের চামড়া বেশ মোটা হয়ে গেছে।
তবে হ্যাঁ, কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
প্রথমত, এ কথা ঠিক যে ঐন্দ্রিলার প্রথম থেকে যা যা হয়েছে তা যথেষ্টই অপ্রাকৃত। কিন্তু তা বলে সেটা নিয়ে এত মাতামাতি করলে তা বাকি পেশেন্টদের একপ্রকার অপমান করা হয় বলে আমি মনে করি।
দ্বিতীয়ত, চিকিৎসার খরচ নিয়ে লেখালিখি বন্ধ করা উচিত, পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ীই চিকিৎসা হবে, এখনো অবধি কারও কাছে এক পয়সাও অর্থসাহায্য চাওয়া হয়নি অথবা কারও থেকে এক পয়সাও গ্রহণ করা হয়নি। তাই এটা নিয়ে লেখা মানে ঐন্দ্রিলাকে অপমান করা এবং তার পরিবারকে ছোট করা। নিজের অপমান গায়ে মাখি না ঠিকই কিন্তু ওর অপমানে আমার গায়ে ফোস্কা পড়ে।
তৃতীয়ত, একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ চেষ্টা করে তার কাছের মানুষের পাশে থাকতে, বিপদে পড়লে খড়কুটো অবধি আঁকড়ে ধরতে। সেটাই তো এতদিন স্বাভাবিক বলে জেনে এসেছি। আমার মা অসুস্থ হলে, বাবা যেমন দৌড়াদৌড়ি করেন, গত দুই বছর ধরে আমিও সেটাই করেছি। তাই কিছু পুরোনো ছবি আর ভিডিও সাজিয়ে, গান বাজিয়ে সেটাকে গ্লোরিফাই করা বন্ধ করা উচিত। এমনকী একটা লকডাউনের সময়কার তারাপীঠের ভিডিও পর্যন্ত ঐন্দ্রিলার নাম করে ঘুরপাক খাচ্ছে দেখলাম। আমি ঠিক জানি না, এগুলো করে বোধহয় তোমাদের চ্যানেল বা পেজ পয়সা পায় কিন্তু বিষয়টা আমার চোখে খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। ইহ জীবনে কয়েক শত জুটিকে দেখেছি এসএসকেএমের বাইরের ফুটপাথে রাত কাটাতে, ভালোবাসে বলেই তারা থাকে।
তবু পরিচিত মুখ বলে আমরা চর্চিত হই, তারা নয়। আসলে কী জানো, সে খবর বিক্রি হয় না।
সর্বশেষে বলি, মানুষের গায়ে আজকাল বড়ই শকুন শকুন গন্ধ পাই। গত দুইদিন ধরে হাসপাতালের নিচে বেশ ভিড় জমেছিল, ওর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে কাল রাত থেকে একেবারে খাঁ খাঁ করছে।
তবে গত দু'দিনের এত নেগেটিভিটির মাঝে একটা মাত্র মানুষ আমায় কিছু তথ্য দিয়ে প্রথম আলোর দিশা দেখায়, যার সঙ্গে সারাদিন নির্দ্বিধায় চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করি, তিনি অরিজিৎ সিং।
ঐন্দ্রিলা আছে। ঐন্দ্রিলা থাকবে।
রাখে বড়মা, তো মারে কোন..”
আরও পড়ুন- লড়ে দেখালেন ঐন্দ্রিলা, এভাবেও ফিরে আসা যায়
মানুষের গায়ে, সোশ্যাল মিডিয়ার দেহে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার হুজ্জুতিতে শকুন-শকুন গন্ধ পেয়েছেন সব্যসাচী। তবু, এসব পচা গলা গন্ধের মাঝেও ঢালাও মানুষের শুভকামনা ঠিক গলিঘুঁজি হয়ে পৌঁছেছে ঐন্দ্রিলার সেই শীতঘুমে। সব্যসাচী বলছেন অপ্রাকৃত, সব্যসাচী বলছেন মিরাকল, সব্যসাচী বলছেন বড়মার ভরসার কথা। মানুষ বলছেন প্রার্থনার জয়ের কথা। যে খাদের ধারে আলতো টোকার কথা বলছিলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে চিকিৎসররা হামেশাই বলে ফেলেন, “এবার ঈশ্বরকে ডাকুন”। এমন নয় যে, চিকিৎসকরা রোগীদের, রোগীদের পরিবারের সকলকে আস্তিক বলে কমন নিয়ে ফেলেন। চিকিৎসকরাও কোথাও ‘মিরাকল’ ঘটার আশা করেন। দাঁতে দাঁত চেপে, হাতের মুঠো শক্ত করে “যেন সব ঠিক হয়ে যায়” বলা চরম যুক্তিবাদী মানুষের ওই একটি শব্দে লুকিয়ে থাকে উইল পাওয়ার, ‘যেন’। বাংলায় আদর করে আমরা এই ‘যেন’কেই ইচ্ছাশক্তি বলি।
শাহরুখ বলেছেন, “অগর কিসি চিজ কো সচ্চে দিল সে চাহো…”, নীতিকথা বলেছে, “হোয়্যার দেয়ার ইজ উইল, দেয়ার ইজ পাওয়ার,” মানুষ বলেছেন ঐন্দ্রিলা জিতবেই। সব্যসাচীও বলেছেন, “ফিরিয়ে আনবই”। মানুষের শরীরের কলকব্জা কি সেই আর্জি শুনতে পায়? মেশিন কি মানুষের ইচ্ছার গন্ধ পায়? উইল আর পাওয়ারের মধ্যে আসলে আপামর প্রেমিক-প্রেমিকা, জ্যেষ্ঠ অভিভাবকরা, শুভানুধ্যায়ীরা যে বিশ্বাসের জয় চেয়েছিলেন তাই ঘটেছে। শুমাখারের কোমার সময়ও এই মিরাকলের উপর আস্থার কথা ভেসে এসেছিল। ফর্মুলা ওয়ান রেসার ১১ মাস ঘুমিয়েছিলেন। ১১ মাস! শরীর এক আশ্চর্য রহস্য, শক্তি আরেক বিস্ময়। খাদের ধার থেকে ফিরে আসা যায়, এই মিরাকলকে কেউ নাম দেন ‘ঈশ্বর’, কেউ ডাকেন বিজ্ঞান। নামে কী বা আসে যায় বললে অবশ্য সামান্য ভুল হয়ে যায় এক্ষেত্রে।