ছিল কুষ্ঠরোগীদের নিরাময়ের স্থল, এখন তাক লাগানো সমুদ্র! কলকাতার কাছেই রয়েছে এই খাজানা
Offbeat Sea Beaches near Kolkata: বগুড়ান জলপাইয়ে সমুদ্রও কিন্তু বেশ লুকোচুরি খেলায় মাতে৷ স্থানীয়দের কথায়, দুপুর ১২ টা ও রাত ১০ টায় বিচের কাছে আসে সমুদ্র। বাকি সময় তার রূপ ধরা পড়ে না৷
ইচ্ছে থাকলেও দেশ বিদেশে ঘোরার সুযোগ হয়তো অনেকেরই হয় না। আর কোনও প্রদেশের পর্যটক এতে হতাশ হয়ে পড়লেও বাঙালি পর্যটকরা খুব বেশ হতাশ হন না। কারণ পাহাড় হোক বা সমুদ্র, জঙ্গল কিংবা ঐতিহাসিক স্থল বাঙালির কোনও কিছুরই অভাব নেই। তাই অর্থ বা সময় কম খরচ করেই বাঙালি পর্যটকরা ইতিউতি ঘুরে আসতে পারেন। এই যেমন সমুদ্রের কথাই ধরা যাক! পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের উপকূলবর্তী এলাকাকে ঘিরে রেখেছে বঙ্গোপসাগর। সেদিকের যেখানেই যান না কেন সমুদ্র পেয়েই যাবেন। দক্ষিণ ভারতের সমুদ্র সৈকতের মতো আমাদের বাংলার সমুদ্র সৈকতগুলি বাইরে খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও তাতে বয়েই গেল! বাঙালির কাছে এই সৈকতগুলি এক একটা সোনার খনি।
কলকাতার খুব কাছেই এক পাল সমুদ্র সৈকত রয়েছে। সেগুলি যেমন সুন্দর তেমনই পকেট ফ্রেন্ডলি। দেশে বিদেশের সমুদ্র সৈকতগুলির মতো সেখানে গেলে হাজার হাজার টাকা উড়ে যায় না। আর এখানকার আবহাওয়া সারাবছরই মনোরম। যাঁরা বর্ষায় সমুদ্রে যাননি তাঁরা এই বেলা এই সমুদ্র সৈকতগুলি থেকে ঘুরে আসতেই পারেন। সমুদ্রের উপর বৃষ্টি ঝরে পড়ার দৃশ্য দেখার যে অপূর্ব অনুভূতি তা জীবনে অন্তত একবার উপভোগ করা উচিত। আর শীতের দিনে দু’ চারদিনের জন্য নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে চাইলে এইসব সৈকতের ধারে হেঁটে বেড়ানোতেই মিলবে নিবিড় প্রশান্তি।
চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকত
চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকত ওড়িশার পুরী জেলাতে কোণারকের সূর্য মন্দিরের তিন কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত, এটি পুরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। আগেকার দিনে চন্দ্রভাগাকে কুষ্ঠরোগীদের প্রাকৃতিক নিরাময়ের জায়গা হিসাবে বিবেচনা করা হত। ধারণা করা হয় যে, কুষ্ঠ নিরাময়ের পর সাম্বা (কৃষ্ণের পুত্র) চন্দ্রভাগা নদীর মুখে সূর্য দেবতার উপাসনা করেছিলেন। আরেকটি প্রাচীন আখ্যান অনুসারে, ঋষির কন্যা চন্দ্রভাগা তাঁর সৌন্দর্য দিয়েই সূর্যদেবকে আকর্ষণ করেছিলেন। প্রেমে পড়ে তাঁর করপ্রার্থনা করতে নামলেন সূর্যদেব। চন্দ্রভাগা সূর্যের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করলেন না। প্রেমের যন্ত্রণায় জর্জরিত সূর্য ভীষণ রূপে চন্দ্রভাগার পিছনে তাড়া করেছিলেন, তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে নিজেই হত্যা করেছিলেন। তাঁর এই ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই প্রতি বছর মাঘ মাসের পূর্ণিমা পাক্ষিকের সপ্তম দিনে, সমস্ত রাজ্য এবং বাইরের লোকজনও নদীতে পবিত্র স্নান করতে জড়ো হন। কোণারকে আগত অসংখ্য দর্শক চন্দ্রভাগাতে গাড়ি থামিয়ে দেন সৌন্দর্য উপভোগের জন্য। চন্দ্রভাগার কাছাকাছি একটি লাইট হাউজও দেখা যায়। সামুদ্রিক সম্পদে সমৃদ্ধ চন্দ্রভাগায় তাই এই শীত উপভোগ করতেই পারেন।
বগুড়ান জলপাই
সমুদ্র ভালোবাসেন না এমন পর্যটক হয়তো খুঁজলেও পাওয়া যাবে না৷ বিশেষ করে, সেটা যদি হয় একটু ভিন্ন ধরনের সমুদ্র। বগুড়ান জলপাই৷ এই ট্যুরিস্ট স্পট আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না৷ কাঁথি থেকে ১২ কিমি, কলকাতা থেকে গাড়িতে পৌঁছনো মোটেই কঠিন নয়৷ তাই সকাল সকাল রওনা দিন৷ একবার পৌঁছে গেলেই কয়েক লক্ষ লাল কাঁকড়ার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে খুঁজে পাবেন পিছাবনি নদী৷ নির্জন বিচ, ঘন ঝাউ বনের মধ্যে দিয়ে পিছাবনি নদী অচিরেই মন কেড়ে নেবে৷ আর সবচেয়ে বেশি যা মন ভরাবে তা হল নির্জনতা! দিঘা বা মন্দারমণির মতো গাদা গাদা হোটেল আর পর্যটকের ভিড় নেই এখানে৷ বিচের ধারে ঝুপড়ি হোটেলে হালকা জলখাবার মিলবে৷ বগুড়ান জলপাইয়ে সমুদ্রও কিন্তু বেশ লুকোচুরি খেলায় মাতে৷ স্থানীয়দের কথায়, দুপুর ১২ টা ও রাত ১০ টায় বিচের কাছে আসে সমুদ্র। বাকি সময় তার রূপ ধরা পড়ে না৷ বিপত্তি হল কয়েক কিমি কাদা পেরোনো। গুজরাতের কচ্ছের রানের মতো মাইলের পর মাইল জনহীন প্রান্তর। এখানে নরম কাদায় পা গেঁথে যায়। সেই ভাবেই অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়া৷ আর আছে লাল কাঁকড়ার প্রাচুর্য। দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সমুদ্রতীরে যেন লাল ফুল ছড়িয়ে রয়েছে সব সময়!
তবে আর পাঁচটা বিচের মতোই ভোরবেলা হাঁটতে বেশ লাগে এখানেও৷ তাই আগের রাতটা যারা দিঘায় কাটাবেন তাঁদের পক্ষে সুবিধাজনক হবে৷ কাদায় পা ডুববে ঠিকই, কিন্তু সেটাই অ্যাডভেঞ্চার! নদীর জলের মধ্যে দিয়ে চললে অবশ্য জলের তলায় কাদা কম। ৩ অথবা ৪ কিমি দূরে দিগন্ত আলো করে থমকে দাঁড়ানো গাঢ় কমলা রঙের এক অদ্ভুত সূর্যোদয়ের সাক্ষী হবেন হঠাৎই। ভোরের সোনালি আলোয় চকচকে সমুদ্রের দেখা মিলবে। পথে দেখা হবে বেশ কিছু বিচিত্র জলচরের সঙ্গে, জেলেদের সঙ্গে। তবে দয়া করে বিচে গাড়ি চালাবেন না৷ গাড়ি চললে প্রচুর কাঁকড়া বা ছোটো প্রাণী মারা যায়৷ প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এই দায় কিন্তু পর্যটকেরও।
বাঁকিপুট সৈকত
শহুরে জীবন থেকে দূরে প্রকৃতির মাধুর্য ও ঐশ্বর্যের মধ্যে জেগে থাকা এই সৈকতটি বাংলার সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন-মানচিত্রে আক্ষরিক অর্থেই এক নতুন সংযোজন। জনহীন, শুধু জল বাতাস আর পাখির ডানার শব্দ এই বেলাভূমিতে। আছে একটি নদীর রেখা। শান্ত, একাকী সেই জলধারা এই সৈকতকে যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে। যেহেতু পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়, তাই বাঁকিপুট সৈকত এখনও নির্জন। ঝাউগাছের ঘন অরণ্যে ঘেরা বেলাভূমি। কলকাতা থেকে সহজেই চলে যেতে পাড়েন সড়কপথে। ৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মেচেদা, দিঘা এবং কাঁথি পেরিয়ে বাঁকিপুট পৌঁছবেন। কাঁথি থেকে দূরত্ব ১৬ কিলোমিটারের মতো।
শহুরে কোলাহলে যদি ক্লান্ত হয়ে যান, নির্জনে ছুটি কাটানোর ইচ্ছে হয়, বাঁকিপুট তাহলে আদর্শ গন্তব্য। বেলাভূমিতে আপনার সঙ্গী হবে কেবল লাল কাঁকড়া। পা ছুঁয়ে যাবে সমুদ্রের ঢেউ। শব্দ বলতে পাখিদের ডাক। দূর দিগন্তে নৌকো এবং জাহাজদের চলাফেরা। মনে হবে মানবসভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপে রয়েছেন। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মায়াবী দৃশ্য কখনও ভোলার নয়। সম্ভবত বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে নিরিবিলি সৈকত এটি। বাঁকিপুট যেহেতু মোহনায় অবস্থিত, সমুদ্রকে কাছে পাওয়া যায় না সবসময়। জোয়ার এলে সমুদ্র ফুলে ফেঁপে ঢুকে পড়বে সৈকতে। ভাটার সময় কাদা মাখানো বালি চোখে পড়বে বেলাভূমির সামনে। তাতে মন খারাপের কিছু নেই। বিশাল ঝাউবনের সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেবে। কখনও কখনও মোহনার জলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। গামছা দিয়ে আপনিও মাছ ধরতে পারেন। খুব একটা সহজ কাজ নয়, তবে মজা প্রচুর। দরিয়াপুরের ৯৬ ফুট উঁচু বাতিঘরে যেতে ভুলবেন না। ছড়িয়ে থাকা সৈকত এবং দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের অসাধারণ মোহময় ভিউ পাবেন। পর্যটকদের জন্য বিকেল ৩ টেয় বাতিঘর খুলে যায়।
তালসারি সৈকত
সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালোবাসার মতো। সমুদ্রের ঢেউয়ের সামনে দাঁড়ালে নিজের দুঃখ, কষ্ট, সমস্যাগুলোকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। তালসারি সমুদ্র সৈকতে তাল গাছের সারির সঙ্গে সমুদ্রের লুকোচুরি খেলা চলে। ওড়িশার এই সৈকত শহুরে ব্যস্ততা ও কোলাহলের থেকে অনেক দূরে। তালসারির প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। সূর্যাস্ত দেখতে হলে সেরা বিকল্প তালসারিই। নারকেল আর কাজুর বাগানও রয়েছে বিশাল। তালসারির অন্যরকম সৈকতে একটা ছন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে একটু সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে। তালসারি সৈকতের অদূরে সুবর্ণরেখা নদী মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। মূল সৈকত বরাবর তৈরি হয়েছে ব্যাকওয়াটার চ্যানেল। জোয়ারে ব্যাকওয়াটার টইটম্বুর। ভাটায় জল নেমে যায়। তখন কর্দমাক্ত পথে সৈকতে পৌঁছানো যায়। জোয়ারের সময় ব্যাকওয়াটার চ্যানেল পেরোতে নৌকার সাহায্য লাগবে। তালসারির শান্ত পরিবেশে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের রং অপরূপ। ব্যাকওয়াটার ঘেঁষে রয়েছে মাছের আড়তও।
দাগারা সৈকত
সোনালি সৈকত, ঝাউয়ের জঙ্গল আর সন্ন্যাসী কাঁকড়ার দল- এই নিয়ে দাগারা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে লাল কার্পেট বিছানো আছে। একটু কাছে গেলেই বোঝা যায় অবাধে খেলে বেড়াচ্ছে আর শিকার ধরছে শ’য়ে শ’য়ে সন্ন্যাসী কাঁকড়া। একেবারে কাছে গেলেই তাদের আর দেখতে পাবেন না। আপনার পা ফেলে চলায় মাটিতে যে অনুরণন সৃষ্টি হবে তাতেই তারা সতর্ক হয়ে সেঁধিয়ে যাবে নিজেদের গর্তে। সৈকতে পদচারণা করুন, বিশ্রাম করুন, ঝাউবনে ঘুরে বেড়ান, আর দেখুন সৈকতে ডাঁই করে রাখা মাছ। সমুদ্র থেকে হরেক কিসিমের মাছ ধরে এনেছেন জেলেরা, আড়তদারেরাও হাজির। দর হাঁকাহাঁকি চলছে, আপনি শ্রোতা-দর্শক হয়ে তা উপভোগ করুন। আর মনোরম এই সাগরবেলায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকুন।