কোন কাজে কত টাকার ফারাক? কেন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে যান?

Migrant workers from Bengal: ২০১১ সালের আদমশুমারি বলছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় ৫ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন। মূলত দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে কাজে যান তাঁরা।

JP

সারা দেশ জুড়ে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের বেহাল দশা। কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে গিয়ে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন তাঁরা। কোথাও বাংলাদেশি সন্দেহে, কোথাও আবার শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার অপরাধে মার খেতে হচ্ছে। এমনকি, ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের আটক করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশেও পাঠানো হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ফিরতে হচ্ছে নিজের রাজ্যে। অথচ পশ্চিমবঙ্গেও স্থায়ী আয়ের কাজের সুযোগ খুবই সীমিত। কারণ ১০০ দিনের কাজ বন্ধ, আবাস যোজনার কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পেটের টানে যেতে হচ্ছে ভিন রাজ্যে।

ওড়িশা, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, রাজস্থান— প্রায় প্রতিটি রাজ্য থেকেই বাংলার শ্রমিকদের উপর আক্রমণের খবর সামনে আসছে। মূলত বাংলাভাষী মুসলিম শ্রমিকরা এই হামলার শিকার।

• মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের আব্দুল আলিম ওড়িশার মহাদেবনগরে নির্মাণকাজে গিয়ে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হয় আধার কার্ড ও প্যান কার্ড।

• রাজস্থানে রাস্তা বানানোর কাজে যাওয়া মালদহের আমির শেখ-কে বাংলাদেশি সন্দেহে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। পরে তাঁকে তুলে দেওয়া হয় বিএসএফের হাতে। আমির শেখ-কে জোর করে পুশব্যাক করা হয়েছিল বাংলাদেশে।

• মহারাষ্ট্রে পাঁচ বছর ধরে মিস্ত্রির কাজ করা নাজিমউদ্দিনও একই পরিণতির শিকার। শেষমেশ তাঁকেও বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়। বিএসএফ তাঁর থেকে ১৮ হাজার টাকা কেড়ে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় ৩০০ বাংলাদেশি রুপি।

• পূর্ব বর্ধমানের পলাশ অধিকারীও বাড়তি রোজগারের আশাতে বেঙ্গালুরুতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে এই দম্পতিকে আটক করে পুলিস। তারপর থেকে ১০ মাস জেলেই ছিলেন শুক্লা অধিকারী ও পলাশ অধিকারী। তাঁদের সঙ্গে কারাবন্দি অবস্থাতেই দিন কাটাছিল তাঁদের শিশু পুত্র আদিরও। 

আরও পড়ুন- দেশজুড়ে বাঙালি খেদাও অভিযান! কী বলছে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল?

• ওড়িশায় কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছিল হুগলির পরিযায়ী শ্রমিক দেবাশিস দাস-কে। ওড়িশার স্থানীয় পুলিস তাঁদের কাজের জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে যান। কী কী নথি আছে, তা দেখতে চাওয়া হয়। দেবাশিসের কাছে, পাসপোর্ট, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, জন্মের শংসাপত্র-সহ স্কুলের মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট ছিল। সেগুলো দেখালেও ছাড়া হয়নি।

কেন বাংলার শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন?

২০১১ সালের আদমশুমারি বলছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় ৫ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন। মূলত দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে কাজে যান তাঁরা। কারণ,

১)বাংলায় স্থায়ী আয়ের কাজ কম

২)নির্মাণ, কৃষি বা কারখানার কাজে মজুরি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কম

৩) বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরির সুযোগও কমছে

৪)মনরেগা অর্থাৎ ১০০ দিনের কাজও বন্ধ। আবাস যোজনাও কেন্দ্রীয় অর্থ ছাড়া প্রায় অচল

কী কী কাজে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন শ্রমিকরা?

নির্মাণকাজ: রাজমিস্ত্রি, রঙের কাজ, প্লাম্বিং, বিদ্যুৎ

কৃষিকাজ: ধান কাটা, গম কাটা, সবজি ক্ষেত

কারখানা: টেক্সটাইল, জুতো, চামড়া, লোহা-ইস্পাত

দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন বাগান: নারকেল, কফি, রাবার

এছাড়াও হোটেল, রেস্তোরাঁ, সিকিউরিটির মতো কাজের জন্য তাঁরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন।

একই কাজের জন্য ভিন রাজ্যে এবং বাংলায় যা মজুরি পান শ্রমিকরা

নির্মাণকাজ-

দিল্লি: দৈনিক ৬০০–২৭০০ টাকা
মহারাষ্ট্র: ২৭০০–২৮০০ টাকা
কেরল: ৮০০–২৯০০ টাকা
বাংলা: মাত্র ৩০০–৩৫০ টাকা

ইটভাটা-

ওড়িশা: ৫০০–২৬৫০ টাকা
ছত্তিশগড়: ২৫০০–২৬০০ টাকা
বাংলা: ২৫০–৩০০ টাকা

কৃষিকাজ-

পঞ্জাব: ৫০০–২৬০০ টাকা
হরিয়ানা: ২৪৫০–২৫৫০ টাকা
বাংলা: ২০০–২৫০ টাকা

আরও পড়ুন- ভিন রাজ্যে বাংলাভাষী নিগ্রহ, কী বলছে তরুণ বাঙালি লেখক সমাজ?

ফারাক স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা অপমানের আশঙ্কার কথা জেনেও বাধ্য হয়েই ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন। এখানে বলে রাখা দরকার সুজন সরকারের গল্প। মুর্শিদাবাদের ভগবানপুরের যুবক সুজন, প্লাস্টিকের জিনিস ফেরি করার কাজ নিয়ে ওড়িশায় গিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, বাঁচতে হলে হনুমান চল্লিশা পড়তে হবে। উলঙ্গ হয়ে প্রমাণ দিতে হবে তুমি মুসলিম নও। কোনো ভাবে সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন সুজন। তারপরেও নাগপুরে নতুন কাজে যেতে হয় তাঁকে। কারণ এ রাজ্যে থাকলে এত কম আয়ে সংসার চলবে না।

সরকারের উদ্যোগ

ভিন রাজ্যে শ্রমিকরা আক্রমণের শিকার হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছেন। সম্প্রতি ‘শ্রমশ্রী' প্রকল্প চালু করারও ঘোষণা করেছেন তিনি। প্রকল্প অনুযায়ী, বাইরে থেকে পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাজ্যে ফিরতে চাইলে তাঁদের এককালীন মাসে ৫,০০০ টাকা দেবে রাজ্য। নতুন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত ১২ মাস অবধি প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে তাঁদের।  আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি ওই শ্রমিকদের নতুন করে কাজ পাওয়ার জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন মমতা। ইতিমধ্যেই ৭৮ লক্ষ জব কার্ড তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, ২২ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক এতে উপকৃত হবেন। এছাড়াও স্বাস্থ্যসাথী-সহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা মিলবে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে শ্রমিক মহলে প্রশ্ন উঠছে, ৫০০০ টাকায় কি সংসার চলে? ভিন রাজ্যের তুলনায় রাজ্যের মজুরি এত কম হলে, কীভাবে তাঁরা টিকে থাকবেন? কেনই বা থাকবেন?

বাংলার শ্রমিকরা কাজের জন্য নিজের ভূমি ছেড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু ফিরতে হচ্ছে রক্তাক্ত, অপমানিত হয়ে। সংবিধান বলে—ভারতবর্ষ সকল ভাষা, জাতি ও ধর্মের দেশ। তাহলে কেন শুধু বাংলায় কথা বলার জন্য এতো নিগ্রহ? কবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবেন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা?

More Articles