ভাঙা বাড়ি, মানুষের মন || মোস্তার শহরের সর্বত্র যুদ্ধের স্মৃতি

Bosnia Tour : খেয়াল করলাম যে বর্ডার পেরনোর প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই আশেপাশের জীবনটা পালটে গিয়েছে। দেশের বেহাল অর্থনীতি যেন শহরের সর্বাঙ্গে লেপটে রয়েছে।

বসনিয়া যাওয়া হবে কি হবে না, এই দোলাচল অব্যাহত। আটচল্লিশ ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও বসনিয়ার ভারতীয় দূতাবাস থেকে কোনও উত্তর পেলাম না। অতঃপর গেলাম দুবরোভনিকের সরকারি ট্যুরিস্ট অফিসে। ব্যাপার শুনে তাঁরা সোজাসুজি না করে দিলেন। ভিসার কাগজ না থাকলে তাঁরা নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেবেন না। ব্যাপারটা বিস্তারে বোঝানোর চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা হল না। পরের দুটো ঘণ্টা আমরা চার মক্কেল মিলে ইন্টারনেট চষে ফেললুম। কেমন একটা জেদ চেপে গেছে। মন বলছে অসুবিধা হওয়ার কথা না। মস্তিষ্ক বলছে, যদি হয়! সত্যি কথা বলতে কী বিদেশ বিভূঁইয়ে আজকাল মনের চেয়ে মস্তিষ্কের কথাই শুনি বেশি। বহুবছর আগে একবার মনের কথা শুনে ইস্তানবুল শহরে খুবই আতান্তরে পড়েছিলাম। সে-গল্প অন্য সময়ে বলব। কিন্তু এবার বোধহয় ওই কুণালদা অ্যান্ড কোং-এর পাল্লায় পড়ে মনটাকেই এগিয়ে দিচ্ছিলাম বারবার। ওভার লাঞ্চ ঠিক করলাম পরের দিন আমরা বসনিয়া যাচ্ছি। এত কাছে এসে ভিসা নেই বলে পিছিয়ে গেলে লালমোহনবাবুর দেশের লোকের কোনও প্রেস্টিজ থাকে না! দুবরোভনিক থেকে বসনিয়ার সবচেয়ে কাছের শহর মোস্তার। বাস ছাড়ে প্রতিদিনই, একাধিক। ঠিক হল একদিনের ঝটিকা সফরে মোস্তার দেখে আসব আমরা, যদি বর্ডার পেরোতে পারি। থাকব না, স্রেফ হেঁটে বেড়িয়ে আবার দুবরোভনিক ফিরে আসব।

মনে অনেকটা উৎসাহ আর বুকে বেশ খানিক দুরদুর নিয়ে পরদিন ভোরবেলা বাসে চেপে পড়লাম। ওই সাতসকালেই বাস একেবারে ভর্তি। লোকাল মানুষজন রয়েছেন, তবে ট্যুরিস্টই বেশি। বাস চলেছে আবার সেই ডালমেশিয়ান কোস্টলাইন বরাবর। দৃশ্য দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে।

যাওয়ার পথে ডালমেশিয়ান কোস্টলাইন

একঝলক একজন যাত্রী দেখলাম, মনে হল আমাদের বা আমাদের আশেপাশের কোনও দেশের বাসিন্দা। বছর বিশেক বয়স, মলিন জামাকাপড়, সঙ্গে একটা প্রমাণ সাইজের রুকস্যাক, কানে হেডফোন গোঁজা। বাকি সব যাত্রীদের থেকে অনেকগুলো কারণে আলাদা করে চোখে পড়ে ছেলেটিকে। বেড়াতে সে আসেনি, আর এখানকার বাসিন্দা যে সে নয় তা চামড়ার রঙেই মালুম হয়। সে কেন মোস্তার চলেছে আন্দাজ করার চেষ্টা করলুম। বর্ডারের কাছাকাছি এসে একটা সরাইখানায় বাস থামল। খানিক প্রাতরাশ হল। দেখলাম আমাদের গাড়ির চালক এই সক্কালবেলায় টুক করে এক গেলাস বিয়ার গলাধঃকরণ করলেন। ইউরোপে নিয়মকানুন খুব কড়া শুনতে পাই, তবে ফস্কা গেরো বুঝি একটা গ্লোবাল ব্যাপার! মানুষ নিয়মের দাসত্ব করে বাধ্য হয়ে, ফাঁক পেলেই দরিয়া দিলের দাস হতে চায়। ওর কাণ্ড দেখে অবাক হলাম না একেবারেই, চিন্তাও হল না, বেশ মজাই লাগল।

আরও পড়ুন-

স্লোভেনিয়ায় ‘সোনার তরী’, নতুন পাওয়া বইবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ

ক্রোয়েশিয়া আর বসনিয়ার বর্ডারে এসে বাস থামল। সব যাত্রীরা নেমে দাঁড়ালাম। আমাদের পাসপোর্ট সব জমা দিতে হল বর্ডার কন্ট্রোলের অফিসে। বেশ সময় লাগছে, আমি আর নন্দিনী একে-অপরের দিকে তাকাচ্ছি মাঝেমাঝে। একটা নার্ভাস তাচ্ছিল্যের হাসি দিই দুজনেই। কংসরাজের দেশের পাসপোর্টওয়ালা কুণালদা আর সুস্মিতাদি দিব্যি রিল্যাক্সড। কী আশ্চর্য! সবার আগে আমাদের দু-জনের পাসপোর্টই ফেরত পেলাম, দেখলাম জ্বলজ্বল করছে বর্ডার পার করার অনুমতি। নিশ্চিন্ত! তবে বাস ছাড়তে আরও খানিক দেরি হল। সেই যে ছেলেটির কথা বলেছি, তাকে এক অফিসার এসে নিয়ে গেলেন ভিতরে। মিনিট পনেরো তার পুছতাছ চলল, দূর থেকে দেখলাম ছেলেটি হাত নেড়ে অনেক কিছু বলছে। শেষমেশ তারও ছাড়পত্র মিলল, আমরা এক বাস যাত্রী ঢুকে পড়লুম বসনিয়া।

অবশ্য আমরা দেশের যেদিক দিয়ে ঢুকলাম, সেই দিকটা হার্জেগোভিনা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ দিয়ে ঢুকেছি, মোস্তার শহরটি ওই হার্জেগোভিনা অংশে। খেয়াল করলাম যে বর্ডার পেরনোর প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই আশেপাশের জীবনটা পালটে গিয়েছে। দেশের বেহাল অর্থনীতি যেন শহরের সর্বাঙ্গে লেপটে রয়েছে। ছোট-ছোট দোকান, আধভাঙা বাড়ি, মানুষজনও কেমন খানিক থতমত। বাস থেকে যখন নামছি শহরের কেন্দ্রস্থলে তখন আমাদের সেই চালক ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে সাবধান করে দিলেন আমাদের: “চারিদিকে কিন্তু পকেটমার ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনাদের জিনিসপত্র সাবধানে আগলে রাখবেন। ওদের মনিবরা সব আশেপাশের পানশালায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারা পুলিশকে খুব ডরায় না। অতএব, নিজেরাই সাবধানে থাকবেন। আর পকেটমারদের বেশিরভাগ মহিলা, অন্তঃসত্ত্বা সেজে ঘুরে বেড়ায়, তাই চট করে কিছু বুঝতে বা বলতেও পারবেন না।” এই চমকপ্রদ তথ্য পেয়ে নিজেদের পাসপোর্ট আর টাকাপয়সার ব্যাগ আরেকটু আগলে নিলাম সকলেই।

শহরটা কেমন করে ঘুরে দেখব ভাবছি, একটা জোয়ান ছেলে এগিয়ে এল। দিব্যি ইংরেজি বলে, নিজের পরিচয় দিল, নাম নেদিম, একটা পরিচয়পত্রও দেখাল, সে একজন অফিসিয়াল ট্যুরিস্ট গাইড। সত্যি-মিথ্যে জানার কোনও উপায় নেই, সে আমাদের সঙ্গী হল। “সব ট্যুরিস্ট গাইড তো দিন, ক্ষণ, তারিখ বলে। আমি তোমাদের আমার ইমোশনের কথা বলব। এই শহরে আমার জন্ম, এখানেই হয়তো মারা যাব। এই শহরকে ঘিরে কিছু সুখ-দুঃখের কথা বলতে চাই তোমাদের”, বলে ওঠে নেদিম। হাঁটতে-হাঁটতে টুকটুক করে ওল্ড টাউন পৌঁছই। নেদিমের চোখ দিয়েই একটা নতুন দেশ, একটা নতুন শহর দেখি। “আমাদের দেশে তিন রকমের এথনিসিটি, বসনিয়াক যারা প্রধানত মুসলমান, সার্বস যারা অর্থোডক্স খ্রিস্টান, আর ক্রোয়াট যাদের বেশীরভাগ ক্যাথোলিক। যুদ্ধের আগে আমাদের এই ধর্মের পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। একে-অন্যের সঙ্গে প্রেম, ভালবাসা হত আকছার, বিয়ে হত দিব্যি। এখনও একসঙ্গে থাকি, একে-অপরকে দেখলে তেড়ে যাই না, কিন্তু নেহাতই অনাত্মীয়ের মতো। চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে”, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেদিম। একটা ছোট সাঁকোর কিনারে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে সে আমাদের। “উপর দিকে তাকাও”। সকলে উপরে তাকাই আমরা। “দেখ এই জায়গা থেকে চারটে ধর্মের প্রার্থনা স্থল চোখে পড়ছে। একটা ইসলামের, একটা ক্যাথলিকদের, একটা অর্থোডক্সদের আর একটা ইহুদিদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও কিন্তু আমরা মিলেমিশে থেকেছি।” কুনালদা একটা চমৎকার কথা মনে করিয়ে দিল এই সময়, “দেখ আমাদের শহরেও কিন্তু এই ব্যাপারটা রয়েছে। ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছের কোন উঁচু জায়গায় দাঁড়ালে একদিকে মাঘেন ডেভিডের সিনাগগ, একদিকে নাখোদা মসজিদ, একদিকে সেইন্ট জেমস গির্জা আর বড়বাজারের দিকটায় একটা গুরুদ্বারা দেখা যায়”। মাথা নাড়ি, কলকাতার সঙ্গে এই মিল পেয়ে ভাল লাগে, মনের কোথাও মোস্তার শহরের জন্যও খানিক মায়া অনুভব করি।

চার ধর্মের সহাবস্থান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে

গোটা ওল্ড টাউন জুড়ে নানা মনিহারী দোকান। কত রকমের জিনিস বিক্রি হচ্ছে, জামাকাপড়, বাড়িতে বানানো খেলনা, চিজ্‌, মাংস, ভাজাভুজি ইত্যাদি। বেশিরভাগই বড্ড সাধারণ জিনিস, ইউরোপের অন্যান্য দেশের ওল্ড টাউনের চাকচিক্যের ধারকাছ দিয়েও যায় না। হাঁটতে-হাঁটতে মোস্তারের বিখ্যাত সেই ব্রিজের কাছে চলে এসেছি। ‘স্তারি মোস্ত’ বা পুরনো সাঁকো। ‘মোস্ত’ শব্দের অর্থ সাঁকো, সাঁকোর শহর মোস্তার। স্তারি মোস্তের উপরে নিচে বহু মানুষের ভিড়। স্থানীয় যুবকেরা এখানে একটা ভয়ানক খেলা দেখায় প্রতিদিন। ব্রিজের উপর থেকে সোজা ঝাঁপ দেয় নেরেতভা নদীর বুকে। প্রায় আশি ফুট। তারপর পাড়ে উঠে এসে পর্যটকদের কাছ থেকে পয়সা চায়। আমরাও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই মরণঝাঁপ, পয়সা দিয়ে দায়হীন পর্যটকের মতো হাঁটা দিলাম আবার।

স্তারি মোস্ত

দিন গুজরানের জন্য মরণঝাঁপ

আগ্রহ নিয়ে আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেয় নেদিম। “মার্শাল টিটো সম্বন্ধে তোমাদের কি মতামত?” জিজ্ঞাসা করি। “আমাদের হিরো!” মুহূর্তে জবাব দেয় নেদিম। “আশেপাশের অনেক দেশ-ই ওঁকে ডিক্টেটর বলে। বলুক। তিনি সব মানুষের ভাল চাইতেন, একটা শ্রেণির ভাল নয়। আরও যদি বেঁচে থাকতেন যুগোস্লাভিয়ার আজ এই ভগ্নদশা হত না। আমরা মিলেমিশে আরও অনেক ভাল থাকতে পারতাম।” “আর এমির কুস্তুরিৎসা?” কুণালদা জিজ্ঞেস করে। “সে তো একজন প্রতারক। এথিইস্ট মুসলমান থেকে একজন অর্থোডক্স খ্রিস্টান হয়েছেন আজকাল। নিজের নামটাও বদলে নিয়েছেন শুনি। তাতে আপত্তি কিছু নেই, কিন্তু সার্বিয়ার অত্যাচার, তাদের রাজনীতির কোনও নিন্দা আজ অব্দি ওর কাছ থেকে শুনিনি। পুতিনের বন্ধু, পুতিনের সঙ্গে খুব তফাৎ কিছু নেই। নিন্দা করার ভাষা নেই আমার কাছে।” আমরা চারজনেই কুস্তুরিৎসার ছবির ভক্ত। বিষয় আর বাড়াই না বিলকুল। চুপ করে থাকি। “তবে এই যে এত যুদ্ধ হল, এত হানাহানি নিজেদের মধ্যে, আমরা যে এখনও কজন বেঁচে রয়েছি, এই দেশটায় যে তোমরা আজও আসতে পার তার জন্য দুজন মাত্র দায়ী।” আমরা সকলে নেদিমের মুখের দিকে তাকাই। “মাইকেল শুমাখার আর প্রিন্সেস ডায়না। আমি, আমার পরিবার ওঁকে গডেস ডায়না বলি। বসনিয়া হার্জেগোভিনাকে এঁরা পৃথিবীর নজরে এনেছে। আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।”

যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহর মোস্তার

আরও পড়ুন-

ভিড় রাস্তা, পুরনো সিঁড়ি ও নীল সমুদ্রের শহর দুবরোভনিক

বেলা গড়িয়েছে বেশ অনেকটা। আমরাও চলতে-চলতে, নেদিমের গল্প শুনতে-শুনতে শহরের অনেকটাই হেঁটে নিলাম। রোদ বেশ চড়া আজ। খিদেও পেয়েছে বেশ। নেদিমকে প্রভূত ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানালাম। সে-ই পৌঁছে দিয়ে গেল একটা সাবেকি সরাইখানায়। স্থানীয় বিয়ারের সঙ্গে সেখানে খেলাম একটা চমৎকার খাবার, বসনিয়ার বিখ্যাত দোলমা। প্রমাণ সাইজের তুর্কি লঙ্কার ভিতরে মাংস, ভাত আর পেঁয়াজ রসুনের পুর দিয়ে তৈরি। সঙ্গে আবার শুকনো লঙ্কা আর বেগুন দিয়ে তৈরি একটা আচার (ওরা বলে আজভার), আর উপরে ক্রিম দেওয়া। খিদের মুখে ভারী অপূর্ব লাগল। “তাহলে বসনিয়া আমরা এলাম শেষমেশ?” সুস্মিতাদির মুখে বিজয়ীর হাসি। সত্যিই একটা অভিজ্ঞতা হল, না এলে মিস করতাম।

দোলমা

ফেরার পথে ক্রোয়েশিয়ার এড্রিয়াটিক

এ যাত্রায় আমাদের ঘোরাঘুরির ইস্তেহার এখানেই খতম করলুম। আবার কখনও নতুন বা পুরনো যাত্রার গল্প বলতে ইচ্ছে করলে পাঠকের কাছে ফিরে আসব নিশ্চিত।

More Articles