আলোকে জমিয়ে ফেলা সম্ভব! বিজ্ঞান গবেষণায় যে ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য
Scientists freeze light: সাংবাদিক সম্মেলনে এই আবিস্কারের ঘোষণা করার সময় ইতালীয় গবেষকরা এই অদ্ভুত ঘটনাটিকে 'কোয়ান্টাম থিয়েটারের' সঙ্গে তুলনা করেছেন।
শূন্যস্থানে আলো সর্বদা প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিমি বেগে ঘোরে এবং এটি কখনও 'কঠিন' আকার ধারণ করতে পারে না। কারণ, ফোটনগুলির (আলোর কণা) কোনো বিশ্রাম ভর বা রেস্ট মাস নেই ও তারা একে অপরের সঙ্গে বিশেষ বিক্রিয়া করে না।
সাধারণত, আলো দ্বৈত সত্ত্বা প্রদর্শন করে, কখনও এটি কণা, আবার কখনও তরঙ্গ। ফলে এর কঠিনিভবন আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। সম্প্রতি, পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিএনআর ন্যানোটেকের একদল গবেষক সূক্ষ্মভাবে সাজানো অতি শীতল পরিবেশে বিশুদ্ধ আলোর সফলভাবে হিমায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের এই যুগান্তকারী গবেষণা প্রমাণ করে যে আলোকে একটি অতি কঠিন পদার্থ বা সুপার সলিডে পরিণত করা সম্ভব এবং যা বাধাহীনভাবে (সান্দ্রতা প্রায় শূন্য) প্রবাহিত হতে পারে। এই বছর মার্চ মাসে বিশ্ব বিখ্যাত জার্নাল নেচার-এ এই আবিষ্কার প্রকাশিত হয়েছে।
কী এই সুপারসোলিড?
এটি পদার্থের একটি বিরল কোয়ান্টাম অবস্থা, যেখানে কণাগুলি একটি কেলাসের আকারে সাজানো থাকে, কিন্তু সান্দ্রতাহীন তরলের মতো চলাচল করতে পারে। আমরা জানি যে কঠিন পদার্থগুলি নিজে থেকে চলাচল করে না, তবে সুপারসোলিডগুলি সেক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম, এরা একটি সংগঠিত জাল কাঠামো বজায় রেখে কণাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে দিক এবং ঘনত্ব পরিবর্তন করতে পারে।
আরও পড়ুন- একটি তারার দু-বার মৃত্যু! বিজ্ঞানীদের পাওয়া নতুন তথ্য কী বলছে?
ষাটের দশকে, গবেষকরা তাত্ত্বিকভাবে হিলিয়ামের সুপারফ্লুইডিটি বিষয়ক কাজ করতে গিয়ে এই সুপারসোলিডের তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছিলেন। ২০২৫ সালে পরীক্ষাগারে তাঁরা এটি সম্ভব করে দেখালেন। তাঁদের এই যাত্রা খুব সহজ ছিল না । ১৯৯৯ সালে, লেন হাউ-এর নেতৃত্বাধীন একদল গবেষক আল্ট্রাকোল্ড পরমাণুর বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট (অতি শীতল তাপমাত্রায় পদার্থের এক বিশেষ অবস্থা) ব্যবহার করে একটি আলোর গতি ১৭ মি/সেকেন্ডে কমিয়ে আনে এবং ২০০১ সালের মধ্যে তাঁরা আলোর স্পন্দন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের প্রয়োগে বিজ্ঞানীরা এই কাজ করতে সক্ষম হন। অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে এই পদ্ধতিতে আলোকে 'হিমায়িত' করা যায়, যা থেকে পরে দরকারে আলোকে তার পূর্বের রূপে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।
আলোর কাঠিনীভবনের দিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল এটিকে পদার্থের মতো আচরণ করা। ২০১০ সালে, জার্মানির বন শহরের এর এক দল গবেষক বিশুদ্ধ ফোটনের জন্য পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট দশা নিয়ে আসে, যার ফলে রঞ্জক-ভরা অপটিক্যাল মাইক্রোক্যাভিটিতে আলোকে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে ফোটনগুলি একটি সুসঙ্গত কোয়ান্টাম অবস্থা সৃষ্টি করে, মূলত আলোর একটি 'তরল' অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই প্রথম ইতালীয় বিজ্ঞানীরা একটি সুপারসোলিড তৈরি করতে আলো এবং পদার্থের সংমিশ্রণ করেছেন, যা ঘনীভূত পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করে।

আলোর সুপারসোলিডে ফোটনগুলির ঘনত্বের মানচিত্র, ওয়েভি লাইন হিসাবে দৃশ্যমান মড্যুলেশন সহ (সূত্র: doi-10.1038/s 41586-025-08616-9)
কীভাবে আলোকে কঠিনে পরিণত করলেন বিজ্ঞানীরা?
সাধারণত, পরীক্ষাগারে তাপমাত্রা কমিয়ে তরল পদার্থকে কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়। তবে, এই যাত্রায় একটি কোয়ান্টাম যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে যা 'পোলারিটন'-এর বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। শক্তিশালী বৈদ্যুতিন চৌম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার দরুণ একজোড়া ফোটন কণা এবং এক্সাইটনের মতো কোয়াসিপার্টিকালগুলি এই ধরনের শঙ্কর কণা গঠন করে। এই কাজে গবেষকরা অ্যালুমিনিয়াম গ্যালিয়াম আর্সেনাইডের সেমিকন্ডাক্টরকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে একাধিক এমবেডেড কোয়ান্টাম ওয়েল (যা এক্সাইটন সরবরাহ করতে সক্ষম)-সহ একটি ফোটোনিক ওয়েভগাইড তৈরির সুবিধা রয়েছে । আর শীতলিভবনের দিকটা সামাল দিয়েছে লেজার। ওয়েভগাইডটির মধ্যে পর্যায়ক্রমিক জালির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যাতে সেমিকন্ডাক্টর বেসে একটিা ফোটোনিক স্ফটিক পরিবেশ তৈরি করা যায়। ইতালীয় বিজ্ঞানীরা খুব কম তাপমাত্রায় (প্রায় ৪ কেলভিনের কাছাকাছি) ঘনীভূত পোলারিটন অবস্থা বজায় রাখতে স্পন্দিত লেজার ব্যবহার করে।
লেজার আলো একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নযুক্ত অর্ধপরিবাহীতে প্রবেশ করে, তখন এর মধ্যে থাকা পর্যায়ক্রমিক জালির (গ্র্যাটিং) দ্বারা ধাক্কা খেয়ে একটি সীমাবদ্ধ মেরু গঠন করে, যেগুলো আলোক-পদার্থ তরঙ্গের পর্যায়ক্রমিক জালিতে স্থির হয়ে যায়, ফলে কেলাসকার কাঠামোতে পরিণত হয়। এই পুরো ব্যাপারটি একটি বোস আইনস্টাইন ঘনীভূত দশায় ঘটে ।

সুপারসলিড স্টেট ( সূত্র-আইস্টক)
গবেষকরা পোলারিটনের আলোকসজ্জা পর্যবেক্ষণ করতে একটি মাইকেলসন ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহার করেছিলেন। তাঁদের এই পরীক্ষায় আলোর একটি অতি কঠিন অবস্থা প্রকাশ পায়, যেখানে পোলারিটন ঘনীভূত একটি কেলাসকার কাঠামো প্রদর্শন করে, যার মধ্যে একটি সুপারসোলিডের সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আলোকে সত্যিই জমিয়ে ফেলতে পেরেছেন কিনা, তা যাচাই করতে গিয়ে, গবেষকরা পোলারিটনের মধ্যে ট্রানস্লেশন বা অনুবাদমূলক প্রতিসাম্যের স্পষ্ট লঙ্ঘন লক্ষ্য করেন, যেটি কিনা একটি কেলাসের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- আলোর রং পরিবর্তন হয়ে যাবে! পদার্থ বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা মেটালেন্স কী?
সাংবাদিক সম্মেলনে এই আবিস্কারের ঘোষণা করার সময় ইতালীয় গবেষকরা এই অদ্ভুত ঘটনাটিকে 'কোয়ান্টাম থিয়েটারের' সঙ্গে তুলনা করেছেন। ধরা যাক, একেবারে প্রথম সারিতে মাত্র তিনটি আসন রয়েছে- একটি মাঝখানে এবং দুটি উভয় প্রান্তে। ভালোভাবে দেখার জন্য লোকেরা মাঝখানে বসতে চাইবে, তবে তা কেবল একজন ব্যক্তিই পারেন। সমস্ত বোসন কণা (যাদের ঘূর্ণন পূর্ণসংখ্যার সমানুপাতিক) একটি কোয়ান্টাম থিয়েটারে মাঝের আসনে বসতে পারে, যা বোস আইনস্টাইন ঘনীভূত দশা তৈরি করতে পারে -একটি অতি তরল অবস্থা, যেখানে কণাগুলির বেশিরভাগ অংশ সর্বনিম্ন-শক্তি বিশিষ্ট কোয়ান্টাম অবস্থায় থাকে। কোয়ান্টাম থিয়েটারে কণাগুলি একত্রিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটি 'স্যাটেলাইট কনডেনসেট' কেন্দ্রীয় আসনের মতো বাম এবং ডান আসনে বৃদ্ধি পায়।
এখন কাজের কথা হল এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানে কী পরিবর্তন হলো?
এই পরীক্ষায় আলো যে ক্ষেত্রবিশেষ এই অধরা অবস্থা প্রদর্শন করতে পারে, তা ফোটোনিক সুপারসোলিডগুলিকে পরীক্ষা এবং সম্ভাব্য প্রয়োগের জন্য গবেষণার পথকে আরও সহজলভ্য করে তোলে। এছাড়াও সুপারসোলিডগুলি প্রায় ক্ষয়হীন অপটিক্যাল শক্তি পরিবহন, অপটিক্যাল কম্পিউটিং উপাদান এবং কোয়ান্টাম উপকরণ সিমুলেশনের মতো নতুন প্রযুক্তিগুলিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বর্তমানে, সলিড-লাইট সুপারসোলিড পরীক্ষাগারে নির্দিষ্ট পরিবেশেই (অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় এবং টেকসই লেজার পাম্পিংয়ে) বিদ্যমান, তবে আলোকে সুপারসোলিডে পরিণত করার ধারণা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম ফটোনিক্সের গবেষণা আরও সম্ভাবনাময় হবে, এমনটাই ফুটে ওঠে একজন বিজ্ঞানীর স্বগতোক্তিতে- "আমরা সত্যিই এক নতুন বিপ্লবের সূচনালগ্নে এসে উপনীত হয়েছি"।

Whatsapp
