জাগ্রেব শহরে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া বাঙালি বন্ধু!
Zagreb Tour : চলার পথে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। মবিন ভাইকে মনে থাকবে চিরকাল। ওঁর করুণ পরবাস নাড়া দিল মনের ভিতরে।
ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘরের কথা বলেছি আগের লেখায়। সেখান থেকে বেড়িয়ে পাশের বাড়ির জানালা থেকে গজিয়ে ওঠা একটা ক্যাফেতে বসেছি। নামেই ক্যাফে। আদতে জানালার বাইরে কয়েকটা চেয়ার-টেবিল পাতা। জানালার নিচে ঝুলিয়ে রাখা মেনু, একধারে কাত হয়ে পড়েছে। গোটা ক্যাফে জুড়েই একটা জাগ্রেব ভাব। আমরা দুজনে দুটো এসপ্রেসো নিয়ে বসলাম। গুনগুন করে আলাপ করছি। হঠাৎ অনুভব করলাম একেবারে আমাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কেউ একজন আমাদের কথা শুনছেন। তাকিয়ে দেখলাম মলিন পোশাক পরা একজন প্রৌঢ়। দেখে মনে হল উপমহাদেশের মানুষ। চাপা গায়ের রঙ, সারা মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। একটা চেক জামা গায়ে, সঙ্গে মলিন সোয়েটার পাৎলুনের ভিতরে গোঁজা, একটা বেল্ট দিয়ে ভারী বেমানান ভাবে বাঁধা। গলায় একটা মিশমিশে মাফলার জড়ানো, যদিও বেশ গরম। জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ।

জাগ্রেবের সেই ক্যাফে
আমরা দুজনেই খানিক অপ্রস্তুত, সন্ত্রস্তও বলা যায়। ম্লান হাসলেন ভদ্রলোক, “আপনারা বাংলা বলছেন শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।” বিদেশে নিজের ভাষা কানে এলে দুরকমের প্রতিক্রিয়া হয়: এক, কদিনের জন্য দূর দেশে এসেও শান্তি নেই! আপদ! দুই: এখানে আবার কে বাংলা বলে! ভদ্রলোকের পোশাক পরিচ্ছদ আর ব্যবহারে এক ধরনের বৈপরীত্য রয়েছে। পোশাক আর ক্লিষ্ট চেহারা দেখলে আচমকা মনে হতে পারে ইউরোপে প্রায় সব শহরে ছড়িয়ে থাকা বিবিধ দেশের উদ্বাস্তুদের কথা। কিন্তু আশ্চর্য চোখের দ্যুতি। যেন আমাদের জরিপ করছেন। আমাদের সঙ্গে কফি খেতে বলায় সানন্দে রাজি হলেন। আলাপী মানুষ, গরগর করে বলে গেলেন নিজের জীবনের কথা। নাম বলেছিলেন, যদ্দুর মনে পড়ছে, মবিন উল হক। বাড়ি ঢাকা শহরে। একসময় ছিলেন সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের উচ্চপদস্থ আমলা। অবসর নিয়েছেন বছর কয়েক হল। উপনিবেশ আর ইংরেজের শাসন আমাদের ভিতরে কীভাবে শিকড় গেড়ে থাকে তাই ভাবছিলাম ওঁর সঙ্গে কথা বলতে-বলতেই।
আরও পড়ুন-
স্লোভেনিয়ায় ‘সোনার তরী’, নতুন পাওয়া বইবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ
মবিন সাহেব যে এমন উচ্চপদে চাকরি করতেন আপাতত ওঁকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই এতটুকু। বরং, মনে সন্দেহ জাগবার কথা। কিন্তু কানে আসে ওঁর ইংরেজি বলার ধরন। কথার মাঝেমধ্যেই এক-একবার ইংরেজিতে কথা বলে উঠছেন মবিন। ওঁর উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি যাকে ইংরেজিতে বলে impeccable। এককথায়, এক দুঃখী মানুষের কাহিনি শুনলাম। এক সময় ওঁর সংসার ছিল, স্ত্রী ছিলেন, এক ছেলে ছিলেন। দুজনেই গত হয়েছেন কয়েক বছর হল। প্রথমে ছেলে, কয়েক বছর পরে স্ত্রী। “কী আর করব এই জীবন নিয়ে! টাকা পয়সা, পেনশন, সবই রয়েছে, শুধু প্রিয় মানুষগুলি নাই বুঝলেন।” খানিকক্ষণ চুপ থাকেন মবিন। “সময় কাটানোর জন্য পাসপোর্ট ব্যাগে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম একদিন। দেশে-দেশে ঘুরি, মানুষের সঙ্গে কথা বলি, হোস্টেলে হোস্টেলে থাকি। আবার দেশে ফিরে কয়েকমাস থাকি। সংসার ভেসে গেল, আমিও ভেসে পড়লাম। একদিন হয়তো এমনই কোনও অচেনা দেশে মরে পড়ে থাকব।” প্রায় আবেগহীনভাবে বলে চলেন মবিন। কফি খাওয়া হলে নিজেই বলেন, “আসেন দু’ভাইয়ে একটা ছবি তুলি।” নন্দিনীর হাতে ক্যামেরা, আমরা দাঁড়ালাম পাশাপাশি। নন্দিনী বলে, “মবিন ভাই একটু হাসেন।” একটা ম্লান হাসি দিলেন মবিন, “কদ্দিন পরে আমাকে কেউ হাসতে বললে। থ্যাঙ্কিউ, দিদি”। চলার পথে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। মবিন ভাইকে মনে থাকবে চিরকাল। ওঁর করুণ পরবাস নাড়া দিল মনের ভিতরে।

মবিন ভাইয়ের সঙ্গে
পরদিন গেলাম আরেকটা আশ্চর্য জাদুঘরে, ‘দ্য ক্রোয়েশিয়ান মিউজিয়াম অফ নাইভ আর্ট’। এই নাইভ আর্ট বিষয়ে আগে জানা ছিল না মোটে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন মিউজিয়াম আছে কিনা তাও জানা নেই। এখানেও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না খুব, ভাবলাম কত বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়াম দেখেছি সারা বিশ্বের, মিছিমিছি সাধারণ মানুষের আঁকা ছবি দেখে কী হবে! ভ্রমণসঙ্গিনী প্রায় জোর করেই ঠেলেঠুলে নিয়ে গেলেন। না গেলে একটা অবিস্মরণীয় নান্দনিক অভিজ্ঞতা জীবন থেকে বাদ রয়ে যেত নিশ্চিত।
‘নাইভ’ শব্দের বাংলা তর্জমা করা যায় ‘অকপট’ অথবা ‘কৌশলবর্জিত’। অর্থাৎ, এইসব ছবি তাঁদের আঁকা, যাঁদের পেশাদার অর্থে ‘শিল্পী’ বলা চলে না। অথচ, এই না-শিল্পীদের ছবির অভিঘাত এমনটাই যে তাদের শিল্পের দিকে না তাকিয়ে উপায় নেই। হয়তো গ্রামার জানা নেই, আর্ট স্কুলে যাননি এঁরা কেউই, অথচ তাঁদের আঁকার ভাষার এমন একটা তাগিদ রয়েছে যা নাড়িয়ে দেয় আমাদের অন্তরের বোধকে। খুঁজে-খুঁজে এই মানুষগুলোকে আবিষ্কার করাও এক ধরনের নান্দনিক সংস্কৃতির পরিচয় দেয়, যা ক্রোয়েশিয়া দেশটির সম্বন্ধে এক ধরনের সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলে। ইউরোপ আমেরিকার পয়সা আছে তাই তাঁরা অনেক অসম্ভব কাজ করতে পারে, এই যুক্তি এক্ষেত্রে খুব ধোপে টেঁকে না, অন্তত জাগ্রেব শহর যে দুনিয়ার নিরিখে খুব স্বচ্ছল তা বলা চলে না একেবারেই। তাই এঁদের প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধার বোধ অনুভব করি মিউজিয়াম দেখতে-দেখতে।

ইভান লাচকোভিচ
আদতেই সাধারণ কৃষক বা শ্রমিকের আঁকা ছবির প্রদর্শনী এই মিউজিয়ামে। যেমন ধরা যাক ইভান লাচকোভিচের কথা। প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম। দারিদ্র্যের স্বাভাবিক নিয়মেই ইস্কুল শেষ করে শ্রমিক হতে হয় তাঁকে। কিন্তু ছবি আঁকার অদম্য নেশা ছেড়ে যায়নি কোনওদিন। ওঁর আঁকা ছবি ‘Trees Die Standing’ চমকিত করে। দেখি এক জায়গায় বলেছেন, “My paintings may not be beautiful, but they are just as life is, sometimes bitter and sad, and sometimes beautiful and joyful”। ইভান জেনেরালিচের জন্মও এমনই দরিদ্র কৃষক পরিবারে। গ্রামের ইস্কুলে পড়তে পেরেছেন মাত্র পাঁচ ক্লাস। তারপর জীবনের বেশীরভাগ সময় কেটেছে মাঠে-মাঠে গোচারণে অথবা কৃষিকাজে। কিন্তু ছবি আঁকার চিন্তা তাড়িয়ে বেরিয়েছে সবসময়। জেনারেলিচ বলছেন, “When I would go somewhere to the field to work or with the cows to pasture, whenever I had a little free time I’d take out a pencil and paper and draw something that instant”।

Trees Die Standing

ইভান জেনেরালিচ

জেনেরালিচের আঁকা ছবি : Deer in the forest

জেনেরালিচের আঁকা ছবি : Woodcutters
ইলিয়া বসিল্ইয়ের চিন্তা জটিল। বলছেন, জীবন আদতেই ভাল আর মন্দের একটা নিরন্তর যুদ্ধ, তবে কোনটা যে ভাল আর কোনটা মন্দ এর উত্তর শুধু অভিজ্ঞতাই দিতে পারে। “You just never know what’s good and what’s not because whatever I used to love I now hate, and what I hated I love, so I have to deal with it”। বলছেন, জীবনকে বোঝা বড় কঠিন, বরং ছবি আঁকা সহজ। তাই আঁকতে শুরু করতে হয় খানিক বয়সে, জীবনটা খানিক বুঝে নিয়ে, আর সেই অভিজ্ঞতা একটার উপরে আরেকটা সাজিয়ে নিতে পারলেই একটা রঙিন ছবি তৈরি হয়ে যায়।

ইলিয়া বসিল্ই
এঁদের বলা কথা, আর ছবি আমাদের মননে দাগ কাটে গভীর। দীক্ষা আর বোধ, দুটো আলাদা রাস্তা, কখনও মিলে যায়, অনেক সময় মেলে না। এর সঙ্গে আর্টের সম্পর্ক ভাবিয়ে তোলে। রাস্তায় বেড়িয়েও এইসব চিন্তা ঘুরতে থাকে মাথার ভিতরে। জাগ্রেব আমাদের খুব ভাবিয়ে তুলল যাহোক!
আরও পড়ুন-
মানুষের বিভিন্ন সম্পর্কের চিহ্নকে বাঁচিয়ে রাখে জাগ্রেব শহরের এই মিউজিয়াম
জাগ্রেবের দিন শেষ। আমাদের পরের গন্তব্য দুবরোভনিক, ক্রোয়েশিয়ার অপর প্রান্তে। যেদিন সকালে জাগ্রেব ছাড়ছি, অন্য বিপত্তি। সেদিন ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা দিবস। রাস্তায় বেরিয়েছি, বাস স্টেশনে যাব। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। সবচেয়ে বড় কথা একটাও ট্যাক্সি চোখে পড়ছে না। অথচ মালপত্তর নিয়ে উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে বাস স্টেশনে হেঁটে যাওয়া মুশকিল। অনেকটা পথ। মিনিট দশেক এদিক-ওদিক করে শেষে জাগ্রেব ক্যাথিড্রালের পাশের গলিতে দেখলাম একটা মাত্র ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। চালককে দেখে খুব ভরসা হয় না, রুক্ষ, কর্কশ চেহারা। যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে মাথা নাড়লেন, কিন্তু একচুলও নড়লেন না। আয়েস করে একটা সিগারেট খাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। গোটা সিগারেট শেষ করে আপন মর্জিতে রওনা দিলেন আমাদের নিয়ে। খানিক আলাপ করার জন্যই নন্দিনী বলল, “হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে।” “নট মাই ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে”, ভাঙা ইংরেজিতে বলে তিনি চুপ। এরপর আর কথা চলে না। উত্তরটা খুব ভদ্রজনোচিত হয়নি বোধহয় নিজেই বুঝতে পারলেন খানিক বাদে। জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি। বললাম, ভারতবর্ষ। “ল্যান্ড অফ গান্ধী!” এখনও যে ভারতবর্ষকে কেউ গান্ধীর দেশ বলে চিনতে পারে ভেবে আশ্চর্য হলুম। “আই অ্যাম ফ্রম ইউক্রেন”, এইবার যেন খানিক নরম হলেন ভদ্রলোক। তারপর সম্পূর্ণ বিদেশী জেনেই বুঝি আমাদের কাছে নিজের কথা বলে চললেন খানিক। বছরখানেক হল আসতে পেরেছেন জাগ্রেবে, এখানে থাকেন বিবাহিত মেয়ের কাছে। স্ত্রী আর আরেক পুত্রসন্তান এখনও ইউক্রেনে। ওদেরও নিয়ে আসতে পারবেন সেই আশায় দিন গুনছেন। “গত দশ বছরের অকুপেশনে আমাদের গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিচ্ছু আর নেই সেখানে। বাঁচতে হলে চলে আসতেই হবে।” এর উত্তরে খুব কিছু বলার থাকে না। নন্দিনী অস্ফুটে বলল, “মে ইয়োর কান্ট্রি ফাইন্ড পিস।” আমরা পৌঁছে গিয়েছি বাস স্টেশনে। মালপত্তর নামিয়ে দিয়ে আমাদের দুজনের সঙ্গে একটা উষ্ণ করমর্দন করলেন ট্যাক্সিচালক। জাগ্রেব শহরকে হৃদয়ে নিয়ে আমরাও রওনা দিলাম।
Whatsapp
