এসেছেন বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথও! মানকরের কবিরাজ বাড়ির দুর্গাপুজোর ৩০০ বছর

Durga Puja at Kabiraj's house in Mankar: এ বাড়ির দুর্গাপুজোর বয়স ৩০০ বছরেরও বেশি। এখনও প্রথা মেনে চলে পুজো। প্রতিমা একচালার তলায় স্থাপিত হয়, যেখানে দুর্গা ও তাঁর পরিবার থাকেন।

MT

অতীতের পৌষমুনির ডাঙা, আজকের মানকর। পুরাণ মতে, পান্ডবরা নাকি এসেছিলেন এখানে। তাই স্থানটির আরেক নাম ‘পান্ডবক্ষেত্র’। তাঁতের বস্ত্র, শিল্পকলা, শিক্ষা ও বিদ্যাচর্চার জন্য একসময় বিশেষ খ্যাত ছিল মানকর। কথায় আছে— পাল, ভট্টাচার্য্য, খাঁ— এই তিন নিয়ে মানকর গ্রাম। এখানকার কদমা মিষ্টি, গহনা তৈরির ডাইস এবং বেনারসের চেলি আজও ঐতিহ্যের অংশ। এই ঐতিহ্যময় জনপদের অন্যতম আকর্ষণ হল ৩০০ বছরের পুরনো কবিরাজ বাড়ি।

কবিরাজ বাড়ির দুর্গা, সূত্র- অন্তর্জাল

মানকরে শক্তিপুজোর প্রচলন বহুকাল ধরে। গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা মানকরেশ্বর ‘বুড়োশিব’। তবে কবিরাজ বাড়ির আরাধ্যা দেবী আনন্দময়ী কালী। কষ্টিপাথরের এই দেবীমূর্তি অত্যন্ত জাগ্রত বলে বিশ্বাস করা হয়। সারা বছর দেবী ‘মহামায়া’ রূপে পূজিত হন।

আরও পড়ুন- জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?

একসময় কবিরাজি চিকিৎসায় খ্যাতি ছিল এই বংশের। ভোলানাথ কবিরাজ ছিলেন বর্ধমান রাজাদের রাজবৈদ্য। বর্ধমান রাজারা এই পরিবারকে জমি দান করেছিলেন এবং ‘কবিরাজ’ উপাধিও দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় কবিরাজ বাড়িতে এসেছিলেন। আবার শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছিলেন এবং প্রতিকার পান। তাঁর ‘স্পর্শমণি’ কবিতায় মানকরের উল্লেখ আছে।

অতীতের ভারে জৌলুস হারাচ্ছে

এ বাড়ির দুর্গাপুজোর বয়স ৩০০ বছরেরও বেশি। এখনও প্রথা মেনে চলে পুজো। প্রতিমা একচালার তলায় স্থাপিত হয়, যেখানে দুর্গা ও তাঁর পরিবার থাকেন। প্রতিমার মুকুটের মাথায় থাকে একটি ময়ূরের পালক। নৈবেদ্যের অন্যতম উপাদান হল মানকরের বিখ্যাত কদমা। সারা বছর দুর্গাদালান সাধারণত বন্ধ থাকে, তবে পুজোর সময় খুলে যায়। পুজো উপলক্ষে আত্মীয়-পরিজনরা বাইরে থেকে এসে জড়ো হন, শুরু হয় পারিবারিক মিলনমেলা। গ্রামের মানুষ ও দূরদূরান্তের দর্শনার্থীরা ভিড় জমান।

আরও পড়ুন-  অতীতে দুর্গাপুজো ছিল ফসল কাটার উৎসব, কীভাবে বিলুপ্ত হল দুর্গাভোগ ধান?

পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ ও প্রথা মেনে পুজো হয়। নিয়ম অনুযায়ী অঞ্জলি, সিন্নি, বলি ও নানা আচার পালন করা হয়। প্রথাগত ধারা আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। পরিবারের বংশপরম্পরায় চলে আসা এই দুর্গোৎসব তাই শুধু ধর্মীয় আয়োজন নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ।

মানকর কবিরাজ বাড়ির ঠাকুরদালান

আজ বাড়িটি জীর্ণ, ভগ্নদালানের ভাঁজে জমে আছে শতাব্দীর স্মৃতি। কিংবদন্তি আছে, বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল সোনার ইট। দেওয়ালে এখনও দেখা যায় অপূর্ব ফ্রেস্কোর কাজ। বিশাল ভগ্নদালানের মধ্যে ঘুঘুর ডাক, পায়রার অবাধ বিচরণ আর ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে।

পুকুরপাড়ের সবুজ গাছপালা আর নীল আকাশের প্রতিফলন আজও এই বাড়িকে ঘিরে রাখে। বাড়ির চতুর্দিক জুড়ে স্তব্ধতা আর অতীতের কাহিনি যেন নকশি কাঁথার মতো মিশে আছে। দুর্গোৎসবের কয়েকটা দিন বাড়িটি আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে।

More Articles