রথযাত্রাকে ধর্মপ্রচারের জন্য কীভাবে ব্যবহার করতেন সম্রাট অশোক?

Ratha Yatra : তিনটি দারুকাঠের রথে চেপে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার যাত্রার আরেকটি নাম হল 'বহুধা যাত্রা'। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর সময় জগন্নাথের আবির্ভাব। অতীতে মালিনী নদী পার করে জগন্নাথ প্রভু রাজার ছ-টি রথে চেপে গুণ্ডিচা মন্...

MT

কিছু দিন আগেই হয়ে গেল রথযাত্রার উৎসব। বাঙালির অতি পরিচিত রথযাত্রা শুরু হয়েছিল কীভাবে? কথায় বলে, ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী’। রথ সম্পর্কে পুরাণেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। রামায়ণ ও মহাভারতের যুদ্ধেও রথের যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসবের সঙ্গে ‘যাত্রা’ শব্দটি বহু শতাব্দী থেকেই যুক্ত হয়ে আছে। আসলে ‘যাত্রা’-র সঙ্গে দেবতার মাহাত্ম্য মিশে থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাসে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার পরেই আসে আষাঢ় মাসে রথযাত্রা।

তিনটি দারুকাঠের রথে চেপে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার যাত্রার আরেকটি নাম হল 'বহুধা যাত্রা'। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর সময় জগন্নাথের আবির্ভাব। অতীতে মালিনী নদী পার করে জগন্নাথ প্রভু রাজার ছ-টি রথে চেপে গুণ্ডিচা মন্দির যেতেন। শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রাও বহু প্রাচীন। তবে কবে শুরু এই রথযাত্রা, তা বলা কঠিন। তবু বলা যায়, পুঁথি অনুযায়ী পুরীর রথ যাত্রার সূচনা হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে।

আরও পড়ুন- 

যে রথ পুরাণের গল্প দেখায়

পুরীর পরেই বিখ্যাত বাংলার রথযাত্রা। প্রচলিত বিশ্বাস যে, শ্রীক্ষেত্র থেকে গঙ্গাস্নান করতে জগন্নাথদেব মাহেশ আসেন। তারপর সেখানে বিশ্রাম নেন। মাহেশ, গুপ্তিপাড়া, মল্লভূম, রাজবলহাটের রথগুলোতে এক চূড়ান্ত দৈবশোভা প্রদর্শিত হয়। উৎসবের সময় এইসব অঞ্চল ভরে যায় সাধারণ মানুষের বিপুল সমাগমে।

মাহেশের রথযাত্রা

পুরীর রথযাত্রা

পঞ্চম শতাব্দীতে (৪০১-৫০০ খ্রি.) চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতে এক অভিনব রথের শোভাযাত্রার বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। আসলে তা ছিল সম্রাট অশোকের ধর্ম সম্বন্ধীয় শোভাযাত্রা। সেই রথের মাধ্যমে অশোকের রাজত্বসময়ে ধর্মবিধি প্রচার করা হত। ধর্ম প্রচারের জন্য অশোক কিছু পদ সৃষ্টি করেছিলেন। এঁরা অশোকের হয়ে ধর্ম প্রচার করতেন। অশোক নির্মিত পদগুলি হল— ধর্মমহামাত্র ও ধর্মযুক্ত। তিনি এঁদের মাধ্যমে রাজ্য জুড়ে নিজের ধর্মমত প্রচার করতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-

ডাইনোসরের মুখে সরলতার হাসি, বাংলার কোথায় তৈরি হয় ঝুলন যাত্রার পুতুল?

শুধু ধর্ম প্রচার নয়, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার দিকগুলিও ধর্মমহামাত্র ও ধর্মযুক্ত নজর রাখতেন। ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত পালি গ্রন্থ ‘ধম্মপদ’-এর অনুবাদক শ্রীচারুচন্দ্র বসু 'অশোকের অনুশাসন' গ্রন্থে এ-তথ্য দিয়েছেন। তবে এর কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই। অনেকেই মনে করেন, অশোকের সময়কার বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধীয় রথযাত্রা থেকেই পুরীর রথযাত্রা উৎসবের উদ্ভব। সম্রাট অশোকের সময়ে চারকোণাকৃতির রথ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তাঁর সময়কালে ধর্মপ্রচার ও বছরের বিশেষ কিছু দিনেই রথযাত্রা হত। শ্রীচারুচন্দ্র বসুর লেখাতে ফা-হিয়েন-এর ‘পাটলিপুত্র-এর বর্ণনাতে মেলে,

প্রত্যেক বছরের দ্বিতীয় মাসে অষ্টমী তিথিতে নগরবাসীগণ নানাবিধ বংশ দন্ডের সাহায্যে চারটি চক্র বিশিষ্ট পঞ্চতল রথ প্রস্তুত করেন। নানাবিধ রঙের ধ্বজা পতাকা দ্বারা সুশোভিত থাকত। দশ পনেরো খানি রথ একত্রে রাজপথে বাহির হইত। নানাবিধ গীতবাদ্যে পরিবৃত হইয়া নগরবাসিগণ দলে-দলে রথের সন্মুখে বাহির হইত।

এই রথগুলো নগরের মধ্যে সারা রাত থাকত। রথের চারিদিকে থাকতো চারটি বুদ্ধমূর্তি। জ্বালানো হত অসংখ্য প্রদীপ। শোভাযাত্রার মাধ্যমে একত্রে বহু লোকের হৃদয়ে ধর্মের সারবস্তু অনুরণিত হতো। বৃহত্তর গোষ্ঠীর জন্যে অশোকের রাজত্বকালে ধর্ম প্রচারের এই রথযাত্রা ও পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে মনে করা হয়। ঐতিহাসিক দিক থেকেও এই সাদৃশ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

More Articles