৬ মাসেই পদত্যাগ! কেন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?
Seikh Hasina : জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১,৪০০। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
"আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই", এই স্লোগান দিয়েই গত বছরে বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা ৩৩ দিন রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেছিল বাংলাদেশের ছাত্রজনতা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। নানা ভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু শেষে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। চাপের মুখে বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয় বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কেন দেশ ছাড়তে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫৩ বছর। আর একক দল হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লিগ। এবং শেখ হাসিনা আওয়ামী লিগের সভানেত্রী তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের জন্য সরকার গঠন করে আওয়ামী লিগ। কিন্তু অগাস্টের শুরুতেই পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় ১৬ বছর। ক্ষমতা গ্রহণের একদম শুরুতে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেলেও, মানুষের মন রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল হাসিনা সরকার।
১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা হেরে গেলে ফের ক্ষমতা পান বিএনপি-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এরপর ২০০৯ থেকে ২০২৪ একটানা ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের পর থেকে সব নির্বাচন হাসিনা সরকারের অধীনেই হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপি এবং আরও কিছু বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে। ২০১৮ সাল পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, বিরোধীরা নির্বাচনে অংশই নেয়নি। সে বছর অত্যধিক মাত্রায় ভোট কারচুপি হয়েছিল।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের উপদেষ্টা মাহফুজের মুখে ওয়ান ইলেভেন প্রসঙ্গ! ওয়ান ইলেভেন কী?
২০২৪ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন আবারও নিরপেক্ষ হয়নি। এর কিছু মাস পরই কোটা সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালত রায় দিলে, টানা আন্দোলন ও অবরোধের মত কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এই চলমান আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে লেগে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবুও শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অন্যদিকে, পড়ুয়াদের সন্ত্রাসবাদী ছকের অংশ বলে দাগিয়ে দিয়েছিল হাসিনা সরকার। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১,৪০০। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
গত বছর ২৭ জুলাই-এর 'মানবজমিন' পত্রিকার প্রথম পাতার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল - '৫৫০ মামলা ৬ হাজারের বেশি গ্রেফতার।' প্রতিবেদনটিতে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রের বরাতে লেখা হয়েছিল, ২৬ জুলাই পর্যন্ত দেশজুড়ে ৫১টি জায়গায় প্রায় ৫৫০টি মামলা করা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলাই করেছিল পুলিশ ও ছাত্রলিগ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট পরিষেবা তখনও পুরোপুরি চালু করা হয়নি, কারফিউ পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়নি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তখন বন্ধ ছিল।
জুলাই আন্দোলন কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে সূচনা হলেও, পরে শুধুমাত্র এই ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সব মিলে দিশেহারা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। যত রকম নির্মম, ভয়াবহ রূপ হতে পারে, তার সব অভিজ্ঞতাই বাংলাদেশের হয়ে গিয়েছিল।
শেষে ৩ অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঢাকার কেন্দ্রীয় মিনার থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বলা হয়, ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ জুড়ে বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান করবেন তাঁরা। এবং পরদিন ৬ অগাস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি পালন করা হবে। কিন্তু হঠাৎই ৪ অগাস্ট বিকেলে সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ একটি বিবৃতি দিয়ে জানান 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ৫ অগাস্টই হবে। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরই ৪ অগাস্ট সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ঢাকা-সহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করে হাসিনা সরকার।
৫ অগাস্ট সকাল থেকেই বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি শুরু হয়। অন্যদিকে, চলছিল সরকারের ঘোষিত কারফিউ। তবে কারফিউ-র তোয়াক্কা না করেই লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারী রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই দিন। শেষ পর্যন্ত ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন- ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি! গত বছর ৫ অগাস্ট কী হয়েছিল বাংলাদেশে?
এর আগে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে একটানা ১১ মাস কারাগারেও বন্দি ছিলেন হাসিনা। বাংলাদেশের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, চাঁদাবাজির এক মামলার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল হাসিনাকে। অভিযোগ ছিল, শেখ হাসিনা এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিম ২ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। এখন গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। বিভিন্ন অবৈধ সম্পদের খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি, হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধেও একের পর এক অভিযোগ সামনে আসছে।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা-সহ তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পাঁচটি অভিযোগ করেছে। প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।ওই বক্তব্যে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলনকারীদের 'রাজাকারের বাচ্চা', 'রাজাকারের নাতি-পুতি' বলে উল্লেখ করেছিলেন। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের 'হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ' দিয়েছিলেন। তৃতীয় অভিযোগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ-কে হত্যার ঘটানাটির কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ অভিযোগে গত বছরের ৫ অগাস্ট ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আন্দোলনকারী ছয় জনকে গুলি করে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম অভিযোগে নিরস্ত্র ছয় জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে হাসিনাকে। তা ছাড়া সম্প্রতি শেখ হাসিনার বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অডিও ফাঁস হয়েছিল।
প্রশ্ন হল, এখনও কী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে না?

Whatsapp
