ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের রমরমা! কেন একদিকে মুনাফা অন্যদিকে হতাশা?

Medical Tourism India: পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৪৭ শতাংশই মানুষকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়, অর্থাৎ এখনও স্বাস্থ্যসেবা গরিব মানুষের কাছে নাগালের বাইরে।

AG

ভারত আজ বিশ্ব মানচিত্রে চিকিৎসা পর্যটনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। চিকিৎসার খরচ, চিকিৎসকের দক্ষতা, আধুনিক কাঠামো এবং ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয় ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের বাজারকে প্রতিনিয়ত প্রসারিত করছে। ২০২৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে চিকিৎসার জন্য বিদেশি পর্যটকের আগমন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৩১ লক্ষ, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এক নম্বর এবং বিশ্বব্যাপী শীর্ষ দশ মেডিক্যাল ট্যুরিজম গন্তব্যের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।

চিকিৎসা পর্যটনের এই উত্থানের পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল ব্যয় এবং সাশ্রয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে যেসব জটিল সার্জারি করতে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হয়, ভারত সেখানে মাত্র এক–তৃতীয়াংশ বা কখনও এক–চতুর্থাংশ খরচে চিকিৎসা দিতে সক্ষম। আমেরিকায় হার্ট বাইপাস সার্জারির গড় খরচ যেখানে প্রায় ১ লক্ষ ডলার, ভারতে সেই খরচ প্রায় ২০০০ থেকে ৪০০০ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি পশ্চিমী দেশ থেকেও বহু রোগী ভারতে আসতে শুরু করেছেন। ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজমের মূল বাজার তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ, নেপাল, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। শুধু বাংলাদেশ থেকেই প্রতিবছর প্রায় ৫০,০০০ রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য আসেন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব থেকেও চিকিৎসা পর্যটক আসছে। তাঁদের অন্যতম কারণ হল উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা, ইংরেজিভাষী ডাক্তারদের সহজ যোগাযোগ এবং তুলনামূলক কম খরচ। কেপিএমজির একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের স্বাস্থ্য পর্যটন শিল্পের আকার ২০২৫ সালে যেখানে দাঁড়াবে প্রায় ১৮.২ বিলিয়ন ডলার, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেটি বেড়ে ৫৮.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। এই বিপুল বৃদ্ধি কেবল সংখ্যার খেলা নয় বরং ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও পরিষেবার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক সূচকে ভারতের অবস্থানও লক্ষ্য করার মতো। মেডিক্যাল ট্যুরিজম ইনডেক্সে বর্তমানে ভারত রয়েছে ১০ নম্বরে এবং ওয়েলনেস ট্যুরিজমের দিক থেকে সপ্তম স্থানে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হিসেবে সামনে রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যারা দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবুও ভারত ধীরে ধীরে এই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে জায়গা করে নিচ্ছে। উন্নত মানের চিকিৎসা প্রযুক্তি, দক্ষ চিকিৎসক, সাশ্রয়ী খরচ এবং ইংরেজি ভাষায় পরিষেবা পাওয়ার সুবিধা ভারতের বাড়তি শক্তি।

ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজম নিয়ে বিজনেস টুডের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারত সরকার ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশকে 'গ্লোবাল হেলথ ট্যুরিজম হাব' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্য চালু করা হয়েছে 'হিল ইন ইন্ডিয়া' এবং 'হিল বাই ইন্ডিয়া' প্রকল্প। প্রথম প্রকল্পের লক্ষ্য বিদেশিদের চিকিৎসার জন্য ভারতে টেনে আনা, আর দ্বিতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতীয় ডাক্তারদের দক্ষতা আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেওয়া। ইতিমধ্যেই দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরু মেডিক্যাল ট্যুরিজমের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের স্বাস্থ্যসেবা শিল্পের আকার বর্তমানে প্রায় ৩৭২ বিলিয়ন, যার মধ্যে মেডিক্যাল ট্যুরিজম খাতের অবদান প্রায় ৯ বিলিয়ন। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৬ সালের মধ্যে এই খাত ১৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী মেডিক্যাল ট্যুরিজম মার্কেটের ৬% শেয়ার ইতিমধ্যেই ভারতের দখলে।

আরও পড়ুন- GBS সংক্রমণ: কেন পনির, মাংস, দুধ নিয়ে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা?

'হিল ইন ইন্ডিয়া' প্রকল্প এই অগ্রযাত্রাকে আরও মজবুত করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে বিশেষ মেডিক্যাল ক্লাস্টার, আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য সহজ ভিসা প্রক্রিয়া এবং ডিজিটাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক। এর পাশাপাশি আয়ুর্বেদ, যোগ, ও হোলিস্টিক হেলথের মতো ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জ্ঞানকেও নতুন করে তুলে ধরা হচ্ছে, যা পশ্চিম দেশের রোগীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। প্রথমত, ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনও শহরকেন্দ্রিক। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদের মতো মেট্রো শহরগুলিই আন্তর্জাতিক রোগীদের টানছে কিন্তু দ্বিতীয় সারির শহর বা গ্রামীণ অঞ্চলে সেই মানের পরিকাঠামো নেই। কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন এখনও এক বড় প্রশ্নচিহ্ন। সব হাসপাতাল একরকম পরিষেবা দিতে পারছে না, ফলে আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মেডিক্যাল ট্যুরিজমের এই উত্থান দেশের সাধারণ নাগরিকদের চিকিৎসা প্রাপ্যতায় কী প্রভাব ফেলবে—সেটিও এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রশ্ন।

তবুও সামগ্রিক ছবিতে ভারত আজ বিশ্বের চিকিৎসা মানচিত্রে এক সম্ভাবনাময় শক্তি। 'বিশ্বগুরু' হওয়ার যে কল্পনা রাষ্ট্রপতি থেকে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত বারবার উচ্চারিত হয়, তার এক বাস্তব দিক ফুটে উঠছে এই মেডিক্যাল ট্যুরিজমের উত্থানে। চিকিৎসা কেবল অর্থনীতির অংশ নয়, কূটনীতিরও হাতিয়ার। কারণ সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়া প্রতিটি বিদেশি রোগী ভারতের স্বাস্থ্যদূত হয়ে ওঠেন। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারত যদি নিজেকে সত্যিকারের গ্লোবাল হেলথ ট্যুরিজম হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে শুধু আন্তর্জাতিক রোগীদের টানাই নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমানভাবে শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি। সেই ভারসাম্য রক্ষাই হবে ভবিষ্যতের আসল চ্যালেঞ্জ।

এই সাফল্যের পাশাপাশি একাধিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিদেশি রোগীরা প্রধানত বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও ভারতের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনও অবকাঠামোগত সংকটে ভুগছে। হু-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রতি ১,০০০ জনে চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ০.৯, যেখানে হু-এর ন্যূনতম মান ১ জন। এর ফলে সাধারণ ভারতীয় নাগরিক এবং বিদেশি চিকিৎসা পর্যটকদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার মানের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়া ভিসা জটিলতা, হাসপাতালগুলির স্বচ্ছতার অভাব এবং মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্টদের দৌরাত্ম্যও ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পের অগ্রগতিতে অন্তরায়। তারপরও ভারত এই খাতকে কৌশলগতভাবে উন্নত করার চেষ্টা করছে। মেডিক্যাল ভিসা ইস্যুর প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে, যাতে রোগীরা দ্রুত অনুমোদন পান। এছাড়া বিশেষ আয়ুস ভিসা চালু করা হয়েছে, যেখান থেকে বিদেশিরা আয়ুর্বেদ, যোগ, ন্যাচারোপ্যাথি, ইউনানি, হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার সুবিধা নিতে পারবেন। এটি ভারতের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছে।

তবে এই খাতকে টেকসই করতে হলে সরকারি হাসপাতালের মানোন্নয়ন, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, এবং স্বচ্ছ স্বাস্থ্যনীতি প্রয়োজন। তা না হলে "হিল ইন ইন্ডিয়া" উদ্যোগ শুধু বিদেশিদের কাছে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, সাধারণ ভারতীয়র স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিফলিত হবে না। দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার চিত্র একেবারেই সমান নয়। যদিও সরকারি হিসেবে ডাক্তার-রোগীর অনুপাত প্রায় ১:৮৩৪ যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য—তবুও শহর ও গ্রামের মধ্যে এই বণ্টন গভীর বৈষম্যমূলক। একদিকে দিল্লি, মুম্বই বা চেন্নাইয়ের বহুজাতিক হাসপাতালগুলোতে রোবোটিক সার্জারি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন হচ্ছে, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা ঝাড়খণ্ডের গ্রামে সাধারণ রোগী মৃত্যুর পর পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স পান না। জরুরি সেবা ও অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্কের দুর্বলতা এতটাই প্রকট যে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসা পাওয়ার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়।
এছাড়া ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রেও এক গভীর সমস্যা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে প্রায়ই স্টক শেষ হয়ে যায়, যার ফলে রোগীদের বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হয়। অনেক সময় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ না মেলার ফলে কালোবাজারি মাথা তোলে—কোভিডের সময় অক্সিজেন ও রেমডেসিভির নিয়ে যেমন হয়েছিল। সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, দেশের সরকারি হাসপাতালের জরুরি ওষুধের স্টক একাধিক রাজ্যে ৪০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এর ফলে দরিদ্র শ্রেণি সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন- ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করেন তিনিই! ‘কালো ভারতীয়’ এই চিকিৎসককে ফিরিয়েছিল হাভার্ড!

এই প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও এক বড়ো বাধা। দলিত ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী এখনও অনেক জায়গায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন। কোথাও কোথাও হাসপাতালে বৈষম্যমূলক আচরণ, আলাদা বেডে রাখা বা অবহেলার শিকার হতে হয়। একাধিক গবেষণা দেখিয়েছে, এই কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ও পুষ্টিহীনতার হার গড়পড়তা জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। এই দু-রকম চিত্রই ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আসল রূপ—একদিকে বিশ্বমানের মেডিক্যাল ট্যুরিজম, অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চিকিৎসার অভাব। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৪৭ শতাংশই মানুষকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়, অর্থাৎ এখনও স্বাস্থ্যসেবা গরিব মানুষের কাছে নাগালের বাইরে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, বিদেশি রোগী আনার সাফল্য যদি দেশের প্রান্তিক মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবায় কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন না আনে, তবে সেই সাফল্য কতটা অর্থবহ?

ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজমের আন্তর্জাতিক সাফল্য যতই চোখে পড়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি স্পষ্টভাবে দেখায় যে দেশীয় জনগণের স্বাস্থ্যসেবা এখন প্রাধান্য পাচ্ছে না। বিদেশি রোগী আকর্ষণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বেসরকারি হাসপাতালের উন্নয়নে বেশি বিনিয়োগ করা হচ্ছে, আর গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার প্রায়শই উপেক্ষিত। অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার ঘাটতি, সরকারি হাসপাতালের ওষুধের অভাব, দলিত ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য—এসবই নির্দেশ করে যে দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে নীতি তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এই অমিল সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করতে পারে, রাজনৈতিক আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে এবং স্বাস্থ্যসেবার মূল দায়িত্ব—সামাজিক সমতা ও নাগরিক সুরক্ষা অবমূল্যায়িত রাখে। তাই মেডিক্যাল ট্যুরিজমের সাফল্য যতই গ্লোবাল ইমেজ গড়ুক, দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত না করলে তা রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।

More Articles