জলের তলায় উত্তরবঙ্গ! কী পদক্ষেপ নিল রাজ্য ও কেন্দ্র?
North Bengal Flood 2025:আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত মাত্র আট ঘণ্টায় কিছু এলাকায় বৃষ্টির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ৩০০ মিলিমিটার।
এক রাতের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা। দার্জিলিং, কালিম্পং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে শুরু করে আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার— সর্বত্রই বন্যা ও ধসের দাপটে জনজীবন বিপর্যস্ত। নিম্নচাপের জেরে টানা বর্ষণে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তোর্ষা নদী, ডুবে গিয়েছে বিস্তীর্ণ চা বাগান, গ্রাম ও শহরাঞ্চল। উত্তরবঙ্গে একটানা বৃষ্টির জেরে জলদাপাড়া, গোরুমারা এবং জলঢাকা অঞ্চলে প্রকৃতির যে রুদ্ররূপ দেখা দিয়েছে, তাতে প্রাণিকুল থেকে মানুষ— কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। এই তিনটি এলাকা শুধু পর্যটন নয়, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। এখন সেখানেই মৃত্যু, ধ্বংস আর অসহায়তার ছবি।
মিরিক, নাগরাকাটা ও কালিম্পংয়ের চা-বাগান অঞ্চলগুলিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। অনেক জায়গায় চা শ্রমিকদের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। শিলিগুড়ি ও কোচবিহার থেকে জাতীয় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পাহাড়ের ঢাল ভেঙে পড়ায় রেল চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে দার্জিলিং রুটে।
ডুয়ার্সের গর্ব জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান এখন কার্যত তিস্তা ও তোর্সার জলে ভরে গিয়েছে। বন দফতরের খবর অনুযায়ী, বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে ওঠা তিস্তা, তোর্সা, মালঙ্গি ও হলং নদীর জল উদ্যানের ভেতর ঢুকে পড়েছে। জলদাপাড়ার দক্ষিণাঞ্চলের হাতি করিডর সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। অন্তত ১৫টি গন্ডার এবং প্রায় ৬০টি হরিণ নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে আনা হয়েছে। বনকর্মীরা নৌকা ব্যবহার করে টহল দিচ্ছেন, যাতে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানো যায়। একাধিক গ্রাম— দলগাঁও, জয়গাঁও, হোলংপাড়া— জলের নিচে। প্রায় ৫০০ পরিবারকে উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে নেওয়া হয়েছে। বন্যার জলে ডুবে গিয়েছে ঘর, রাস্তাঘাট, পর্যটন বাংলো। জলদাপাড়া সাফারি বন্ধ রাখা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। স্থানীয় গাইড ও ড্রাইভারদের আয় কার্যত বন্ধ।
আরও পড়ুন
বন্যার মাঝে কার্নিভালে মুখ্যমন্ত্রী! অমানবিক রাজনীতির কৈফিয়ত কী?
গোরুমারা জাতীয় উদ্যানেও একই চিত্র। গাজলডোবা, লাটাগুড়ি নদীর তীরে ভয়াবহ বন্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় গোরুমারার ভেতরে একাধিক জায়গায় ধস নেমেছে। গোরুমারার দক্ষিণ প্রান্তের চাপরামারি ফরেস্ট রেঞ্জ-এর রাস্তায় ফাটল ধরেছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, অন্তত ৭০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। পর্যটন সম্পূর্ণ বন্ধ। বনবিভাগ জানিয়েছে, প্রাণীদের সুরক্ষাই এখন প্রথম কাজ। স্থানীয়রা এমনও জানাচ্ছেন যে, বন থেকে হরিণ, বুনো শুকর, এমনকি গন্ডারও গ্রামে ঢুকে পড়ছে। খাবারের অভাবে প্রাণীরাও আতঙ্কিত। অন্যদিকে, বন্যার জলে বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেসে গিয়ে প্রাণীদের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
জলঢাকা ও নাগরাকাটা ব্লকেও ভয়াবহ চিত্র। তিস্তা, জলঢাকা ও নোনাই নদীর জল বিপজ্জনক উচ্চতায়। বাঁধ ভেঙে গ্রাম ডুবে গেছে। জলঢাকার বহু পার্শ্ববর্তী বহু এলাকা সম্পূর্ণ জলের নিচে। এনডিআরএফ ও সিভিল ডিফেন্সের দল নৌকায় করে উদ্ধার করছে মানুষকে। নাগরাকাটার শুধু মাত্র সুলকাপাড়াতেই ৪ জন মৃত এবং ২৫ জন নিখোঁজ।
আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত মাত্র আট ঘণ্টায় কিছু এলাকায় বৃষ্টির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ৩০০ মিলিমিটার। ধস নেমেছে একাধিক জায়গায়। এখন পর্যন্ত অন্তত ২৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার সকালে উত্তরবঙ্গে পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিলিগুড়িতে বিপর্যস্ত এলাকাগুলি ঘুরে দেখেছেন তিনি এবং প্রশাসনের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, বিপর্যস্ত এলাকাগুলিতে উদ্ধারকাজ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। দুর্গতদের সাহায্যের জন্য চালু করা হয়েছে বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মিলিয়ে সেনা ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (NDRF) কাজ শুরু করেছে। শিলিগুড়ি, মিরিক, কালিম্পং, নাগরাকাটা, বানারহাট ও জলপাইগুড়ির বিভিন্ন গ্রাম থেকে শতাধিক মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। একাধিক ত্রাণ শিবিরে তাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, বিপর্যয় পরবর্তী সময়ে কৃষক ও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী বলেন,“উত্তরবঙ্গের এই দুর্যোগে যাঁরা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাঁদের পাশে সরকার আছে। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির পরিবারপিছু ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রতি পরিবার থেকে একজনকে হোমগার্ডের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।” তিনি আরও বলেন, সব জায়গায় উদ্ধারকাজ চলছে। প্রাণহানি ঠেকাতে সেনা ও এনডিআরএফ পাঠানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারও ইতোমধ্যেই বিশেষ বাহিনী পাঠিয়েছে। উদ্ধারকাজে মোতায়েন করা হয়েছে এনডিআরএফ ও সেনার দল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, বিপর্যস্ত এলাকায় পর্যাপ্ত খাদ্য, ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আরও পড়ুন
বৃষ্টি, ধসে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গ, কার্নিভাল স্থগিত করা গেল না কেন?
সোমবার সকালে এক্স (Twitter)-এ বার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, দার্জিলিং ও উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলায় যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি মৃতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোকপ্রকাশ করেন এবং আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সুস্থতার কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খবর শুনে আমি গভীরভাবে ব্যথিত। যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই। রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে। প্রয়োজনে সবরকম সাহায্য পাঠানো হবে।”
এছাড়া তিনি জানান, কেন্দ্রীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতর (NDMA) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে এনডিআরএফ-এর বিশেষ দল ইতিমধ্যেই মিরিক, কালিম্পং ও জলপাইগুড়িতে মোতায়েন করা হয়েছে। বিপর্যস্তদের উদ্ধারে এবং পুনর্বাসনে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করছে কেন্দ্রীয় দলগুলি। প্রধানমন্ত্রী দফতরের সূত্রে জানা গেছে, এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলিকে আর্থিক সহায়তার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষ জরুরি তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে।
কেন্দ্র–রাজ্য প্রশাসন উভয়েই এখন বিপর্যস্ত মানুষদের উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্বাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। বন্যা শুধু মানবিক সংকট নয়, এক গভীর পরিবেশ সংকেত। এই অঞ্চলগুলির জীববৈচিত্র্য, চা বাগান অর্থনীতি, ও পর্যটন— সবই থমকে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তা প্রকল্পের জলধারণ ও নিষ্কাশন নীতির পুনর্বিবেচনা জরুরি, নইলে উত্তরবঙ্গের ইকোসিস্টেম আগামী দশকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Whatsapp
