অচেনা ভিডিও কলে যৌন হাতছানি, সাড়া দিলেই বিপদ! কীভাবে সতর্ক হবেন, জেনে নিন

Video Chat Sex Trap: যৌনতার টোপ দেখিয়ে জালবন্দি করার ভূরি ভূরি উদাহরণ থাকলেও অনলাইনে এই ফাঁদ নাকি আতঙ্কের! কেন, কী ঘটছে?

আপনি কি সিঙ্গল! প্রতিষ্ঠিত! অথবা পরিচিত মুখ! সমাজে খানিকটা বা রীতিমতো সম্মান রয়েছে আপনার! অথবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিক্ষক, অধ্যাপক, পুলিশ, সরকারি অথবা বেসরকারি চাকরি করেন? তাহলে সামনে বিপদ! একটু অসতর্ক হলেই ফাঁদে পড়বেন আপনিই! মুহূর্তেই সম্মান বাঁচাতে খোয়াবেন হাজার হাজার টাকা। জীবন শেষ করার ইচ্ছে এলেও অবাক হবেন না কেউই! কেন, ঠিক কী হয়েছে আবার?

যদিও এখনই নয়, বেশ কয়েক বছর ধরে সোশ্যাল অথবা অনলাইন অ্যাপে কথা বলতে গিয়েই ফাঁসছেন বহু মানুষ। যা উৎসবের মরশুম আসতেই বেড়েছে ফের। প্রতি মুহূর্তেই অনলাইন মধুর টোপে আটকে যাচ্ছেন একের পর এক মানুষ। এই মধুর মুচমুচে অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই বলছেন, এ ভয়ানক! যৌনতার টোপ দেখিয়ে জালবন্দি করার ভূরি ভূরি উদাহরণ থাকলেও অনলাইনে এই ফাঁদ নাকি আতঙ্কের! কেন, কী ঘটছে?

জানা গিয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরেই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জারের মতো একাধিক অনলাইন চ্যাটিং অ্যাপের মাধ্যমে বিপদে পড়ছেন বহু মানুষ। যেখানে মূলত অচেনা নম্বর অথবা ফেসবুক প্রোফাইল থেকে কেমন আছেন, কী করছেন জাতীয় আলাপের প্রারম্ভিক মেসেজ আসছে। কথা চলতে চলতেই গভীর হচ্ছে জিজ্ঞাসা। আর তার উত্তর দিলেই অপর প্রান্ত থেকে ভিডিও কলের প্রস্তাব আসছে কখনও কখনও। আবার কখনও সেই প্রস্তাবের আগেই সরাসরি ভিডিও কল করা হচ্ছে ওই ব্যক্তিকে। বিশেষত, এই ক্ষেত্রে লক্ষ্য হচ্ছেন পুরুষরা। আর সেই ভিডিও কল ধরতেই ঘনিয়ে আসছে বিপদ। অপর প্রান্তে উলঙ্গ নারীশরীর অথবা যৌন উদ্দীপক কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর এই প্রান্তের ব্যক্তির মুখ-সহ ভিডিও কলের পরেই অপরপ্রান্ত থেকে শুরু হচ্ছে নতুন খেলা। ভিডিও কলে ফেঁসে যাওয়া ব্যক্তির ভার্চুয়াল বন্ধুবৃত্ত অথবা কনট‍্যাক্ট লিস্টে থাকা ব্যক্তিদের সেই স্ক্রিনশট, স্ক্রিন রেকর্ড পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি, সঙ্গে দাবি করা হচ্ছে বহু টাকা। দাবি আদায় না হলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করার হুমকি আসছে নিরন্তর। বেশিরভাগই টাকা দিচ্ছেন ফাঁদে পড়ে। এই মধুতে আক্রান্ত হয়ে পুলিশের কাছে সম্মানের ভয়ে যাচ্ছেন না প্রায় অনেকেই!

আরও পড়ুন: সহজেই লোনের প্রলোভন! এই অ্যাপগুলি হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুফাঁদ

সম্প্রতি এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন উত্তর ২৪ পরগনার এক পরিচিত শিক্ষক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, "কিছুদিন আগেই আমার কাছে অচেনা নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মহিলার ছবি ছিল ওই প্রোফাইলে। আমিও কথা বলতে শুরু করি। এরপর ভিডিও কল করতেই সহজভাবে ধরি। ব্যাস, তারপরের অবস্থা মারাত্মক। সম্মানের ভয়ে চেপে গিয়েছিলাম। প্রায় ৪০ হাজার টাকা খুইয়ে ফেলার পর এক বন্ধুর সাহায্যে বাঁচি।"

কয়েক দিন আগে একই অভিজ্ঞতা হয় হাওড়ার এক অধ্যাপকের। তিনিও পুলিশে অভিযোগ করেননি। পরে যদিও বাঁচেন টাকা দেওয়ার হাত থেকে। গতকাল একই অভিজ্ঞতা হয়েছে এক প্রবীণ সাংবাদিকের। তিনি জানান, "আমার কাছেও একইভাবে মেসেজ করা হয়, আমি উত্তর দেওয়ার আগেই হঠাৎ ভিডিও কল। পেশার টানে কল রিসিভ করতেই ওই অবস্থা। এরপর আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীকে ওই রেকর্ড, স্ক্রিনশট পাঠিয়ে দিয়েছে বলে আমাকে হুমকি দেওয়া শুরু হয়।'' এঁরা প্রত্যেকেই সমাজে পরিচিত মুখ। আর প্রত্যেকেই নিজেদের সম্মান বাঁচাতে নাম প্রকাশেও দ্বিধাগ্রস্ত।

কিন্তু কেন হয় এমন, কীভাবে ঘটে এই কাণ্ড? এই অভিজ্ঞতা হলে কী করবেন আপনি? বাঁচবেন কীভাবে? সব প্রশ্নের উত্তর ইনস্ক্রিপ্ট-কে দিয়েছেন, ইন্ডিয়ান সাইবার সিকিউরিটি-র প্রতিষ্ঠাতা এবং ইন্ডিয়ান সাইবার সিকিউরিটি সলিউশন-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর অভিষেক মিত্র এবং প্রখ্যাত সাইবার বিশেষজ্ঞ-সাইবার আইন-বিশারদ বিভাস চট্টোপাধ্যায়।

কীভাবে হয় এই অপরাধ
এই প্রসঙ্গে অভিষেক মিত্র জানান, মূলত আপনার ফোন নম্বর পাওয়াটা এখন সহজ। শুধু আপনার কনট্যাক্ট লিস্টের ব্যক্তি নন, একাধিক ক্ষেত্রে এই নম্বর ফাঁস হতে পারে। যেমন ধরা যাক, আপনি কোনও জায়গা থেকে ঋণ নিলেন। অনলাইন জিনিস নিলেন। ডেলিভারির জন্য নম্বর দিলেন। যে-কোনও জায়গায় আপনার নম্বর থাকছে, ঠিক সেখান থেকেই আপনার নম্বর চলে যাচ্ছে স্ক্যামারদের কাছে। যারা টাকা দিচ্ছে এই তথ্যের জন্য। এর মধ্যে জড়িত থাকছে নির্দিষ্ট কোনও সংস্থার কর্মীরাই। কলসেন্টার করেও এভাবে তথ্য হাতানো হচ্ছে। আর সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে ফাঁসানোর ছক। লিঙ্ক পাঠিয়ে অথবা কল করে ব্যাঙ্কের তথ্য নেওয়ার সঙ্গেই কখনও কোনও লিংক দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ক্লিক করলেই তথ্য যাচ্ছে ওদের হাতে। উধাও হচ্ছে টাকা। ঠিক এভাবেই আপনাকে মেসেজ করে, ভিডিও কলের মাধ্যমে ফাঁসিয়ে ফেলা হচ্ছে। যেখানে আপনার অপর প্রান্তের ব্যক্তি কিন্তু ওই কলে নেই, হয়তো কোনও পর্নোগ্রাফি চলছে সেখানে। কিন্তু আপনার মুখ ওই কলে দেখা যেতেই কেল্লাফতে হচ্ছে চক্রান্তকারীদের।

ঠিক এই বিষয়েই বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নানাভাবে তথ্য চুরি হচ্ছে। আপনার সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই জেনে নিচ্ছে চক্রান্তকারী। আর সেখান থেকেই বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে ওরা। যেখানে ভিডিও কল একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে।

কাদের এর ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি
বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, এই ভিডিও কলে মূলত লক্ষ্য করা হয়েছে পুরুষ। যাঁরা সামাজিকভাবে খানিকটা বা অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ, যাঁদের মধ্যে সম্মানের ভয় রয়েছে। পুলিশের কাছে যাওয়ার ভয় রয়েছে। এদেরই টার্গেট করছে ওরা।

কোথা থেকে এই চক্রের উৎপত্তি?
অভিষেক জানান, ব্যাংকের টাকা লোপাট-কাণ্ডে জামতারা গ্যাংয়ের কথা আমরা জানি। কিন্তু এই চক্র সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলেই। ঠিক সেইভাবেই ভিডিও কলের ফাঁদ পাতা হচ্ছে দেশেরই একাধিক রাজ্য থেকে। বিদেশি নাম দিয়ে ভিডিও কল মাঝে মাঝে এলেও এর মধ্যে দেশীয় চক্রের হাত থাকার সম্ভাবনাই সর্বাধিক।

বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, এর মধ্যে রাজস্থানের ভরতপুরের মূল হাত রয়েছে বলে বলা হয়। খানিকটা জামতারা গ্যাংয়ের কায়দায় এরাও নাকি পারিবারিকভাবে এই জাল পাতার কাজ করে।

এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে কী করণীয়?
সাইবার বিশেষজ্ঞ অভিষেক মিত্র এবং বিভাস চট্টোপাধ্যায় দু'জনেরই পরামর্শ;

এক, এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে প্রথমেই পুলিশে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। সাইবার ক্রাইম বিভাগের দ্বারস্থ হতে হবে। নির্দিষ্ট নম্বর অথবা প্রোফাইলের লিঙ্ক দিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে। বন্ধু বা পরিচিত-বৃত্তে জানাতে হবে, যাতে সকলেই সতর্ক হন।

দুই, কোনওভাবেই হুমকিতে ভয় পেয়ে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাতে অপরাধীরা আরও সুযোগ পাবে। এই টাকা চাওয়া চলতে থাকবে। বরঞ্চ, টাকা না দিয়ে পাল্টা কড়া মেজাজে কথা বলুন। যা করে করুক, এই মনোভাব নিন। নিজে থেকে মারাত্মক কোনও ভুল না করলে সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশে যাওয়ার হুমকি দিন।

তিন, দিল্লির সাইবার ক্রাইম থেকে কল করছি, এইরকম ফোন কলে ভয় পাবেন না। লজ্জা সরিয়ে বাঁচতে হলে কাছের কাউকে অবশ্যই জানান, সঙ্গে পুলিশকে।

চার, সঙ্গে সঙ্গে নিজের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত করুন। প্রয়োজনে পাসওয়ার্ড বদলে ফেলুন। অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিন। প্রোফাইল খুব প্রয়োজনে স্বল্প সময়ের জন্য লক করুন।

পাঁচ, নিজের ব্যক্তিগত নম্বর কাউকে দেওয়ার সময় সতর্ক থাকুন। কোথায় দিচ্ছেন, কোন নম্বর দিচ্ছেন, কাকে দিচ্ছেন, সেটা ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।

ছয়, অচেনা নম্বরে মেসেজ বা এমনি সাধারণ কলে কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন। ভিডিও কলে কথা বলা যাবে না। অর্থাৎ এড়িয়ে যেতে হবে অচেনা নম্বর অথবা প্রোফাইল থেকে আসা ভিডিও কল।

সাত, যদি কখনও অপরিচিত কারওর ভিডিও কল ধরতেই হয়, তবে কখনওই সামনের ক্যামেরা অন রেখে মুখ দেখানো যাবে না। কোনও ভাবেই ওই যৌন-ফাঁদে ফেলার মূল টোপ অর্থাৎ মুখ, সেটা দেখানো যাবে না। প্রয়োজনে অবশ্যই ফোনের ক্যামেরা, কল ধরতেই বন্ধ রাখতে হবে।

আট, সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা আপনার প্রোফাইলের বিভিন্ন প্রাইভেসি সেটিংয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোন তথ্য শুধুমাত্র আপনার বন্ধু-বৃত্তের মধ্যেই থাকবে, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনার ব্যক্তিগত প্রোফাইলের ছবির ক্ষেত্রেও এই সেটিং এবং মেসেঞ্জারে কে আপনাকে মেসেজ করতে পারবেন, সেগুলোও ঠিক করে রাখতে হবে আগে থেকেই।

নয়, হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে অচেনা নম্বরের মেসেজের উত্তর। বিদেশি না এদেশীয় নম্বর থেকে মেসেজ এল, এসবের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইল ছবি, সেগুলো কারা দেখতে পারবেন সেই প্রাইভেসি সেটিংয়ের ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবে।

কী ভাবছে সাইবার-পুলিশ?
সূত্রের খবর, ওই ভিডিও কল অথবা সাইবার ক্রাইমের অভিযোগ ওঠে যে সমস্ত ডিভাইস থেকে। অর্থাৎ যে মোবাইল ফোন থেকে আপনাকে ফাঁসাতে ভিডিও কল করা হচ্ছে, সেই ফোনের আইএমইআই নম্বরই বাতিল করে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ইতিমধ্যেই ভাবা শুরু করেছেন আধিকারিকরা। এর সঙ্গেই তাঁরা বলছেন, সতর্কতায় এর থেকে বাঁচার মূলধন।

মূলত, যৌন-ফাঁদে পা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করাই মূল উপায়, বলছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। আর সেটা করলেই খানিকটা বাঁচা যাবে এই মধুচক্র থেকে। আর যদিও মধুর মোহে কখনও ভুল হয়ে যায়, লজ্জা ছেড়ে দ্বারস্থ হতে হবে পুলিশের, বলছেন ওঁরা।

More Articles