বিহার নির্বাচন: ফুলকপির টুইটে কোন অতীত মনে করালেন মন্ত্রী?
‘Gobi Farming’ Tweet After Bihar Elections: বিহারে ১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল, সেই দাঙ্গায় অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর তাঁদের দেহ মাটিতে পুঁতে তার উপরে ফুলকপির চারা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিহারের নির্বাচনের ফলাফলের পরে স্বাভাবিক ভাবেই এনডিএ এবং জেডিইউ নেতৃবৃন্দ উচ্ছ্বসিত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, বিহারের পরে এবার বাংলার পালা। এই বাংলার বিজেপি নেতৃবর্গ হিন্দিতে বলা শুরু করেছেন,
বিহার তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, আব বাঙ্গাল কা বারি হ্যায়
এই উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। বিহারে জেডিইউ এবং বিজেপি যে পরিমাণ ভোট পেয়েছে এবং বিরোধীরা যেভাবে দুরমুশ হয়েছে, তাতে এই উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। এর মধ্যে আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোষ্ট করেছেন, যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। উনি একটি ফুলকপি চাষের ক্ষেতের ছবি দিয়ে লেখেন
Bihar Approves Gobi Farming
যাঁরা এই ফুলকপি সংক্রান্ত বিষয়টি জানেন না, তাঁদের জানানো জরুরি যে এই বিহারে ১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল, সেই দাঙ্গায় অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর তাঁদের দেহ মাটিতে পুঁতে তার উপরে ফুলকপির চারা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরে তদন্তকারী অফিসাররা দেখেন, একটি মাঠে ফুলকপি হয়ে আছে, আর তারপরে সেই মাঠ খুঁড়ে বহু মৃতদেহ এবং তার অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। সেই সময়ে এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর হইচই হয়েছিল, কিন্তু আমাদের দেশ তো কোথাও কেউ শাস্তি পেলেও খুব দ্রুতই প্রমাণের অভাবে তাঁরা ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন মাওবাদী শীর্ষনেতা বাসবরাজু শহিদ হলেন, তখন কর্ণাটকের বিজেপির টুইটার হ্যান্ডেল থেকে একটি মিম শেয়ার করা হয়, তাতে দেখা যায় অমিত শাহ একটি শহিদ বেদির সামনে দু'টো ফুলকপি হাতে দাঁড়িয়ে বলছেন ‘RIP Naxalism’। ওই সময়েও সামনে এসেছিল এই ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য অসুবিধাজনক। ওই মিমে যাকে দেখা গিয়েছিল, তিনিই কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অমিত শাহ। তিনিও কিন্তু ওই মিমের বিরোধিতা করে ছিলেন বলে জানা নেই। উল্টে তার কিছুদিন পরে কিংবা আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেছেন ২০২৬ সালে নকশালপন্থা শেষ করবেন, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ প্ররোচনাতেই যে ওই ধরনের টুইট কর্নাটকের বিজেপির তরফ থেকে করা হয়েছিল, তা বোঝাই যাচ্ছে। শুধু বিজেপি সরাসরি এই টুইট করেনি, নানান সময়ে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই ধরনের ফুলকপি সংক্রান্ত টুইট করেছেন এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে তা দিয়েছেন।
গত ২০২০ সালের নির্বাচনে যখন সিপিআইএমএল, বামপন্থীদের মধ্যে চমক লাগানো ফল করেছিল, তারপরে ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে যখন সেই সিপিআইএমএল তাঁদের দু’জন সাংসদকে লোকসভায় পাঠায়, তখনই বিজেপি আরএসএসের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। সংসদে দাঁড়িয়ে যখন তাঁদের এক সাংসদ সুদামা প্রসাদ বাংলাভাষী মানুষের অধিকার নিয়ে বলতে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, ভারতের কি কোনো নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র আছে— তখন তাঁরা চমকে গিয়েছিলেন। এইরকম সরাসরি প্রশ্ন তো সাধারণত কেউ করেন না লোকসভা বা রাজ্যসভায়, যে প্রশ্ন শাসকদলের রাজনীতির ভিতকেই নড়িয়ে দেয়। শাসক কোনোদিনই অপ্রিয় প্রশ্ন সহ্য করে না। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রচার প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছেন ভোজপুর এবং গোপালগঞ্জ জেলায়, যেখানে সিপিআইএমএলের প্রভাব বেশি। তাঁদের উদ্দেশ্যই ছিল যাতে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে বিজেপি বিরোধী ভোটার যাতে বাদ দেওয়া যায়। সেই প্রক্রিয়াতে তাঁরা সফলও হয়েছেন অনেকটা। যে ভোজপুর, আরওয়াল, দলিত পিছড়ে বর্গের মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে একসময়ে বহু গণহত্যা দেখেছে। যে অঞ্চল এখনও লখনপুর বাথে বা আরওয়াল গণহত্যার কথা মনে করে, সেই জায়গায় দলিত মানুষদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে নির্বাচন কমিশনের এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী।
অনেকে বলতেই পারেন, যে ভোটারা বাদ গিয়েছে তারা সিপিআইএমএলের তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? অবশ্যই হয়তো যায় না, কিন্তু এবারের নির্বাচনে সিপিআইএমএল যে ফল করেছে, তা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে নীতীশ কুমারের ১০ হাজার টাকা দিয়ে ভোট কিনে নেওয়ার বিরুদ্ধেও কিন্তু মানুষজন ভোট দিয়েছে। গতবার ১৯ টি আসন লড়ে সিপিআইএমএল প্রায় ১৩ লক্ষ ভোট পেয়েছিল আর এবার ২০ টি আসনে তাঁরা প্রায় ১৪.৪২ লক্ষ ভোট পেয়েছে। আসন সংখ্যা হয়ত ১২ থেকে কমে ২ হয়েছে কিন্তু ভোটের পরিসংখ্যানে তাঁরা প্রায় একই জায়গায় আছে।
তবে এই ফুলকপি’র ক্ষেতের ছবি কিন্তু শুধুমাত্র নকশালপন্থী রাজনীতিকে শেষ করে দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে এমনটা নয়। ভাগলপুরের ৩৫ বছর আগের দাঙ্গায় যে অসংখ্য সংখ্যালঘু মুসলমান হত্যা হয়েছিল, তা মনে করানোর জন্যেই এই টুইট বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এবারের বিহার নির্বাচনে সীমাঞ্চল, যেখানে মূলত মুসলমান মানুষদের বাস, সেই অঞ্চলে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির এআইএমআইএম মহাগঠবন্ধনের বাইরে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেখানে তাঁরা ৫ টি আসন জিতলেও, পুরো বিহারে বহু জায়গায় মিমের কারণে বহু জায়গায় মহাগঠবন্ধনের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। ফলস্বরূপ এই মূহুর্তে বিহারে সংখ্যালঘু বিধায়কের সংখ্যা কমেছে। ২০২৫ সালে বিহারে নির্বাচিত মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা ১১ জনে নেমে এসেছে, যা দশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ৪২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যখন ১৯ জন মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০২২ সালের বিহারের জাতিগত জনশুমারি অনুসারে, বিহারের জনসংখ্যার ১৭.৭ শতাংশ মুসলিম। যদিও ঐতিহাসিকভাবে রাজ্য বিধানসভায় তাঁদের প্রতিনিধিত্ব কম ছিল, যা বিহার বিধানসভার সদস্যদের ১০ শতাংশ বা আরও কম। এই নির্বাচনে ২৪৩ সদস্যের সভায় তাঁদের উপস্থিতি মাত্র ৪.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
সুতরাং আজকে যে আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই ফুলকপির ক্ষেতের ছবি দিয়েছেন, তার মধ্যে শুধু নকশালপন্থী রাজনীতির শেষ ঘোষণা করেননি, মুসলমানদের উদ্দেশ্যেও একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন। ভাগলপুরের দাঙ্গার স্মৃতি উস্কে দিয়ে আসলে বিজেপি যে বুলডোজারের রাজনীতিকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটাই তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছে। শুধু কথায় নয় কাজেও যে তাঁরা ওই ধারণাই লাগু করবে তাও তাঁরা প্রমাণ করেছে। নতুন সরকার গঠনের পরপরই বিহার জুড়ে অপারেশন বুলডোজার শুরু হয়েছে, যা অনেক শহরে ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। প্রশাসন অবৈধ রাস্তা দখলের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কতা জারি করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে কেউ যদি আবার সরকারি জমি দখল করে তবে তাকে আরও ভারী জরিমানা এবং পুনরায় ভাঙনের মুখোমুখি হতে হবে। বুলডোজার ইতিমধ্যেই সমস্তিপুর, সীতামঢ়ী, ভাগলপুর, মজফ্ফপুর, দানাপুর, লক্ষ্মীসরাই এবং বিহার শরীফ-সহ প্রধান শহরগুলিতে পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে অস্থায়ী এবং স্থায়ী উভয় ধরণের স্থাপনা অপসারণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যাচ্ছে এই অভিযান কোনো বিরতি ছাড়াই অব্যাহত থাকবে। শোনা যাচ্ছে, অনেক দোকানদার এবং বিক্রেতারা আতঙ্কিত।
যে নীতীশ কুমার গরিব মানুষের জন্য এক ডেসিমেল জমি দিতে অপারগ বলেছিলেন, সেই নীতীশ কুমার আদানির জন্য ১,০৫০ একর জমি দিয়েছে মাত্র ১ টাকায়। বোঝাই যাচ্ছে নীতীশ কুমারকে সামনে রেখে এবার আদানিদের জন্য বিহারের দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। সেই কাজ করার জন্যেই কি বিহারে নির্বাচন কমিশন প্রান্তিক দলিত পিছড়ে বর্গের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, সেই প্রশ্নও উঠছেই। সেই জন্যেই কি আসামের মন্ত্রীর এই ইঙ্গিতপূর্ণ টুইট? প্রতিরোধ যাঁরা করতে পারত, তাঁদেরকে নির্বাচনেও পরাজিত করা এবং তাঁদের প্রভাব হ্রাস করা হয়েছে কি একই উদ্দেশ্যে?

Whatsapp
