বিহার এসআইআর: কেন সবচেয়ে বেশি বাদ পড়লেন মহিলারা?

Bihar SIR: সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়— বিহারের ২৪৩ টি আসনের মধ্যে ২৪০ টিতেই মহিলা ভোটারের সংখ্যা কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার কুচাটকোটা কেন্দ্রে।

পশ্চিমবঙ্গে যেমন বলা হয় লক্ষীর ভান্ডার হলো তৃনমূল কংগ্রেসের ধারাবাহিক সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি, তেমনি বিহারে প্রচলিত কথাটি হলো যতদিন মহিলারা নীতিশ কুমারের পক্ষে আছেন, ততদিন তিনি অপরাজেয়। কথাটির সারবত্তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। নীতিশ কুমারের সে রাজ্যে মদ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত মাস্টারস্ট্রোক বলে বিবেচিত হয়েছে। ২০২০ সালে মহিলাদের ভোটই শেষপর্যন্ত তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর আজ ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে সমস্ত রাজনৈতিক দলই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে একাধিক প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে যার লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে মেয়েরা। নগদ অনুদান প্রকল্প গুলো তার আদর্শ উদাহরণ। বিহারের সংসদীয় রাজনীতিতে মহিলাদের বিশেষ ভূমিকা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট।

২০২০ সালে বিহারে পুরুষদের ভোটদান ছিল ৫৪.৬%, মহিলাদের ৫৯.৭%। সে-বার রাজ্যের ২৪৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছিল। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মহিলাদের ভোট শতাংশ ছিল ৫৯.৪৫%, পুরুষদের ৫৫%। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও, এটাই সত্যি যে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকায় এসআইআর (বিশেষ নিবিড় সংশোধন) হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি বাদ পড়লেন মহিলারা। এসআইআর চালু হওয়ার পর আশঙ্কা করা হয়েছিল এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজের দুর্বল শ্রেণি, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ ও মহিলারা। বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা এই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করেছে।

আরও পড়ুন

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তেজস্বী যাদবের সমস্যা, সংকট, সম্ভাবনা

প্রথমে একটা কথা স্মরণ করা প্রয়োজন— বিহারে এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সামারি রিভিশন হয় এবং সেখানে বিহারের চূড়ান্ত ভোটার সংখ্যা ছিল ৭.৮৯ কোটি। এসআইআর হওয়ার পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় সংখ্যাটা হলো ৭.৪২ কোটি। অর্থাৎ ৪৭ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ হয়ে গেল। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে খসড়া তালিকায় ৬৫ লক্ষ এবং চূড়ান্ত তালিকায় আরও ৩.৬৬ লক্ষ ভোটার বিয়োজিত হয় এবং নতুন নাম ওঠে ২১.৫ লক্ষ জনের। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিহারের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ৮.২২ কোটি, এর অর্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ১০% এই ভোটার তালিকায় জায়গা পায়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যতজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নাম বাদ পড়ল, তার ৫৯.৭% মহিলা। এটা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কত বড় বিপদ তা বুঝতে হলে আমাদের বিহারের জনসংখ্যার নারী পুরুষ অনুপাতের দিকে চোখ ফেরাতে হবে।

বিহারে প্রতি ১০০০ জন পুরুষের অনুপাতে মহিলার সংখ্যা ৯১৮ জন। জানুয়ারি মাসে সামারি রিভিশনের পর মহিলা ও পুরুষের অনুপাত ছিল ৯১৪:১০০০ কিন্তু এসআইআর হওয়ার পর নতুন হিসাবটা দাঁড়াল ৮৯৪:১০০০। এইভাবে এক ধাক্কায় মহিলাদের সংখ্যা কমে যাওয়া কখনোই নিছক কাকতালীয় হতে পারে না। এখন পর্যন্ত যে সমস্ত পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তাতে বলা হচ্ছে মৃত্যু হওয়ার কারণে মহিলাদের নাম বাদ গেছে ১১.৬ লক্ষ, পুরুষের ১০.৬ লক্ষ। অথচ বিহারে পুরুষদের মৃত্যু হার মহিলাদের থেকে বেশি। ফর্ম ফিলআপ না করার ক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা ৫.২ লক্ষ, পুরুষদের ৪.৪ লক্ষ। ডুপ্লিকেট এন্ট্রির কারণে মহিলাদের নাম বাতিল ৩.৭ লক্ষ, পুরুষদের ৩.৫ লক্ষ। বিহারে অভিবাসন একটা বড় সমস্যা। কিন্তু এসআইআরে আশ্চর্য হলো মহিলাদের অভিবাসনের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি অথচ কাজের খোঁজে অন্য জায়গায় যাওয়া পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে। আসলে এসআইআর যে পদ্ধতিগত জটিলতা, নথি জোগাড়, নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে জমা দেওয়ার মাপকাঠি তৈরি করেছে পিতৃতন্ত্রের নিগড়ে থাকা মহিলারা, তাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন।

আরও পড়ুন

বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোর! নির্বাচনের সমস্ত সমীকরণ তছনছ করে দেবেন?

চলতি বছর জানুয়ারিতে মহিলারা ছিলেন ভোটার লিস্টের ৪৭.৮% যা সেপ্টেম্বর মাসে হলো ৪৭.২%। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়— বিহারের ২৪৩ টি আসনের মধ্যে ২৪০ টিতেই মহিলা ভোটারের সংখ্যা কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার কুচাটকোটা কেন্দ্রে যেখানে ১০০০ পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ৯৫৬ থেকে কমে ৮৬১ হয়েছে। আমরা যদি জেলাওয়ারী পরিসংখ্যান দেখি তবে মেয়েদের নাম বিয়োজনের ক্ষেত্রে প্রথম ৫ টি জেলা— গোপালগঞ্জ (৯৬৪ থেকে কমে ৮৮৬), কিষাণগঞ্জ (৯৩৭ থেকে কমে ৮৭৪), ভাগলপুর (৯৮২ থেকে কমে ৯৩৯), পূর্নিয়া (৯৩৪ থেকে কমে ৮৯৬), বক্সার (৯৩৩ থেকে কমে ৮৯৭)। আবার নতুন সংযোজনের ক্ষেত্রে মোট ২১.৫ লক্ষের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ১০.৩ লক্ষ।

ভারত যখন প্রজাতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল তখন সাক্ষরতা, আর্থিক রোজগার এবং জাতি বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ককে ভোটাধিকার দিয়েছিল। সংবিধান সভায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে দেশ এর জন্য প্রস্তুত কি না! কিন্তু ডঃ বি আর আম্বেদকর-সহ অন্যান্যরা জোর দিয়েছিলেন— সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ নীতি বাস্তবে রূপান্তরিত করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। ১৭৩ মিলিয়ন সম্ভাব্য ভোটারের তিনি মুখোমুখি হন, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু তিনি উদ্ভাবনের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। তিনি প্রতীক চালু করেছিলেন এবং প্রক্রিয়াগুলো এমনভাবে নকশা করেছিলেন যাতে অংশগ্রহণ সহজ হয়। ভারতের প্রথম নির্বাচন নিঁখুত ছিল না ঠিকই কিন্তু সেটি ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক। বিপরীতে ভারতের ২৬তম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশকুমারের নেতৃত্বে বিহারের এই সংশোধন ঠিক বিপরীত। জন্মসনদ এবং পাসপোর্টের মতো বিরল নথি দাবি করে- যা জনসংখ্যার এক ক্ষুদ্র অংশের কাছে রয়েছে, তিনি সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষকে বিপন্ন করলেন। বিহারের মহিলারা আজ নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসনের শিকার হলেন।

More Articles