এসআইআর | যেভাবে নাভিশ্বাস উঠছে বিএলওদের

BLO's problems:বিএলওরা সবচেয়ে বেশি বিপন্নতার শিকার হচ্ছেন। প্রতি বুথ পিছু একজন আধিকারিক।

মিডিয়ার সৌজন্যে ইতিমধ্যেই ছবিগুলো ভাইরাল। এক শিক্ষক সজল নয়নে জেলাশাসকের কাছে আর্জি জানাচ্ছেন এসআইআর প্রক্রিয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তির। কারণ, এই শিক্ষিত মানুষটি বুথ লেভেল অফিসার(বিএলও)-এর অমানবিক কাজের চাপ নিতে পারছেন না। আরেক জায়গায় দেখলাম এক আইসিডিএস কর্মী একই ভাবে কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরার সামনে তাঁর যন্ত্রণার কথা বলছেন। এই উত্তর আধুনিক সমাজে খবরের বাসি হতে সময় লাগে না, তবুও মনে করাতে চাই, আমাদের এক সহ নাগরিক নমিতা হাঁসদার করুণ পরিণতির কথা। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের তথাকথিত পবিত্রতার ধ্বজা উর্ধ্বে তুলতে গিয়ে তাঁর ব্রেন স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের মানুষজন জানিয়েছেন, বিএলও হিসেবে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এই চিন্তা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত। এই ছবিটা নতুন নয়। অনেকের স্মরণে থাকতে পারে ২০২১ সালে করোনা অতিমারীর ছবিটা যখন সারা পৃথিবীতে প্রকট, তখন চরম অব্যবস্থার মধ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সরকারি কর্মীরা (যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষক) গণতন্ত্রের 'উৎসব' সম্পন্ন করেছিলেন।

এসআইআরের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক অনেক হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিএলওদের বিপন্নতা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এমনকি, বার্ষিক পরীক্ষার মুখে পাঠশালা বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে, চারমাসের সময়সীমায় এই যজ্ঞ কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন করতে আমরা ভুলে গেছি। স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের জীবন তথা অস্তিত্ব রক্ষা করতে বিএলওরা বিচ্ছিন্ন বা সংগঠিত ভাবে প্রতিবাদ করছেন। বর্তমান নিবন্ধ এই বিষয়টিকে আলোচনার বৃত্তে আনতে চায়।

ভোটার তালিকায় সংশোধন যে কোনো গণতন্ত্রে একটি স্বাভাবিক বিষয়। ভারতবর্ষ কখনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মৃতদের তালিকা থেকে বিয়োজন, নতুনদের সংযোজন, স্থানান্তরিত মানুষদের এক তালিকা থেকে অন্য তালিকায় নাম ওঠানো এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত বুথ লেভেল অফিসাররা বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করছেন। কিন্তু এবারের কাজটি একেবারে আলাদা। যাঁরা বলছেন ২০০২ সালে এসআইআর হয়েছিল, তাঁর অর্ধসত্য বলছেন। এভাবে বাড়ি বাড়ি এনুমারেশন ফর্ম বিলি ও ফেরত নিয়ে, তাতে 'ফ্যামিলি লেগাসি ডেটা' বসিয়ে, সেই তথ্য আবার নির্দিষ্ট সময়ে আপলোড করা কখনও হয়নি। এটা এইভাবে করা হচ্ছে কারণ এসআইআর ঘুরপথে এনআরসি। এখানেই বিএলওরা সবচেয়ে বেশি বিপন্নতার শিকার হচ্ছেন। প্রতি বুথ পিছু একজন আধিকারিক। যদি আমরা ধরে নিই বুথ পিছু ভোটার সংখ্যা ১০০০ এবং একটা ফর্ম আপলোড করতে গড়ে ১০ মিনিট সময় লাগবে, তাহলে মোট সময় লাগবে ১০০০× ১০= ১০,০০০ মিনিট। সারা দিন বাড়ি বাড়ি ঘোরার পরে এই পর্বতপ্রমাণ ডেটা নির্দিষ্ট সময়ে আপলোড করা পেশাদারী দক্ষতা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? বিএলও যাঁরা হয়েছেন তাঁরা বেশিরভাগই শিক্ষক এবং আইসিডিএস কর্মী। এঁদের মোবাইল আছে কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অ্যাপে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। প্রাত্যহিক চাকরি জীবনে তাঁরা যে কাজটি করেন, তার কোথাও এই ধরনের পেশাদারি স্কিলের দরকার হয়নি। আর, এই কাজটি ভালোভাবে করতে ল্যাপটপের প্রয়োজন, যা বেশিরভাগ কর্মীর কাছে নেই। ফলত, তারা অকূল পাথারে পড়েছেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে কিছু রাজনৈতিক নেতা ও মিডিয়া। একটি সুপরিকল্পিত প্রচার তথা ন্যারেটিভ, এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে মনে হয়, কোনো নাগরিকের নাম যদি এসআইআর থেকে বাদ যায় তবে তার জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প অপেক্ষা করছে। মানুষ এই প্রচারের খপ্পরে পড়ে আরও আতঙ্কিত হয়ে বিএলওর কাছে ছুটে যাচ্ছেন। বিএলওদের আজ এক প্রাণঘাতী চাপের মুখে কাজ করতে হচ্ছে।

                                      আরও পড়ুন-    কেন ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন সন্দেহজনক?

এসআইআর করতে গিয়ে বিএলওদের অবস্থা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো। টালিগঞ্জ অগ্রগামীকে রিয়েল মাদ্রিদের সাথে ফুটবল খেলতে নামিয়ে দিলে যা হওয়ার কথা, ঠিক তাই হচ্ছে। কাজ শুরু হওয়ার আগে সাধারণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এবারের এসআইআরের জন্য যে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, তা অতি সামান্য ও প্রাথমিক। বিএলওদের ঠিক উপরে (ইমিডিয়েট বস) যে সুপারভাইজাররা আছেন, তাদেরও কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ নেই। তাই বিএলওরা কাজ করতে গিয়ে যে সমস্ত সমস্যার সন্মুখীন হয়েছেন, তার কোনো উত্তর নেই সুপারভাইজারদের কাছে। সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। বিএলওরা নতুন নতুন নির্দেশে বিভ্রান্ত। দু-একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। প্রথমে বলা হল, ভোটারদের ছবি বাধ্যতামূলক নয়, তারপর বলা হল ছবি বাধ্যতামূলক। একটা বড় দ্বন্দ্ব দেখা গেল আত্মীয় বলতে ফর্মে কী বোঝানো হচ্ছে। ঠাকুরদা, ঠাকুমা, দাদু, দিদা, ভাই, বোন- বিতর্ক অন্তহীন। কাজ শুরু হওয়ার ১৫ দিন পরেও ঠিক নির্দেশিকা কী, সে সম্বন্ধে এখনও কর্মীরা নিশ্চিত নন। এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ডেটা আপলোড। প্রথম দিন থেকে কর্মীরা সঠিকভাবে ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের দাবি তুলেছেন কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। আরেকটা বড় সমস্যা হল, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নামের বানান, বয়স, ছবিতে ভুল আছে। কেউ বলছেন সেই ভুলটাই লিখতে হবে, আরেক পক্ষের বক্তব্য পরে যা সংশোধন হয়েছে তা লিখতে হবে। এই প্রশ্নগুলোর চটজলদি কোনো সমাধান নির্বাচন কমিশনের নেই বরং অঘোষিতভাবে আছে শোকজ বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকি।

এমনিতেই সব জায়গায় বহু মানুষ লিখতে পড়তে জানেন না, তার উপর ফর্ম পূরণের ক্ষেত্রে ভুল হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করছে। নির্বাচন কমিশন বুথ লেভেল অফিসার হিসাবে স্থানীয় মানুষদের মনোনীত করেছেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিএলওরা মানবিক কারণে নিজেরাই ফর্ম পূরণ করে দিচ্ছেন। বিশেষ করে গ্রামের দিকে এই ছবিটা বেশি দেখা যাচ্ছে। সত্যিটা হল রাতের ঘুমোনোর সময়টা বাদ দিলে বিএলওরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন। তাও কাজের তুলনায় অতি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।
আজ এই এসআইআর প্রক্রিয়া করতে গিয়ে শিক্ষক তথা সরকারি কর্মীদের বলির পাঁঠা বানানো হল। প্রক্রিয়ার শুরুতে এক নির্বোধ আমলা নিদান দিয়েছিলেন যে, স্কুলে যাবার আগে ও পরে বিএলওরা এসআইআরের কাজ করবে। সমবেত প্রতিবাদে সেই তুঘলকি নিদান প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বাস্তবতার চাপে কোনো কোনো শিক্ষককে (বিশেষ করে প্রাথমিকে) স্কুলে যেতে হচ্ছে। বিএলওদের ফোন নাম্বার সার্বজনীন করে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তির কোনো সমস্যা হলে বা নাম বাদ গেলে প্রথম দায়ী করা হবে বিএলওদের অথচ ফর্ম সংগ্রহ করে আপলোড করা ছাড়া তাঁদের কোনো ক্ষমতাই নেই। দৈহিক পরিশ্রম, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চাপ, সর্বোপরি এক অপদার্থ, অযোগ্য ও রাজনৈতিক অভিসন্ধিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের কারণে আজ বিএলওরা বিপর্যস্ত। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, সুপারভাইজারদের সঙ্গে মিটিং এর সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এক বিএলও ভর্তি হয়েছেন। এই ধরণের ঘটনা আরও ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে এবং এর দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতেই হবে।

 

( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More Articles