বৈজ্ঞানিক সত্যকে তুচ্ছ করে চিতা ফেরানো শুধুই রাজনৈতিক দেখনদারি
Cheetah in India: একদল সংরক্ষণ-বিশারদের মতে কুনো-পালপুরের বাস্তুতন্ত্র চিতার বাসযোগ্য নয়।
গেঁয়ো যোগী যে আদতেই ভিখ পায় না, ভারতে অবশিষ্ট হাতে গোনা কয়েকটি এশিয়াটিক সিংহ-র দিকে আজ তাকালেই বোঝা যাচ্ছে। যে এশিয়াটিক সিংহ-র বিস্তার এককালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর ভারতজুড়ে ছিল, তারা আজ কয়েকশো বর্গমাইলের মধ্যে গুজরাতের গির অভয়ারণ্যে সীমাবদ্ধ। সংখ্যায় ৬০০-র এধার-ওধার। সহজভাবে বললে, এশিয়াটিক সিংহের শিয়রে সংক্রান্তি। কোনও প্রাণী বছরের পর বছর গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সংকীর্ণ জায়গায় আটকা পড়লে, তাদের জিন-পুল ক্রমে বৈচিত্র হারায়, যার ফলে নানারকম রোগ, দুর্যোগের বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারায়। ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, যে বিপদের সম্মুখে গিরের সিংহরা দাঁড়িয়ে রয়েছে আজ বহু বছর। ১৯৯০-এ ঠিক হয়, তাদের কয়েকজনকে মধ্যপ্রদেশের কুনো-পালপুর অভয়ারণ্যে নিয়ে যাওয়া হবে। এশিয়াটিক সিংহ প্রজাতির জেনেটিক সুস্থতা বাড়িয়ে তাকে সংরক্ষণ করার এটাই একমাত্র উপায়। মনে রাখতে হবে, আমরা এমন এক বিগ ক্যাট প্রজাতির কথা বলছি, যার মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রাণী পড়ে রয়েছে একমাত্র এই ভারতে, এবং যাদের সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। বিজ্ঞান তাই বলছে, যদিও আজকের ভারতে বিজ্ঞানের আগে গুরুত্ব পায় রাজনীতি।
গুজরাত বৈজ্ঞানিক মতামতকে ডাউন প্লে করে এই প্রস্তাব থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল, কারণ ভারতে তারাই সিংহ-পর্যটনের একমাত্র নিদর্শন হয়ে থাকতে চায়। প্রাধান্য পেল রাজ্যের গর্ব এবং পর্যটন থেকে উঠে আসা আয়ের ওপর একচেটিয়া অধিকার। এই বিতর্কের সমাধান করার সেভাবে প্রচেষ্টা করল না কোনও দল, না রাজনৈতিক, না সংরক্ষণকর্মী। মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া হলো চিতা ফিরিয়ে আনা প্রকল্পে।
এশিয়াটিক চিতা ভারতে ৭০ বছর হলো বিলুপ্ত। মূলত রাজারাজড়াদের বিনোদনমূলক শিকার আর ব্রিটিশ-নির্দেশিত অবাধ নিধন চিতাকে এই দেশে নিশ্চিহ্ন করে, যদিও বনভূমি সাফ করে উন্নয়নের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি স্বভাবলাজুক চিতাদের আরও সহজে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যায়। সংখ্যায় কমে আসছে দেখে উনিশ শতকের শুরু থেকেই আফ্রিকা থেকে চিতা আনানোর গল্প শোনা যায়, তাতেও তাদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, কারণ সঠিক বাস্তুতন্ত্রর অবনতি। শিকার বাদে, চিতা বিলুপ্তির যে সমস্ত কারণ এক শতক আগে ভারতে ছিল, তার সবক'টি এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে, বরং তার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি ঘটেছে। এই একই কারণের ফলে দেশের অধিকাংশ ছোট-বড় প্রজাতির বন্যপ্রাণ বিলুপ্তির পথে। সেদিকে তাকাব না, আমরা নতুন প্রজাতি আনব।
আরও পড়ুন: আফ্রিকার চিতা ধরে রাখা যাবে ভারতের অরণ্যে?
একদল সংরক্ষণ-বিশারদের মতে কুনো-পালপুরের বাস্তুতন্ত্র চিতার বাসযোগ্য নয়। সেখানে যে ঘাসজমি অঞ্চল রয়েছে, তা চিতার স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের চেয়ে বহুলাংশে কম। যে তৃণভোজী প্রাণীসংখ্যা, তা আফ্রিকান চিতার খাদ্য সংকুলানে ব্যর্থ হবে। ফলে চিতারা আশপাশের গ্রাম-শহরাঞ্চলে ঢুকবে, গবাদি পশু গৃহপালিত পশু জাতীয় সহজ শিকারের লোভে। এতে মানুষ-বন্যপ্রাণের চিরাচরিত যে বিরোধ, তা নতুন করে দেখা দেবে কুনো-পালপুর এলাকায়। ভারতের এমনিতেই অন্যান্য অঞ্চলে (মুম্বইতে লেপার্ড, উত্তর ভারতে লালমুখো বাঁদর, দক্ষিণ ভারতে হাতি) বন্যপ্রাণ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বন-সংরক্ষণ কর্মীরা। সেখানে জেনে-বুঝে নতুন জায়গায় একই বিরোধের দিকে হেঁটে যাওয়া কি খুব প্রয়োজন!
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, কুনো-পালপুরে চিতারা সানন্দে প্রতিস্থাপিত হলো। তারপর? একটা সময়ের পর তারা এই ঘাসজমি ছেড়ে অন্যান্য ঘাসজমি খুঁজতে বেরোবে। এ তাদের প্রবৃত্তি। কিন্তু অন্যান্য ঘাসজমির সঙ্গে কোনও সংযোগ না থাকায় তাদের দশাও হবে গিরের সিংহদের মতো। তখন? এর উত্তরে অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার এক স্বনামধন্য চিতা-বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আমরা হাতে করে একে একে চিতা নিয়ে যাব অন্যান্য ঘাসজমিতে! এই নাকি আধুনিক সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ। ভারতীয় অর্থনীতির নিরিখে এই সমাধান বিশেষভাবে চিন্তাজনক, কারণ এই প্রক্রিয়ায় একেকবারে খরচ হবে লাখ লাখ ডলার। সেসব বাদেও এ ভারি হাস্যকর পরামর্শ। বন্যপ্রাণ সুস্থ, স্বাভাবিক নিয়মে বেঁচে থাকার জন্য যে প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার তা আমরা ধ্বংস করেছি, করে চলেছি। এদিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রকৃতির অনুকরণ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করব, সব ঠিক আছে? এ কেবল ইগোসেন্ট্রিক গা-জোয়ারি নয়, খানিক দূরদর্শিতার অভাব।
এসবের মধ্যে যাঁদের নিয়ে গুটিকয় মানুষ ছাড়া কেউ কথাই বলছেন না, তাঁরা এই কুনো-পালপুরের আশেপাশের গ্রামের মানুষ, যাঁদের উৎখাত করা হয়েছে ভিটেজমি থেকে। ৫০০০-এর ওপর মানুষকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে, শোনা যাচ্ছে, আরও প্রায় ১৭০টি গ্রাম খালি করা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আজ বহু বছর হলো, কিন্তু আজ অবধি এই মানুষগুলির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খুড়োর কলের মতো সামনে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে, অভয়ারণ্য হলে পর্যটনের টাকায় কর্মসংস্থানের অভাব হবে না। তাঁরা প্রথমে ঘর ছাড়লেন সিংহ আসবে ভেবে, এখন জানছে, আসলে থাকতে হবে চিতার এলাকায়। সেখানে নাকি তাঁরা কাজ পাবেন। কিন্তু সিংহ বা চিতা, কারও সঙ্গেই সহাবস্থানে এঁদের প্রস্তুতি বা অভিজ্ঞতা নেই। পৃথিবীর যে-কোনও অঞ্চলে যেসব মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম জঙ্গলের বুকে সফলভাবে বেঁচেছে, তারা সেই বাঁচার কৌশল রপ্ত করেছে বংশানুক্রমিক জ্ঞানে। এর কোনও বিকল্প নেই। বাইরে থেকে মানুষ এসে বই পড়িয়ে সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারে না। পারলেও, তার কোনও প্রয়াস কুনো-পালপুরের আশপাশে দেখা যায়নি। আঞ্চলিক মানুষকে এই চিতা প্রকল্পে কোনওভাবে জড়ানো হয়নি। তাঁরা এই সিদ্ধান্তের অংশীদার নয়, পরবর্তী জীবনে কীসের মুখে পড়বে সে বিষয়ে কেউ তাঁদের তৈরি করছে না। ভবিষ্যতে, চিতা যদি এই মানুষগুলির এলাকায় ঢুকে গরু-ছাগল নিয়ে টানাটানি করে, আর মানুষ যদি চিতা মারতে আরেকবার নতুন করে অস্ত্র তুলে নেয়, দোষ হবে কোন তরফের?
এসব গেল বৈজ্ঞানিক তথ্য, যার গ্রহণযোগ্যতা নতুন ভারতে ক্রমে কমে আসছে, আমরা জানি। এর উল্টো পিঠে একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, চিতা এলে আমাদের বিলুপ্তপ্রায় প্রাকৃতিক ঘাসজমি বাঁচবে। তা, সেই ঘাসজমিতে এখনই অনেক প্রাণী-প্রজাতি থাকে, যারা নিজেরাই বিলুপ্তির পথে। তাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না কেন?
দিচ্ছি না, কারণ চিতা এলে ভারতের পেশি ফুলবে। বুকের ছাতি ছত্রিশ ইঞ্চি ছাপিয়ে যাবে। নানা বিশেষজ্ঞর ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণ হবে, সংরক্ষণের রাজনীতি বেঁচেবর্তে থাকবে, সঙ্গে বাঁচবে জাতীয় রাজনীতি। চিতা আনার কথা শুরু করেছিল এক রাজনৈতিক দল, আজ করে দেখাচ্ছে অন্য দল, সেই দলের রমরমা বাড়বে। সে বলবে ভারতের যে গৌরব হারিয়ে গিয়েছিল, তা ফিরিয়ে এনে ভারতকে আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের বসিয়ে দিল কে? যদিও ভারতে যে চিতা পাওয়া যেত, সেই এশিয়াটিক প্রজাতি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না। এশিয়াটিক চিতার শেষ তিরিশটি ইরানে রয়েছে, যাদের ভবিষ্যৎ ততোধিক অন্ধকার, কারণ দেশের ৬ জন চিতা-বিশেষজ্ঞ গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে হাজতে।
বিজ্ঞানের সমস্তরকম সাবধানবাণীকে একপ্রকার ঝেঁটিয়ে বিদায় করে রাজনৈতিক তকমাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে আজকের ভারতে। এটাই বাস্তব। প্রসঙ্গ চিতা ফেরানো হোক বা মূর্তি স্থাপন। জাতীয় গৌরবের মোড়কে জনগণের মধ্যে আপাত উত্তেজনা উসকে, জাত্যাভিমানের ফাঁপা চেতনা বাড়িয়ে, মূল সমস্যাগুলি থেকে চোখ ফিরিয়ে শিশুর হাতে নতুন খেলনা তুলে দেওয়ার কৌশল করা হছে, যা দেশের বর্তমান শাসক দল মুনশিয়ানার সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই করে থাকেন। সেই নতুন খেলনা কতখানি টেকসই বা কতটুকু তার প্রাসঙ্গিকতা- সেসব নিয়ে আলোচনা করা দেশের বিরুদ্ধে কথা বলা। আজ ভারতে বিশ্বের আট প্রজাতির বিগ ক্যাটের মধ্যে চিতা আনার দৌলতে ৬টি বিদ্যমান। এর নেপথ্যে যে সত্য জ্বলজ্বল করছে, তা হলো এর মধ্যে একটি (এশিয়াটিক সিংহ) অচিরেই হারিয়ে যাবে, এবং ভারতের মাটিতে আফ্রিকান চিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে প্রভূত দ্বন্দ্ব, তার নিরসন না করেই আজ ছয়ের পিঠে আট পাওয়ার নেশায় মাতছি। দু'দিন পর দেশের মাটিতে দুই প্রজাতির বিগ ক্যাট বিলুপ্তির দায় নিতে এগিয়ে আসবে তো এরা? বন্যপ্রাণী জোগাড় করা আর যাই হোক, বিনাকা টুথপেস্টের সঙ্গে বিনামূল্যে পাওয়া প্লাস্টিকের হাতি-ঘোড়া জমিয়ে পরদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কাছে আস্ফালন নয়।
তথ্য সূত্র:
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, দ্য কনজারভেশন, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য হিন্দু, দ্য সোয়াডল