বাজেট ২০২৫: কৃষকের স্বপ্ন কেন এবারও অধরাই থেকে গেল?
Budget 2025: আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কৃষি ও কৃষকের জন্য সরকার অনেক কিছু করতে চাইছে। কিন্তু কৃষকের সমস্যা অনেক গভীরে। যার সমাধানের কোনও দিশা এই বাজেটে নেই।
গতানুগতিক নিয়ম মেনেই ১ ফেব্রুয়ারি, সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। তৃতীয় মোদি সরকারের এটি দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ বাজেট। গত বছর সরকার তৈরির পর যখন বাজেট পেশ হয়, তখন আর্থিক বছরের ৪ মাস অতিক্রান্ত। স্বাভাবিক কারণেই এবারের বাজেট ঘিরে আমজনতার প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। প্রচুর আশা-আশঙ্কার অঙ্কও কষেছেন দেশের মানুষ। চাকুরিজীবি মধ্যবিত্তের যেমন প্রত্যাশা ছিল করকাঠামোতে পরিবর্তন এনে সরকার আয়করে কতটা ছাড় দিচ্ছেন; তেমনই বড় বড় শিল্পপতি, বাণিজ্য সংস্থা তাকিয়ে ছিল কর্পোরেট ট্যাক্সে কতখানি ছাড় হচ্ছে। দেশের কৃষক সমাজ অপেক্ষায় ছিল কৃষি ঋণে হয়তো ছাড় মিলবে, সারের ভর্তুকি বাড়িয়ে সরকার সারের দাম কমাবে। আশায় ছিল কৃষিপণ্যের বাজার সংস্কার করে ফসলের সঠিক দাম পেতে সরকার সদর্থক ভূমিকা নেবে। বেকার যুবক-যুবতীরা স্বপ্ন দেখছিলেন, সরকার ভার্চুয়াল নয় আগামী দিনে প্রকৃতই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগী হবে। এছাড়া আপামর জনগণ বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমার আশায় ছিল। আবার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিফলন যেহেতু বাজেট – স্বাভাবিকভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে অর্থনীতিবিদ, সবার নজর ছিল সরকার কী নীতি গ্রহণ করছে তার দিকে। দেশের কৃষি ও শিল্পের উন্নতি ঘটিয়ে জিডিপি বৃদ্ধিতে সরকার বাজেটে কী প্রভিশন রাখল, জিডিপি বৃদ্ধির বার্ষিক হার কোথায় স্থির করল সেগুলিতে যেমন নজর রেখেছিলেন, তেমনই দারিদ্র্য, বেকারত্ব দূরীকরণে সরকার কতটা আন্তরিক তার দিকেও চোখ ছিল। একটা লম্বা সময় ধরে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে রয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের দাম। এর ফলে গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে হাঁফিয়ে উঠছে। এই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বাজেটে ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হল কিনা, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ল না কমল সে দিকেও দৃষ্টি ছিল। বাজেট ঘোষণার পর এবার হিসেবের পালা।
শনিবার বাজেট ভাষণের সময় নিয়মমাফিক নথিও পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। দেখা গেছে, সরকারি খরচ বরাদ্দের তুলনায় কম। চলতি অর্থবর্ষের জন্য গতবারের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৪৮ লক্ষ ২০ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। এই অর্থবর্ষ শেষ হবে আগামী মার্চে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অনুমান, মোট খরচ পৌঁছবে ৪৭ লক্ষ ১৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকায়। যার মানে, ১ লক্ষ ৪ হাজার ২৫ কোটি টাকা নিজেরই বরাদ্দের তুলনায় কম খরচ করেছে কেন্দ্র। ২০২৪-২৫ অর্থ বর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫ লক্ষ ৫ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। সীতারমণের অনুমান এই খরচ পৌঁছবে ৪ লক্ষ ১৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের জন্য সীতারমণ বরাদ্দ করেছেন ৫ লক্ষ ৪১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১ লক্ষ ২৫ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। খরচ হবে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবর্ষে যদিও বরাদ্দ ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ছিল ৮৯ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এই মার্চে খরচ পৌঁছবে ৮৮ হাজার ৩২ কোটি টাকায়। আগামী অর্থবর্ষে বরাদ্দ ৯৮ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। বিভিন্ন সরকারি খাতে খরচের একই চিত্র। তথ্যের এই কচকচানি একটাই কারণে, বাজেট বরাদ্দ ঘোষণা মানেই অর্থ ব্যয় হবে তা একেবারেই নয়। আবার সরকারি খরচ কম হওয়ায় অর্থ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির গতিকে কমিয়ে দেওয়া। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী সরকারি খরচ বাড়লে জাতীয় আয় বাড়ে (গভর্মেন্ট এক্সপেন্ডিচার মাল্টিপ্লায়ার)। গুণক আকারে।
আরও পড়ুন- ধূ ধূ মরুভূমিতে শস্য-শ্যামল কৃষিক্ষেত! যেভাবে অসাধ্যসাধন করেছিলেন রাজা গঙ্গা সিং!
২০২৫ সালের বাজেটের ঘোষণায় কৃষি, কর কাঠামো, নগরোন্নয়ন, বিদ্যুতের মতো ক্ষেত্রগুলিতে জোর দেওয়া হয়েছে। গত বাজেটেও কৃষিতে জোর ছিল। কিন্তু বাজেটের মজা হলো – গত বাজেটে কী বলা হয়েছিল তার কতটা পূরণ হয়েছে, সেসব নিয়ে মাথা ব্যথা কম। বর্তমান বাজেটে কী পেলাম সেখানেই দৃষ্টি স্থির।
এবারের বাজেটের কৃষি সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য ঘোষণা হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী ধন-ধান্য কৃষি যোজনা’। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত জেলাভিত্তিক কৃষির উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০০ টি জেলায় ওই প্রকল্প শুরু হতে চলেছে। বাজেট নথিতে বলা হয়েছে, দেশে বহু জেলায় ফসলের ফলন তুলনামূলক ভাবে কম। সে সব জেলায় উৎপাদন বাড়াতেই ওই যোজনা আনা হয়েছে। রাজ্যের সহযোগিতায় যোজনাটি রূপায়িত করা হবে। জমির উর্বরতা ধরে রাখতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফসলের চাষ করা, পঞ্চায়েত ও ব্লক পর্যায়ে উৎপাদিত ফসল গুদামে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, উৎপাদন বাড়াতে চাষের জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা উন্নত করা, কৃষকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করাও এই প্রকল্পের লক্ষ্য। সরকার দাবি করেছে যে, এই প্রকল্পের ফলে দেশের প্রায় ১.৭৫ কোটি কৃষক ভবিষ্যতে উপকৃত হবেন। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি যৌথভাবে এই কর্মসূচি রূপায়ন করবে। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল বীজের জন্য একটি জাতীয় মিশন চালু করা হবে। ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদনে সরকার স্বনির্ভর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ৪ বছর ডাল, তৈলবীজের সবটা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কিনে নেবে। সবজি ও ফলের চাহিদা বাড়ছে তাই সেগুলির ফলনের জন্য বড় পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। মহিলা কৃষকদের উন্নতিতে বিশেষ ঘোষণা রয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ১.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হবে কৃষি ও কৃষক কল্যাণ বিভাগে এবং কৃষি গবেষণা বিভাগের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১০, ৪৬৬ কোটি টাকা।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কৃষি ও কৃষকের জন্য সরকার অনেক কিছু করতে চাইছে। কিন্তু কৃষকের সমস্যা অনেক গভীরে। যার সমাধানের কোনও দিশা এই বাজেটে নেই। সেগুলির সমাধান করতে না পারলে কৃষির উন্নতি সম্ভব নয়। দেশের প্রায় ৪৬% মানুষ কৃষি নির্ভর। তাদের আয় বাড়াতে না পারলে কৃষির হাত ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিছুতেই সম্ভব নয়। কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবী স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ এবং সেই দামে ফসল কেনার আইনি স্বীকৃতি - যা কৃষকদের আয় বাড়াবে। তা নিয়ে বাজেটে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। ফসলের উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দেওয়া হয়েছে কিন্তু উৎপন্ন ফসল লাভজনক দামে বিক্রি করতে গেলে কৃষি বাজার সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও কৃষি উপাদানের দাম কমলে ঘুরপথে (ব্যয় কমিয়ে) চাষির আয় বাড়ে। সেই দিকটিও বাজেটে অবহেলিত থেকেছে। অর্থাৎ সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমানোর কোনও উদ্যোগ নজরে পড়েনি।
আরও পড়ুন- ভুল সংশোধন নাকি নয়া কৌশল! ক্ষমতায় বসেই কৃষকদের ভাবনা কেন ভাবছেন মোদি?
কৃষকের দীর্ঘদিনের দাবি কৃষি ঋণ মকুব। সরকার সেদিকে কর্ণপাতই করেনি। কৃষক এমনিতেই ঋণে জর্জরিত, কৃষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে তার ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর অর্থ তাকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে দেওয়া। সরকার প্রথম ৪ বছর উৎপাদিত ডাল, তৈলবীজ সবটা কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি সেই ডাল, তৈলবীজ কিনে সরকার সংরক্ষণ করতে পারবে? দেশে মাত্র ৫% গ্রামে শস্য মজুত ভাণ্ডার রয়েছে। শস্য সংরক্ষণের অভাব আছে বলেই এতদিন পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে শুধু ধান, গম কেনা হয়েছে। বাকি শস্য কেনা থেকে সরকার বিরত থেকেছে। মহিলা কৃষকদের উন্নতির ঘোষণা চমক ছাড়া কিছুই নয়। ভারতে চাষের সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের বেশিরভাগই কৃষি শ্রমিক। তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই নেই। মাত্র ১৩% মহিলার হাতে জমি রয়েছে অর্থাৎ মহিলা কৃষকের সংখ্যা নামমাত্র। মহিলা কৃষকের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে না পারলে কৃষির মাধ্যমে তাঁদের ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।
সরকার কৃষি ও কৃষকের উন্নতিতে অনেকগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কৃষিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটাতে হলে কৃষকের আয় বাড়ানো জরুরি। সে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে হতে পারে বা ফসলের বাড়তি দাম পাওয়ার ব্যবস্থা করেও হতে পারে। যেহেতু দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও কৃষির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁদের আয় বাড়লে তবেই সত্যিকারের কার্যকরী চাহিদা তৈরি হবে। বাজারে গতি আসবে। অর্থনীতি এককদম এগবে। নচেৎ কৃষির হাত ধরে অর্থনীতির বৃদ্ধি অধরাই থেকে যাবে।