প্রতিমা নয়, পটে আঁকা দুর্গা, বর্ধমান রাজবাড়ির অনন্য পুজা প্রথা

Poteshwari Durga: রাজবাড়ির পটচিত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গণেশ ছাড়া প্রত্যেকের চোখ একটি আঁকা। মহালয়ার পর থেকেই রাজবাড়িতে পুজো শুরু হয়ে যায়। এখানে পুজোয় অষ্টমীর দিন কুমারী পুজোর রীতি আছে।

MT

পুরাণ মতে, দেবী দুর্গম নামক এক মহাঅসুরকে সংহার করেছিলেন, সেই থেকে 'দুর্গা' নামের উৎপত্তি। তিনি দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী। নানা রূপে জগতের সব দুঃখ দুর্দশা দূর করেন। দেবীপক্ষে শারদীয়া দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠে বিশ্ব। বাংলার এক ঐতিহাসিক ক্ষেত্র বর্ধমান। এখান থেকে পাওয়া গেছে, জৈন ও বৌদ্ধ যুগের নিদর্শন। মুঘল আমলেও এই জায়গা বহু ঘটনার সাক্ষী। এখানে শক্তিসাধনার কথাও উল্লেখ আছে। বর্ধমান রাজাদের রাজবাড়ির পুজোর পেছনে লুকিয়ে বহু ইতিহাস। পুজো ঘিরে নানা প্রাচীন রীতি। দুর্গা এখানে প্রতিমা নয়, রাজবাড়িতে দেবী পূজিত হন পটে আঁকা ছবিতে। যা দীর্ঘদিনের এক প্রথা। তাই দেবীর নাম 'পটেশ্বরী দুর্গা'।

লোকসংস্কৃতিতে পটশিল্প এখন প্রায় বিলুপ্ত। এই শিল্পে বহু শিল্পী সম্প্রদায় সংকটাপন্ন অবস্থায়। শিল্পের প্রসারের জন্য বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

বর্ধমান রাজবাড়ির মন্দির

শোনা যায়, বর্ধমান রাজবংশে মহাতাব চাঁদ দুর্গাপুজো সূচনা করেন। বর্ধমান রাজের আমল থেকেই দেবী পূজিত হন পটের ছবিতে। রাজবাড়ির কূলদেবী হলেন চণ্ডিকা। তিনি রাজবাড়ির বহু বছরের সমৃদ্ধি, ঐশ্বরিক কৃপা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বর্ধমান জুড়ে দেবী চণ্ডীর আরাধনা বেশি হয়। সাধারণ মানুষ চণ্ডীর পুজো করেন। দেবী সকল দুঃখ কষ্ট দূর করেন। সাধক কমলাকান্তের সাধনস্থল এই বর্ধমান। এখানেই তিনি মাতৃশক্তির সাধনা করেন। বর্ধমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন রাজা সঙ্গমসিংহ। বলা হয়, এই বংশের রাজারা বিষ্ণুপুরের রাজাদের সঙ্গে সন্ধি করে নবাব আলীবর্দীর হয়ে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। কবি ভারতচন্দ্রের কাব্য রচনায় উল্লেখ আছে, বর্ধমান রাজার কন্যা 'বিদ্যা' দেবীর দৈব আদেশ পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- ভাঙা নাকের দুর্গা! বোলপুলের দেউলির পুজো যে কারণে অনন্য

রাজবাড়ির পটচিত্রে দশভুজা দেবী দশ হাতে মহিষাসুরকে নিধন করছেন। চিত্রের বিশেষত্ব হল, দুর্গার সঙ্গে এখানে বাহন ঘোটক বা ঘোড়া। অনেকে একে ঘোটকমুখি সিংহ বলেন। পুরাণ মতে, দুর্গা গজে, ঘোটকে, দোলায় ও নৌকায় মর্ত্যে আসেন। ঐতিহাসিকদের মত, বহু শতাব্দী ধরে যুদ্ধের বাহন ঘোড়া। ফলে দেবী মূর্তিতে সেই প্রভাব পড়েছে। ঘোড়ায় চড়ে দেবী অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। অন্য আর এক মতে, বৈষ্ণব রীতি অনুযায়ী দেবীর বাহন ঘোড়া। সিংহ নয়। তাই এর সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দুই মত রয়েছে।

মন্দিরে দেওয়ালের গায়ে আভিজাত্যের অংশ সিংহ

রাজবাড়ির পটচিত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গণেশ ছাড়া প্রত্যেকের চোখ একটি আঁকা। মহালয়ার পর থেকেই রাজবাড়িতে পুজো শুরু হয়ে যায়। এখানে পুজোয় অষ্টমীর দিন কুমারী পুজোর রীতি আছে। নবমীর দিন ঐতিহ্যবাহী ডাণ্ডিয়া রাস পালন হয়। পুজো ব্যাপী প্রতিদিন থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুন- অতীতে দুর্গাপুজো ছিল ফসল কাটার উৎসব, কীভাবে বিলুপ্ত হল দুর্গাভোগ ধান?

শোনা যায়, রাজবাড়ির কুলোপুরোহিতরা জানান দেবীর পুজো মূর্তি স্থাপন করে করা যাবে না। যেহেতু পরিবারের কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ ও কেশব জিউ তাই পটচিত্রতে পুজোর বিধান দেওয়া হয়। বর্তমানে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে ভগ্ন দালানে পটেশ্বরী দুর্গার পুজো হয়।

আজও বহু দূর দূরান্ত থেকে নদী পার করে মানুষ পুজোর সময় এই রাজবাড়ির দালানে পুজো দেখতে উপস্থিত হন। আশেপাশের বহু অঞ্চলে এই পুজো বহুল প্রচলিত। রাজ পরিবারের নিজস্ব পুজো হলেও সাধারণ মানুষ পুজোর আবহে উপস্থিত হন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই পুজোর মহিমা একটুও কমেনি। তবে রাজবাড়ির দালান ও মন্দির আর আগের চেহারায় নেই। কালের আবর্তে জীর্ণ হয়েছে। ইঁটের ফাঁকে বহু বছরের ইতিহাস চাপা পড়ে আছে। বারো বছর পর পর নবকলেবর হলেও দুর্গার প্রতিকৃতি একই রকম আছে। দেবীর বিসর্জন হয় না। তুলির টানে পটের দুর্গা আভিজাত্য ও সাবেকিয়ানায় এইভাবেই হাজির হন ভক্তের মাঝে।

More Articles