একের পর এক বিএলও অসুস্থ–মৃত! নির্বাচন কমিশনের টনক নড়বে না?
Bengal BLO Crisis: বিএলওরা সবচেয়ে বড় যে-অভিযোগটি করেছেন সেটি হলো এই যে, ট্রেনিংয়ে তাঁদের একবারও বলা হয়নি যে, ডেটা অনলাইনে এন্ট্রি করার কাজটিও তাঁদেরই করতে হবে। এই কাজটির জন্য কোনো ট্রেনিংও তাঁদের দেওয়া হয়নি।
“আমি বাঁচতে চাই, আমার সংসারে কোনো অভাব নেই। কিন্তু এই সামান্য চাকরির জন্য এরা আমাকে এই ভাবে ভরাডুবির মাধ্যমে মরতে বাধ্য করল। আমার এই পরিণতির জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী, আমি কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না। খুবই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এই অমানুষিক কাজের চাপ আমি নিতে পারছি না। আমি একজন পার্শ্বশিক্ষিকা। বেতন পরিশ্রমের তুলনায় খুবই কম। কিন্তু এরা আমাকে ছাড় দিল না। অফলাইন কাজ আমি ৯৫% শেষ করে ফেলেছি কিন্তু অনলাইন আমি কিছুই পারি না। বিডিও অফিসে এবং সুপারভাইজারকে জানানো সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা করল না”। এই কথাগুলি লিখে আত্মহত্যা করেছেন রিঙ্কু তরফদার। সম্পূর্ণ সুইসাইড নোটটি পড়লে চোখ জলে ভরে উঠতে বাধ্য। সুইসাইড নোটের শেষের দিকে রিঙ্কু এটিও পরিষ্কার করেছেন যে, তাঁর এই মৃত্যুর জন্য তাঁর পরিবারের কেউই কোনোমতেই দায়ী নয়। প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, এইরকম একটি সুইসাইড নোট প্রকাশ্যে আসার পর কেন কোর্ট নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো মামলা শুরু করবে না?
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর আবশ্যিক ছিল। একাধিক ভুয়ো ভোটারের নাম যেমন এ-রাজ্যের ভোটার তালিকায় আছে, তেমনই রয়ে গেছে মৃত ভোটারদের নাম, অনুপ্রবেশকারীদের নাম। এসআইআর চালু হতেই বর্ডার পেরিয়ে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের। অনুপ্রবেশের দায় অবশ্যই প্রাথমিকভাবে বিএসএফের। তারপরে এই অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত না-করার দায় কিন্তু রাজ্য পুলিশের। তারা যে-দালালচক্রের মাধ্যমে ভোটার কার্ড পেয়েছে, সেই দালালচক্রটিকে বাঁচিয়ে রাখার দায় রাজ্যের শাসক দলের। কাজেই এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা পাওয়ার জন্য এসআইআর আবশ্যিক। কিন্তু এই কি ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন করার পদ্ধতি? ২০০২ সালে এই এসআইআরের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল দু-টি বছর ধরে। এই ২৩ বছরে ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ পরিমাণে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া কাজই সম্পন্ন করা হচ্ছে দু-মাসেরও কম সময়ে। এর চেয়ে বড়ো অন্যায় আর হয় না। কাজ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে এই কাজটি শুরু করেছে। ভোটারদের হয়রানি তো হচ্ছেই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিপন্ন মনে হচ্ছে বিএলওদের। এঁদের অনেকেই ইতোমধ্যেই চাপ সহ্য না করতে পেরে হয় অসুস্থ হয়েছেন, নাহলে মারা গিয়েছেন। এখনও যদি নির্বাচন কমিশনের টনক না নড়ে, তাহলে আগামী দিনে বিএলওদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
আরও পড়ুন
এসআইআর: ভোটের আগে ‘ব্র্যান্ড মমতা’র হাতে চাঁদ?
কী কী সমস্যায় পড়েছেন বিএলওরা? কথা ছিল, ৪ নভেম্বর ২০২৫-এ সমস্ত ভোটারের ফর্ম একসঙ্গে তুলে দেওয়া হবে বিএলওদের হাতে। কিন্তু, তা দেওয়া হয়নি। প্রথম দফায় কিছু ফর্ম এবং কিছুদিন পরে আর এক দফায় বাকি ফর্ম দেওয়া হয়। যেহেতু একটি পরিবারের একাধিক ভোটারের নাম ভোটার তালিকায় বিভিন্ন ক্রমিক নম্বরে থাকে, তাই দু-দফায় ফর্মগুলি পাওয়ার জন্য একই পরিবারে একজন বিএলওকে বারেবারে যেতে হয়েছে। এজন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএলওদের কাউকে কাউকে ১৬ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, এমন খবর পেয়েছি।
বিএলওদের একাংশের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সমাজমাধ্যমে এক ধরনের প্রচার করা হয়েছে আর তাদের ট্রেনিংয়ে দেওয়া হয়েছে আরেক ধরনের নির্দেশ। যেমন, ফর্মে একজন ভোটারের ছবি যুক্ত করার কথাটিই ধরা যাক। বিএলওদের অভিযোগ, কখনও বলা হয়েছে ছবি দেওয়া বাধ্যতামূলক, কখনও বলা হয়েছে ছবি না দিলেও চলবে। এ প্রসঙ্গে কোনো পরিষ্কার নির্দেশিকা নেই। যে-এনুমারেশন ফর্ম দেওয়া হয়েছে, সেটি যথাযথভাবে পূরণের একটা নির্দেশিকা ফর্মের উলটো পিঠে দেওয়াই যেত। কিন্তু, তা করা হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমিও এই ফর্মটি ফিল-আপ করতে গিয়ে দেখেছি একটি দু-টি জায়গায় যে ঠিক কী তথ্য চাওয়া হচ্ছে, তা ফর্মে ব্যবহৃত বাংলা ভাষাটির মাধ্যমে পরিষ্কার করে বোঝানো যায়নি। ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে আমাকে আমার এলাকার বিএলওকে ফোন করতে হয়েছে দু-বার। আমারই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে সাধারণ ভোটারদের অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কার্যত প্রচুর ভোটার সঠিকভাবে ফর্ম ফিলাপ করতে পারেননি। এই সমস্ত ভোটারদের হিয়ারিং অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংগঠিত করে কীভাবে তাঁদের সুবিচার দেওয়া যাবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন বটেই।
বিওএলওরা অভিযোগ করছেন যে, প্রথমে নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হয়েছিল কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য অ্যাডিশনাল বিএলও দেওয়া হবে কিন্তু সেটাও দেওয়া হয়নি। বিএলওরা ডেপুটেশন দেওয়ার পর অ্যাডিশনাল বিএলও দেওয়া হয়, তাও তাঁদের, যাঁদের পার্টে ১২০০র ওপর ভোটার আছে। তবে বিএলওরা সবচেয়ে বড় যে-অভিযোগটি করেছেন সেটি হলো এই যে, ট্রেনিংয়ে তাঁদের একবারও বলা হয়নি যে, ডেটা অনলাইনে এন্ট্রি করার কাজটিও তাঁদেরই করতে হবে। এই কাজটির জন্য কোনো ট্রেনিংও তাঁদের দেওয়া হয়নি। এমন অনেক বরিষ্ঠ শিক্ষক আছেন যাঁরা স্মার্ট ফোন বা কমপিউটার ব্যবহার করতে একেবারেই দক্ষ নন। তাঁদের পক্ষে এই কাজ কী করে করা সম্ভব? এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সময়ে কাজ শেষ করার জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে প্রচ্ছন্ন হুমকি। রিঙ্কু তরফদার যে আত্মহত্যা করেছেন, তাও তিনি করেছেন এই আতঙ্ক থেকেই যে, কিছুতেই তাঁর পক্ষে অনলাইনে ডেটা এন্ট্রি করা সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন
এসআইআর | যেভাবে নাভিশ্বাস উঠছে বিএলওদের
আজ তাই কেন বিএলওদের ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের সাহায্য দেবে না নির্বাচন কমিশন– এই প্রশ্ন উঠবেই। প্রশ্ন উঠবেই যে, অ্যাপটির মাধ্যমে ডেটা এন্ট্রি করা হচ্ছে তার কার্যকারিতা নিয়েও। অ্যাপটি অত্যন্ত ধীর গতির। মাঝে মাঝেই লগ আউট হয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী বিএলওদের অনেকেই এই লেখককে জানিয়েছেন যে, অ্যাপটি সকাল ৬টা থেকে ১১টা এবং রাত ৮টা থেকে ১১টা–এইটুকু সময়ই মোটামুটি কাজ করছে, তাও সবদিন নয়। অ্যাপটি থেকে এটিও তাঁরা দেখতে পারছেন না যে, কত সংখ্যক ফর্ম জমা হয়েছে। ডেটা এন্ট্রি করতে গিয়ে কোনো ভুল হয়ে গেলে এডিট অপশনও পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে এই প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে যে, তথ্য সম্পাদনার সুযোগ পরে দেওয়া হবে। প্রশ্ন উঠবেই, এই ধরনের ভয়ংকর একটি অ্যাপ দিয়ে কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা সম্ভব? এই কি ডিজিটাল ইন্ডিয়ার নমুনা? বিএলওদের অনেকেই এই লেখককে এটিও জানিয়েছেন যে, ২০০২-এর ভোটার তালিকার অনলাইন ম্যাপিংয়েও কিছু সমস্যা আছে। অনেক ক্ষেত্রেই তালিকায় নাম থাকা একজন ভোটারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দেখাচ্ছে ‘নো রেকর্ড ফাউন্ড’।
এসআইআর-এর কাজ বন্ধ করে দেওয়া নিশ্চয়ই এই সমস্যাগুলি সমাধানের পথ নয়। কিন্তু অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের উচিত এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার সময়সীমা বাড়ানো। এত তাড়া কীসের? নির্বাচন কমিশন কি একটি রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করতে পারে? এসআইআরের সময়সীমা বাড়ানো না হলে তো এই প্রশ্ন উঠবেই। অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের উচিত অ্যাপটিকেও যথার্থভাবে কার্যকরী করে তোলা এবং বিএলওদের সাহায্য করার জন্য ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের নিয়োগ করা। এগুলি না করা হলে কিন্তু এমনটা মনে হবেই যে, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার জন্যই নির্বাচন কমিশন কাজ করছে।

Whatsapp
