বিশ্বকাপে বাঙালির অবিশ্বাস্য জয়! বিশ্বকাপে নক্ষত্রপতন দীপ্তায়ন হারালেন নেপোমনিয়াশৎশিকেকে
Chess World Cup 2025: বিশ্বকাপের ধরন- নক আউট অর্থাৎ হারলেই ছিটকে যাওয়া। তৃতীয় রাউন্ড চলছে সবে। এরপরে সেরা ষোলো, তারপরে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। অপ্রত্যাশিত এমন অনেক ফলাফল সামনে আসবে।
দীপ্তায়ন ঘোষ পেরেছেন। রাশিয়ার ইয়ান নেপোমনিয়াশৎশিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের তৃতীয় রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাংলার দীপ্তায়ন ঘোষ এই মুহূর্তে বিশ্বের ২৩৭ নম্বর আর নেপোমনিয়াশৎশির র্যাঙ্ক ১৯। নেপোমনিয়াশি দু’বছর আগেও বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা দাবাড়ুর স্থান ধরে রেখেছিলেন। ২০২১ ও ২০২৩ পরপর দু’টি বিশ্বখেতাবী যুদ্ধে চ্যালেঞ্জার ছিলেন তিনি। এহেন নেপোমনিয়াশৎশিকে বিশ্বকাপের লড়াই থেকে ছিটকে দেওয়া সহজ না। কিন্তু, অসম্ভব কিছুই না। ক্রীড়া ইতিহাস আরও একবার নক্ষত্রপতনের সাক্ষী হলো পাঁচই নভেম্বর।
দীপ্তায়নের জয়কে অঘটন বলতে রাজি নই। কারণ, নেপোমনিয়াশৎশির বিরুদ্ধে দু’দিনের দু’টো ক্লাসিক্যাল গেমে দীপ্তায়ন আধিপত্য রেখেছে। একবারও মনে হয়নি দীপ্তায়ন বিশ্বের একদা দু’নম্বর কিংবা দু’বারের ক্যান্ডিডেটস জয়ী দাবাড়ুর বিরুদ্ধে অহেতুক রক্ষণাত্মক নীতিতে পজিশন সামলাচ্ছে। বরং ঠিক সময়ে বিপক্ষের ভুলের সদ্বব্যবহার করে অ্যাডভান্টেজ বাড়িয়ে নিয়েছে। প্রথম গেমে দীপ্তায়ন ও নেপোমনিয়াশৎশির দানের নির্ভুলত্ব ছিল যথাক্রমে ৯৮.৫% ও ৯৯%। নিখুঁত খেলা। ওপেনিং থেকে মিডলগেম, তত্ত্ব প্রয়োগে বিচ্যুতি ছিল না কোনো। চেনা নীতি, জানা কৌশল, স্বাভাবিক প্রয়োগ। দ্বিতীয় গেমে নেপোমনিয়াশৎশির সাদা।
নেপোমনিয়াশৎশির বর্তমান রেটিং দীপ্তায়নের থেকে ১৫৯ পয়েন্ট বেশি। আর, সাদা নিয়ে সাধারণতঃ আক্রমণাত্মক নীতিতে খেলাই দস্তুর। স্প্যানিশ ওপেনিং খেলেছিলেন নেপোমনিয়াশৎশি। তাঁর বহু যুদ্ধজয়ের অস্ত্র এই ওপেনিং। দীপ্তায়ন সপ্তম দানে ক্যাসল করেছিলেন। মরফি ডিফেন্সে সপ্তম দানে কালোর ক্যাসল করার তাৎপর্য এরপর সাদা c3 দান দিলে, কালো d5 দান দিয়ে মার্শাল গ্যাম্বিট শাখা বেছে নিতে পারে অথবা d6 করে বদ্ধ মাঝছকের খেলা। মার্শাল গ্যাম্বিট ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু আক্রমণাত্মক শাখা; সাদা ও কালো দু’জনের জন্যই সুযোগ থাকে অ্যাডভান্টেজ ছিনিয়ে নেওয়ার। নেপোমনিয়াশৎশি অষ্টম দানে সাদা নিয়ে খেললেন a4- অ্যান্টি মার্শাল ধরন। কালোকে মার্শাল গ্যাম্বিট খেলা থেকে বিরত করলেন। কিন্তু, অ্যান্টি মার্শাল সাদার জন্য সামান্য রক্ষণাত্মক নীতি। নেপোমনিয়াশৎশি সম্প্রতি একেবারেই নিজের চেনা ফর্মে নেই। পরপর বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় অনেকটা রেটিং পয়েন্ট খুইয়েছেন। তাই কি সাদা নিয়ে আক্রমণাত্মক নীতির বদলে কিংবা এতটা কম রেটেড দাবাড়ুর বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলের বদলে মেপেজুপে রক্ষণাত্মক শাখা বেছে নিলেন? তাঁর প্রস্তুতিতেও কি খামতি রয়ে গেছিল কোনো? দীপ্তায়ন তাঁর স্বাভাবিক খেলাটুকু খেললেন। বিপক্ষ যদি রক্ষণাত্মক নীতি বেছে নেয় ওপেনিং থেকে, তাহলে তাঁর উপরে মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়ানো এবং রক্ষণের ব্যূহগুলির উপরে স্থির ও দৃঢ় আক্রমণের কৌশল বেছে নেওয়া- দীপ্তায়ন ঠাণ্ডা মাথায় এই কাজটা করলেন।
আরও পড়ুন
শুধু ক্রিকেট নয়, খেলা ঘুরছে ফুটবল মাঠেও, নেপথ্যে অভীষ্টারা
১৪ নম্বর দানে সাদার পক্ষে যেক’টি দান দেওয়া সম্ভব, তার মধ্যে Bc4 দানটাই সবচেয়ে ভালো। কুইন সাইডে পিসগুলি নিষ্ক্রিয় না হয়ে সচল থাকে। কালোর অগ্রসরমান পন-কাঠামোর বিরুদ্ধে একটা পালটা লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে সাদা। উল্লেখ্য ২০২৪ সালে বাংলার সম্ভাব্য গ্র্যান্ডমাস্টার উৎসব চ্যাটার্জি হাঙ্গেরির গ্র্যান্ডমাস্টার গার্গলি ক্যান্টরের বিরুদ্ধে এই ওপেনিং শাখাটি খেলে জিতেছিলেন। অন্য শাখাগুলোয় সাম্প্রতিক প্রায় সমস্ত খেলায় গেম ড্র হয়েছে বা কালোর জিত। নেপোমনিয়াশৎশি কি এই গেমগুলি ভুলে গিয়েছিলেন? অথবা, সেই প্রস্তুতির খামতি? তাই ১৪ নম্বর দানে Nf3, তারপরের দানে h3? দীপ্তায়ন সাম্প্রতিক গেমগুলির বিশ্লেষণ করে তৈরিই ছিলেন। তাই ক্রমে স্বখাতসলিলে ডুবতে চাওয়া নেপোমনিয়াশৎশির পজিশন আরও বদ্ধ ক’রে দেন তিনি। সাদার পিসগুলি এরপরে খেলতে না-পেরে ছটফট করেছে। আর, কালো ১৮ নম্বর দানে সময়োপযোগী কৌশলপ্রয়োগে পন জিতে নিয়েছে। যথাসময়ে কুইন খাওয়াখাওয়ি করে দ্বৈতি রুক+বিশপ এন্ডগেমের দিকে নিয়ে গেছে। সাদার খারাপ পজিশন খারাপতর হয়েছে। দীপ্তায়ন এরপরে ব্যাকরণ মেনে খেলে গিয়েছেন। নেপোমনিয়াশৎশির ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিপরীত বর্ণের বিশপ খাওয়াখাওয়ি হয়ে গেছে। ৪৬ নম্বর দানে, হেরে যাওয়া রুক+পন এন্ডগেমে রণক্লান্ত নেপোমনিয়াশৎশি পরাজয় স্বীকার করেছেন। দীপ্তায়ন ক্রীড়াবিজ্ঞানের নিয়মে প্রমাণ করেছেন যে, অসাধ্য কিছুই না, অসম্ভব কিছুই না। সঠিক সময়ে সঠিক নীতি-কৌশলের প্রয়োগ আর স্নায়ুগত দৃঢ়তা অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাস্য ক’রে তুলতে পারে।
চলতি বছরের ৫ নভেম্বরের নক্ষত্রপতন শুধু নেপোময়াশিৎশির হারেই সীমিত না। গ্র্যান্ডমাস্টার ওয়েসলি সো। এই মুহূর্তে বিশ্বের আট নম্বর। ২০১৭ সালে টানা কয়েকমাস বিশ্বের দু’নম্বর স্থান দখল করেছিলেন। সর্বোচ্চ রেটিং ২৮২২। ওয়েসলি কিন্তু নেপোমনিয়াশৎশির মতো অফ ফর্মে নেই। তবু, লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ডমাস্টার টাইটাস স্টেমাভিচিয়াসের কাছে পরাজয় স্বীকার করে ছিটকে গেলেন বিশ্বকাপ থেকে। আরও আশ্চর্য যে পজিশনে সো পরাজয় স্বীকার করলেন, তা স্ট্রেমাভিচিয়াসের জয়সূচক পজিশন ছিল না। দাবা-ইঞ্জিনের বিচারে গেমটি ড্র হচ্ছিল।
কুইন্স গ্যাম্বিট ডিক্লাইন্ড শাখায় শুরু হয়েছিল গেম। ওয়েসলি সো কালো আর স্ট্রেমাভিচিয়াস সাদা। এক্সচেঞ্জ রকমফেরে সাদার Bf4 দান অধুনা দাবায় বেশ জনপ্রিয়। দু’জনেরই ওপেনিং প্রস্তুতি ভালো ছিল। তাই অষ্টম দান থেকেই ‘নভেলটি’ বা নতুনত্ব দান। স্ট্রেমাভিচিয়াস সময় নিচ্ছিলেন, ভাবছিলেন, কিন্তু সেরা দানগুলিই খুঁজে পাচ্ছিলেন। ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর দানে মোট ৩২ মিনিট সময় নিয়েছিলেন। বাইশ নম্বর দানে আট মিনিট ভেবে বের করলেন চমৎকার একটি দান- g5! এই দানপর্যায়ে জিতে নিলেন একটি পিস। একটি পিসের ক্ষতিপূরণে দু’টি পন বেশি ওয়েসলি সোর। পজিশনের অবনতি হচ্ছে, কিন্তু লড়া যায়। ওয়েসলি অভিজ্ঞ, এন্ডগেমের তত্ত্ব ভালোই জানেন। তাই কুইন এন্ডিংটা লড়ে গেলেন ভালভাবে। স্ট্রেমাভিচিয়াসের ভুলে কুইন খাওয়াখাওয়ি করে পজিশন সমানও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু, এরপরেই গেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এন্ডগেম একইসঙ্গে তত্ত্ব ও নিখুঁত দানগণনার মিশেল! কোনো একটায় দুর্বলতা থাকলেই প্রত্যাশিত ফলাফল বদলে যাবে। সো গেমটা জিততে পারবেন না ঠিক, কিন্তু তাই বলে হেরেও যাবেন না। ৫৪ নম্বর দানে g4 খেলে যে পজিশনটা তৈরি করলেন, তাতে তাঁর দু’টো সংযুক্ত অপ্রতিরোধ্য পন। কিন্তু ভুল করলেন সময়ের চাপে পড়ে। সাদাও ভুল করল। এন্ডগেম যতটা নিখুঁত ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ার কথা ছিল, তা হলো না। তবু, শেষপর্যন্ত ড্র করার পজিশন পেয়ে গেছিলেন সো। অথচ সময় প্রায় শেষ। স্নায়ুর চাপ রাখতে পারলেন না। গ্র্যান্ডমাস্টারসম দানপর্যায় গণনা করতে না পেরে হঠাৎই পরাজয় স্বীকার করে নিলেন।
আরও পড়ুন
রণক্লান্ত দামাল মেয়েদের শুশ্রূষার আলো হরিণী মুরলী
একই রাউন্ডে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেন তিন তরুণ দাবাড়ু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হ্যান্স নিম্যান, ভারতের অরবিন্দ চিথাম্বরম এবং নিহাল সারিন।। তিনজনেরই এলো-রেটিং ২৭০০-র উপরে এবং এঁরা প্রত্যেকেই প্রথম তিনটি স্থান দখলের অন্যতম দাবিদার ছিলেন। লেখাটি শেষ করব স্বপ্নভঙ্গের আরেক অধ্যায় দিয়ে। ভারতের দুই তরুণ নক্ষত্র নিহাল সারিন ও দিব্যা দেশমুখের বিরুদ্ধে গ্রিক পুরাণের থানাতোসের মতো হাজির হলেন স্তামাতিস কৌর্কুলোস-আর্দিতিস। পরপর দুই রাউন্ডে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিলেন দু’জনকে। দিব্যা দেশমুখ। এই বিশ্বকাপে একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি। বিশ্বখেতাবজয়ী জু ওয়েনজুন ও হু ইফান অংশগ্রহণে রাজি না হওয়ায় দিব্যা সুযোগ পেয়েছিলেন বিশ্বকাপে খেলার। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই আর্দিতিসের কাছে হেরে বিদায় নিলেন। প্রথম গেমে কালো নিয়ে নিমজো ইন্ডিয়ান ডিফেন্স খেললেন। নিমজো শাখার একটি তুলনামূলক কম-পরিচিত রকমফেরে ঢুকলেন। নিজের পন-আঠামো যথাযথ রেখে সাদার পন-কাঠামোয় দুর্বলতা তৈরি করে দিলেন। ধ্রুপদী দাবানীতি। এরপর দিব্যার ভুলের সুযোগ নিয়ে মিডলগেমের শুরুতেই পন আপ। সেই পন আর ফেরত পাননি দিব্যা, উলটে পজিশন আরও খেরাপ হয়েছে এন্ডগেমের শুরুতে। রুক এন্ডগেমে কালো নিয়ে সহজ জয় পেয়েছেন আদ্রিতিস। দ্বিতীয় গেমে পার্ক ডিফেন্সের ধ্রুপদী শাখা। আর্দিতিস সাদা, কিন্তু আক্রমণের নীতি নেননি। প্রতিরক্ষা ব্যূহ সাজিয়ে পিসগুলিকে সচল রেহেছেন। দিব্যাকে সেই প্রতিরক্ষা ভেঙে জিততেই হত। কিন্তু, আক্রমণ সাজিয়ে নিতে পারেননি দিব্যা। তাই পন খুইয়েছেন। এবারেও সেই দ্বৈত রুক এন্ডগেম। অ্যাডভান্টেজ ধীরে ধীরে জয়সূচক অবস্থানে বদলে নিয়েছেন আর্দিতিস। পরের রাউন্ডে একশোর বেশি রেটিং পয়েন্ট থাকা নিহাল সারিনকে টাইব্রেকারে ছিটকে দিয়েছেন প্রতিযোগিতা থেকে।
বিশ্বকাপের ধরন- নক আউট অর্থাৎ হারলেই ছিটকে যাওয়া। তৃতীয় রাউন্ড চলছে সবে। এরপরে সেরা ষোলো, তারপরে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। অপ্রত্যাশিত এমন অনেক ফলাফল সামনে আসবে। লম্বা প্রতিযোগিতার ধকল, ধ্রুপদী দাবার ধৈর্য, টাইব্রেকারে স্নায়ুর চাপ এবং জেতার ধারাবাহিকতা যে দাবাড়ুরা রাখতে পারবেন, তাঁরাই অন্যদের ছিটকে দিয়ে পরের রাউন্ডে পৌঁছে যাবেন। কিছু ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, শুরুর দিকেই নেপোমনিয়াশৎশি, নিম্যান, সো, সারিনের মতো দাবাড়ুরা ছিটকে যাওয়ায় প্রতিযোগিতার জৌলুশ কমল। আমি একমত নই। কারণ, বিশ্বকাপ যেমন প্রতিষ্ঠিত সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারদের মঞ্চ, তেমনই তুলনামূলক ‘অনামী’ ‘অবাছাই’ দাবাড়ুদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের মঞ্চ। তাঁদের প্রস্তুতি আর দক্ষতার যুগলবন্দি ঔজ্জ্বল্য পাবে এখানেই। তাঁরাই বিশ্বকাপের লড়াই আরও আকর্ষণীয় করে তুলবেন। পিটার লেকো ছেচল্লিশ বছর বয়সে ফের জ্বলে উঠে দু’দশক আগের জমানা মনে পড়িয়ে দেবেন। দীপ্তায়ন, আর্দিতিস, স্ট্রেমাভিচিয়াসরা প্রত্যাশার দিগন্ত বাড়িয়ে দেবেন। বিশ্বকাপ জমে গেছে। এরপরের রাউন্ডগুলিতে আরও অপ্রত্যাশিত, অনেক অবিশ্বাস্যর জন্য দর্শকরা তৈরি থাকুন!
Whatsapp
