শীতের মরণকামড় আর পদে পদে বিপদ: এবার মাকালুর পথে পিয়ালী

Piyali Basak: শীতকালে খুবই কঠিন মাকালু জয় করা। শীতে সেখানে তাপমাত্রা পৌঁছে যায় -৭০°তে। বাতাসের বেগ থাকে, প্রতি ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার।

চন্দননগরের মেয়ে পিয়ালী বসাক, পেশায় শিক্ষিকা, নেশায় পর্বতারোহী। পাহাড়ের টানে তিনি ঘর ছাড়েন বারবার, সমতলে তাঁর মন টেকে না। মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে, মাকালু, অন্নপূর্ণা ১, ধৌলাগিরি এবং মানাসুলুর পর এবার তাঁর লক্ষ্য মাকালু। তা-ও আবার শীতকালে। শীতে মাকালুর তাপমাত্রা নামে -৭০°তে। বাতাসের বেগ, প্রতি ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। কিন্তু তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন তিনি বারবার যান পর্বতে? কেবলই সাধ মেটাতে? পর্বতারোহণের খরচ যোগাতে একাধিক ঋণ নিতে হয় তাঁকে। তাঁর সমস্ত বেতনই চলে যায় ঋণ শোধ করতে। এখন বাসাটুকুও বন্ধক দেওয়া। তা সত্ত্বেও এবার তাঁর উদ্দেশ্য শীতকালে মাকালু জয়।

বিশ্ব রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে ফের আরও একবার হিমালয়ের পথে চন্দননগরের ভূমিকন্যা পিয়ালী বসাক। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের কোনো পর্বতারোহী শীতকালে মাকালু (৮,৪৮৫ মিটার) জয় করতে পারেননি। প্রথমবারের মতো সেই রেকর্ড গড়ে নজির গড়তে চাইছেন তিনি। পৃথিবীর সমস্ত পর্বতশৃঙ্গ জয় করা তাঁর স্বপ্ন। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ছয়টি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ায় যথাক্রমে- মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে, মাকালু, অন্নপূর্ণা ১, ধৌলাগিরি এবং মানাসুলুতে পা রেখেছেন পিয়ালী। ২০২৩ সালের ১৭ মে মাকালু জয় করেছিলেন। তবে সেবার তিনি পর্বতারোহণ করেন  গ্রীষ্মকালে। শীতকালে খুবই কঠিন মাকালু জয় করা। শীতে সেখানে তাপমাত্রা পৌঁছে যায় -৭০°তে। বাতাসের বেগ থাকে, প্রতি ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। তুষার ঝড়ের মধ্যে এভারেস্ট এবং লোৎসে জয় করে ফিরেছিলেন পিয়ালী। সেই অভিজ্ঞতা এবার কাজে লাগবে বলেই তাঁর মত।

বিশ্বের প্রথম এভারেস্টজয়ী তেনজিং নোরগে বলেছিলেন, "এভারেস্ট নয়, মাকালু তাঁর চোখে সবচেয়ে সাংঘাতিক অভিযান"। এই প্রসঙ্গে পিয়ালী বসাক ইনস্ক্রিপ্টকে জানান, "হ্যাঁ মাকালু আরোহণ খুবই কঠিন। গ্রীষ্মকালীন আরোহণ যখন করেছিলাম, থার্ড ক্যাম্পে গিয়ে কিছু পর্বতারোহীর হাতে ফ্রস্টবাইট হয়ে গেছিল। আর তেনজিং নোরগে আমার কাছে ভগবান। পাঁচ বছর বয়সে মা ওঁর এভারেস্ট জয়ের গল্প শুনিয়েছিল, তখন থেকেই আমারও বিশ্ববিখ্যাত পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্ন।" তিনি আরও জানান, বাবা-মার মৃত্যুর পর তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছেন। সমতলে ডিপ্রেসড ফিল হয়, পাহাড়ে গেলে নিজেকে শক্তিশালী লাগে। সেই শক্তিরই আরও একবার পরীক্ষা নিতে এই চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন- এভারেস্টজয়ীরাও ভয় পান! পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বত এটিই…

আগের পর্বত আরোহণগুলি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করেছিলেন, এবার বাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। চন্দননগরে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা পিয়ালী বলেন, "সমস্ত বেতন লোন শোধ করতেই চলে যায়। ক্রাউড ফান্ডিং করে টাকা জোগাড় করার চেষ্টাও হয়েছে এবার। যে যেমন পেরেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।" পিয়ালী আরও বলেন, "মানুষের ভালোবাসাতেই আজ আমি এখানে। এবার মাকালু জয় করতে পারলে বাবা-মায়ের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। প্রথমের দিকে তো ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে টয়লেটের পাশে বসে গেছি, বাসে মেঝেতে বসে গেছি, সিট নিইনি টাকা লাগবে বলে। আমি সাফল্য পেলে ভারতের জয় হবে তো বটেই, তারই সঙ্গে আশা করি আমি আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলে-মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে পারব যে, শূন্য থেকে শুরু করেও বিশ্বসেরা হওয়া যায়।"

২৩ ডিসেম্বর মাকালুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন পিয়ালী। কাঠমান্ডু থেকে প্রথমে টুমলিংতার পৌঁছবেন, তারপর শুরু হবে পর্বতারোহণ। বেসক্যাম্পে পৌঁছতেই লাগবে আট থেকে দশ দিন। এরপর আরও চারটি ক্যাম্প আরোহণ করে চূড়ায় পা রাখবেন। তাতে সময় লাগবে প্রায় দেড়-দুই মাস। অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষে আরোহণ শুরু করে সামিট করবেন জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির প্রথমের দিকে। এর আগে ইতালি থেকে একজন এবং রাশিয়ার একজন পর্বতারোহী নভেম্বরে আরোহণ শুরু করে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মাকালুর চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। তবে তাঁদের আরোহণকে শীতকালীন ধরা হয়নি, বলে জানান পিয়ালী। ইরান থেকে দুই পুরুষ পর্বতারোহী এবং নেপালের দু’জন তাঁর সঙ্গে এই অভিযানে রয়েছেন। তাঁরা যদি সফল হন, তাহলে সারা বিশ্বে পিয়ালীরাই প্রথম শীতকালে মাকালু জয় করবেন।

More Articles