দাবা বিশ্বকাপের সেরা চমক কলকাতার দীপ্তায়ন, ফিরে দেখা যাত্রাপথ
Chess World Cup 2025: দীপ্তায়ন ঘোষের গল্পটা আরেকবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশে দু'তিনটে খেলার বাইরে বিশ্বপর্যায়ের ক্রীড়াবিদদের জীবনটা কতটা কঠিন।
দু'বার ক্যান্ডিডেটস প্রতিযোগিতা জিতে ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল খেলেছেন ইয়ান নেপোমনিয়াশৎশি। ওয়ার্ল্ড ব্লিৎস্ চ্যাম্পিয়নশিপে গত বছর ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন প্রথম স্থান। দাবা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে তাঁর প্রতিপক্ষের থেকে তাঁর রেটিং প্রায় পৌনে দু'শো এলো পয়েন্ট বেশি। রুই লোপেজ ওপেনিংয়ের যে লাইনটাকে বলে মর্ফি ডিফেন্স, সেটা ধরেই সাদা ঘুঁটি নিয়ে এগোচ্ছিলেন ইয়ান। তিনি বোর্ডে মন্ত্রীটা রেখেই খেলতে চাইছিলেন, কিন্তু মন্ত্রী সরিয়ে ঘোড়ার যে চালটা তিনি দিলেন, তাতে তাঁর পজিশনের বিশেষ উন্নতি হয়নি। তাঁর প্রতিপক্ষ এতক্ষণ নিজের প্রস্তুতির মধ্যেই ছিলেন, প্রায় মুখস্ত দান দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই প্রথম খানিকটা সময় নিয়ে তিনি নিজের মন্ত্রীটা e7-এ পাঠিয়ে নিজের e5-এর বোড়েটা রক্ষা করলেন। ইয়ান এবার যেন খানিকটা ইতস্তত করলেন। মিনিট ছয়েক ভেবে তিনি যখন কিছুটা প্যাসিভ কায়দায় বোড়েটা ঠেললেন h3-তে, তাঁর প্রতিপক্ষ হঠাৎই রক্তের গন্ধ পেয়ে গজটা পাঠালেন a3-তে। সমান্তরাল দু'টো ডায়গোনালে দু'টো ধারালো গজ বসিয়ে নেপোমনিয়াশৎশি-কে খানিকটা কোণঠাসা করে তাঁর তুলনামুলক অখ্যাত প্রতিপক্ষ দীপ্তায়ন ঘোষ, স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন খেলাটা এখন কার হাতে।

দীপ্তায়নের যাত্রাপথ
দীপ্তায়ন ঘোষের গল্পটা আরেকবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশে দু'তিনটে খেলার বাইরে বিশ্বপর্যায়ের ক্রীড়াবিদদের জীবনটা কতটা কঠিন। লেকটাউনে বড় হয়ে ওঠা দীপ্তায়ন অভিজিৎ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গের অনূর্ধ্ব-৭ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে প্রথম নজর কাড়েন। তারপর অনূর্ধ্ব-৯ এবং অনূর্ধ্ব-১৩ বিভাগে জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। এর মাঝে অনূর্ধ্ব-১০ আর অনূর্ধ্ব-১২ বিভাগে এশিয়ান ইউথ চেস চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি সোনার মেডেল জেতেন ২০০৮ আর ২০০৯ সালে। দেশীয় স্তরে আরও বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য টুর্নামেন্ট জিতবার পাশাপাশি বৈশ্বিক পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ চেস অলিম্পিয়াডে যে ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়ন হয় ২০১৩ আর ২০১৪ সালে, সেই দলে দু'বারই ছিলেন দীপ্তায়ন।
কলকাতার নামজাদা অ্যালেখাইন চেস ক্লাবে যোগ দিয়ে শঙ্কর রায়ের কোচিংয়ে দীপ্তায়ন আরও তীক্ষ্ম হয়ে উঠছিলেন। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার খেতাব পাবার পাশাপাশি সেই বছরই এপ্রিলে তিনি নিজের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম হাসিল করেন দুবাই ওপেনে। দু'বছর বাদে চেক ওপেনে নিশ্চিত করেন দ্বিতীয় নর্মটা। পরের বছর মার্চ মাসে ভিয়েতনামে এইচডি ব্যাংক ওপেনে নয় রাউন্ডের প্রতিযোগিতায় ৬.০ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম স্থান অধিকার করে তিনি অবশেষে তিন নম্বর নর্মটা অর্জন করে হয়ে যান গ্র্যান্ডমাস্টার। দীপ্তায়ন নিজের সর্বোচ্চ এলো রেটিং ২৫৮১-তে পৌঁছন আর এক বছরের মধ্যেই।
আরও পড়ুন
দাবা বিশ্বকাপে নতুন চমক! দীপ্তায়নের কাছে হার বিশ্বচ্যাম্পিয়নের
এই চমকপ্রদ উত্থানের পথ একেবারেই সহজ ছিল না। দাবার মতো খেলায়, যেখানে স্পন্সরশিপের বাজার অত্যন্ত ছোট, সেখানে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে সব ছেড়েছুড়ে খালি দাবায় মনোনিবেশ করা ভীষণ কঠিন, এমনকি মাত্র ষোলো বছরে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যাওয়া খেলোয়াড়ের পক্ষেও। তাঁর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর কথায় কর্ণপাত না করে দীপ্তায়ন দাবার থেকে নিজেকে খানিকটা সরিয়ে এনে মন দেন পড়াশোনায়। সেন্ট জেভিয়ার্সের স্নাতক দীপ্তায়ন দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সে মাস্টার্স পাশ করেন। তারপর ২০২১ সালে আইডিএফসি ফার্স্ট ব্যাংকে চাকরি নিয়ে চলে যান মুম্বইতে। প্রথাগতভাবে যাকে আমরা সফল কেরিয়ার বলি, তাতে নিজেকে সঁপে দিয়েও কিন্তু দীপ্তায়ন বেশিদিন দাবার জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি।
২০২২-এর শেষদিকে চাকরি ছেড়ে ফের মনোনিবেশ করেন দাবায়। আগের তিন-চার বছরে হাতে গোনা কয়েকটা টুর্নামেন্ট খেলেছিলেন তিনি। যে খেলোয়াড়দের একটা সময়ে নিয়মিত হারিয়ে দিতেন, তাঁরা অনেকেই দীপ্তায়নকে পেছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছিলেন। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। ধীরে ধীরে নিজের সেরা ফর্মের কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। দীপ্তায়নকে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন, তাঁরা কেউই দীপ্তায়নের প্রতিভা সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেননি। কিন্তু নিজের যৌবনের সেরা সময়ের একটা বিরাট অংশ জুড়ে দীপ্তায়ন দাবায় মনোনিবেশ করেননি। তাই তিনি তাঁর উপযুক্ত জায়গায় আদৌ আর পৌঁছতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল অনেকেরই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দাবা সংস্থার এককালীন সেক্রেটারি উদয়ন ঘোষ যেমন একপ্রকার নিশ্চিত যে মাঝের সময়টা নিজেকে সরিয়ে না রাখলে আজ ভারতীয় দাবাড়ুদের মধ্যে গুকেশ আর প্রজ্ঞানন্দের পরেই যাঁদের নাম উঠে আসে তাঁদের মধ্যে একজন হতে পারতেন দীপ্তায়ন। এখন সময় অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দীপ্তায়নের গত কয়েক বছরের অধ্যবসায় আর পরিশ্রম দাবা জগতে তাঁকে নিয়ে বেশ খানিকটা আশাবাদ গড়ে তুলতে পেরেছে।
এখন গোয়ায় চলছে ২০২৫ ফিডে বিশ্বকাপ। প্রথম রাউন্ডে চিনের গ্র্যান্ডমাস্টার পেং জিয়াংজিয়ানের বিরুদ্ধে ক্লাসিক্যাল খেলাদুটি ড্র করে টাইব্রেকারে র্যাপিড টাইম কন্ট্রোলে পরপর দু'টো খেলা জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে নেন দীপ্তায়ন। সেখানেই তাঁর খেলা পড়ে বিশ্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দাবাড়ু ইয়ান নেপোমনিয়াশৎশির বিরুদ্ধে। স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা ভারী ছিল রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ক্লাসিক্যাল খেলায় সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলেছিলেন দীপ্তায়ন। খেলা একটু এগোতেই বোঝা যায় কালো ঘুঁটির নেপোমনিয়াশৎশি এই খেলায় ড্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন। তিনি চেষ্টা করবেন সাদা ঘুঁটি নিয়ে দীপ্তায়নকে হারানোর। দাবার এই পর্যায়ে কালো ঘুঁটি নিয়ে ম্যাচ জেতা বেশ কঠিন, তবুও দীপ্তায়ন ড্র নিশ্চিত করে টাইব্রেকারে জেতে চাননি।
দীপ্তায়ন গজটা a3-তে পাঠিয়ে মন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ করায় নেপোমনিয়াশৎশি ঠিক যেখানে মন্ত্রীটা রাখতে চাননি, সেই d1 এই তাঁকে মন্ত্রীটা ফিরিয়ে আনতে হলো। এতক্ষণে সাফ হয়ে গিয়েছে d-ফাইলটা। গজ উঠে যাওয়ায় সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে দীপ্তায়নের নৌকোজোড়া। এতক্ষন যে ঘুঁটিটা তিনি একবারও নাড়াননি, সেই a8-এর নৌকোটাকে এবার সোজা বিপক্ষ মন্ত্রীর ফাইলে এনে দাঁড় করালেন দীপ্তায়ন। ঘোড়াটাকে আবার ফেরত এনে নৌকোর আগ্রাসন আটকালেন নেপোমনিয়াশৎশি। কিন্তু তাঁর পজিশন ততক্ষণে বেশ খানিকটা নড়বড়ে হয়ে এসেছে।

দীপ্তায়ন ঠান্ডা মাথায় পরের কয়েক দানে নিজের সুবিধে অনুযায়ী কয়েকটা ঘুঁটি এক্সচেঞ্জ করে বোর্ডটা অনেকটা সরল করে আনলেন। তাঁর কালো খোপের গজটার বদলে তিনি আদায় করে নিলেন একটা ঘোড়া আর একটা বোড়ে। তারপর নেপোমনিয়াশৎশিকে বাধ্য করলেন মন্ত্রী এক্সচেঞ্জ করতে। সর্বজ্ঞ স্টকফিশ ততক্ষণে জানিয়ে দিয়েছে কালোর দিকে পাল্লা বেশ অনেকটা ভারী। নিজের অ্যাডভান্টেজ ধরে রেখে বোর্ডটা আরও খানিকটা সাফ করে আনলেন দীপ্তায়ন। নেপোমনিয়াশি যখন দেখলেন তাঁর রাজা আর কুইনসাইডে আসন্ন দীপ্তায়নের পন-ব্রেকথ্রুর মাঝে দন্ডায়মান দীপ্তায়নের নৌকো, এবং সেই নৌকো বোড়ের প্রতিরক্ষায় উঠে আসতে পারে দ্বিতীয় র্যাঙ্কে, তখন তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল কুইন সাইডের এককোণে নেপোমনিয়াশৎশির রাজাকে ব্যস্ত রেখে, শেষ নৌকোটাও এক্সচেঞ্জ করে দীপ্তায়ন g-ফাইলের বোড়েটাকে সহজেই প্রমোট করে নিতে পারবেন।

ছেচল্লিশ দানে অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন ইয়ান নেপোমনিয়াশৎশি। দীপ্তায়ন টুর্নামেন্টের অন্যতম অবিস্মরণীয় অঘটন ঘটিয়ে পৌঁছে গেলেন তৃতীয় রাউন্ডে। সেখানে আর্মেনীয় দাবাড়ু গ্যাব্রিয়েল সার্গিসিয়ানের বিরুদ্ধে প্রথম তাঁর খেলাটা ড্র হলেও, দ্বিতীয় খেলায় দীপ্তায়নকে নতি স্বীকার করতেই হলো। বিশ্বকাপে তাঁর উপস্থিতি সংক্ষিপ্ত হলেও, দাবার জগতে গত কয়েক বছরে ভারতীয় খেলোয়াড়দের জয়জয়কারের মধ্যে ঘরের ছেলে দীপ্তায়ন ঠিকই আমাদের উপহার দিয়ে গেলেন আরও একটা স্বর্ণালী মুহূর্ত।

Whatsapp
