মেয়াদ শেষ চন্দ্রচূড়ের! অবসরের পর কোন কোন কাজ করতে পারেন না প্রধান বিচারপতিরা?

Chief Justices Facilities After Retirement: সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অবসর গ্রহণের দিন থেকে একজন গৃহকর্মী এবং আজীবনের জন্য একজন গাড়িচালক পাবেন।

গত ১০ নভেম্বর ভারতের প্রধান বিচারপতি হিসাবে ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের মেয়াদ শেষ হলো। নতুন দায়িত্বভার নিলেন বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। ডিওয়াই চন্দ্রচূড়কে নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। মেয়াদের শেষপ্রান্তে এসে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে সওয়াল ওঠে। প্রশ্ন ওঠে শাসকদলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়েও। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের আশঙ্কা ছিল, বিচারপতি চন্দ্রচূড় শাসকের ঘনিষ্ঠ হওয়াতে অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেন। মেয়াদ শেষের পরে সত্যিই কী করবেন তিনি? প্রাক্তন বিচারপতিরা কি অবসর গ্রহণের পরে সাংবিধানিক বা বিধিবদ্ধ পদে থাকতে পারেন?

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতিরা ঠিক কী কী করতে পারেন না?

সংবিধানের ১২৪(৭) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারকদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে যে কোনও ভারতীয় আদালতে আইন অনুশীলন করা নিষিদ্ধ। "এমন কোনও ব্যক্তি যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসাবে পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে কোনও আদালতে বা কোনও কর্তৃপক্ষের সামনে আবেদন বা কাজ করবেন না," বলছে দেশের সংবিধান।

এই নিষেধাজ্ঞার পেছনের যুক্তি হলো বিচার বিভাগের সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের যে কোনও বিচারককে আইন অনুশীলন করার অনুমতি দেওয়া হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে তাঁদের পূর্ববর্তী রায়গুলি বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার উপর অযাচিত প্রভাব ফেলতে পারে।

আরও পড়ুন- রাম মন্দিরের রায় দিতে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়?

কেন অবসরের পরেও একজন বিচারপতিকে এত নিয়ম মেনে চলতে হবে?

স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়ানো: ধরা যাক, একজন প্রাক্তন বিচারক পূর্বে কোনও মামলার রায় দিয়েছিলেন, তেমন মামলার ক্ষেত্রেই আবার একজন উকিল হিসাবে উপস্থিত হচ্ছেন। তাতে বিচার বিভাগের সততা এবং নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে না বলেই আশঙ্কা। ওই বিচারকের রায়ের পক্ষপাতিত্ব নতুন করে মামলাকে প্রভাবিত করতেই পারে।

বিচার বিভাগের অখণ্ডতা বজায় রাখা: একজন বিচারক, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের স্তরের কোনও বিচারক অপরিমেয় সম্মান ও কর্তৃত্বের অধিকারী। অবসর গ্রহণের পরে যদি সক্রিয়ভাবে আবার আইন অনুশীলন শুরু করেন তিনি তাহলে এই মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

নৈতিক বিবেচনা: আইন অনুশীলনের উপর নিষেধাজ্ঞার নৈতিক প্রভাবও রয়েছে। বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা এর সদস্যদের প্রকৃত নিরপেক্ষতার উপরই নির্ভর করে।

অযৌক্তিক প্রভাব রোধ করা: যেহেতু প্রধান বিচারপতিদের কাছে নানা সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে, তাই অবসর গ্রহণের পরে তাদের আইন অনুশীলন করার অনুমতি দিলে তথ্যের অপব্যবহার হতে পারে।

তাহলে অবসর গ্রহণের পর বিকল্প কোন ভূমিকায় কাজ করতে পারেন বিচারপতিরা?

সালিশ এবং মধ্যস্থতা: অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা প্রায়ই বিভিন্ন বিবাদে সালিশ বা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেন, কারণ তাদের আইনি দক্ষতা এবং জটিল আইনি বিষয়ে বোঝার ক্ষমতা আছে। আরবিট্রেশন অ্যান্ড কনসিলিয়েশন অ্যাক্ট, ১৯৯৬ অনুসারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সালিশ হিসাবে নিয়োগের অনুমতি রয়েছে।

কমিশনের চেয়ারপার্সন বা সদস্য: অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা প্রায়শই ভারতের আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালের মতো বিভিন্ন কমিশন ও ট্রাইব্যুনালের চেয়ারপার্সন বা সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এই ভূমিকাগুলিতে তাদের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা অমূল্য।

আকাডেমিয়া এবং আইনি শিক্ষা: অনেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আইন স্কুলে শিক্ষকতা করেন, বক্তৃতা দেন বা আইনি বিষয়ে লেখালেখি করেন যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের বিশাল জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হয়।

পাবলিক সার্ভিস: কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল বা বিভিন্ন সরকারি কমিটি এবং কমিশনের প্রধান হিসাবে কিছু অবসরপ্রাপ্ত বিচারক সাংবিধানিক এবং বিধিবদ্ধ পদে নিযুক্ত হন।

আরও পড়ুন- ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের গণেশপুজোয় মোদি! ভারতের প্রধান বিচারপতি আদৌ নিরপেক্ষ?

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপরতি ও বিচারকদের অবসর-পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে আগেও। সমালোচকদের মতে, বিভিন্ন কমিশন ও ট্রাইব্যুনালে বিচারকদের অবসর-পরবর্তী নিয়োগকে 'পুরস্কার' হিসেবেও দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ এই বিচারপতিরা তাঁদের মেয়াদকালে শাসকের পক্ষে এমন কোনও অনুকূল রায় দিয়েছেন যে কারণে তাঁদের ওই পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির চরম ক্ষতি করে দেয় এই 'পুরস্কার'। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে অবসর গ্রহণের পরপরই রাজ্যসভায় মনোনীত করা হয়েছিল। তখন এই ধরনের নিয়োগের নৈতিকতা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। সমালোচকদের যুক্তি, এই ধরনের নিয়োগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি জনগণের আস্থাকে নষ্ট করতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং অন্য বিচারকরা অবসর-পরবর্তী বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করেন। ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের তারিখ থেকে শুরু করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সারাক্ষণ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়াও তাদের বাসভবনে সর্বক্ষণের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী হবেন।

একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রাক্তন বিচারপতি অবসর গ্রহণের তারিখ থেকে ছয় মাসের জন্য দিল্লিতে বিনামূল্যে টাইপ-৭ আবাসনের অধিকারী হবেন। টাইপ ৭ আবাসন সাধারণত সেই বর্তমান সাংসদদের দেওয়া হয় যারা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অবসর গ্রহণের দিন থেকে একজন গৃহকর্মী এবং আজীবনের জন্য একজন গাড়িচালক পাবেন। বিমানবন্দরগুলিতে আনুষ্ঠানিক লাউঞ্জের সুবিধাটি অবসরপ্রাপ্ত সিজেআই এবং সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের জন্যই বাড়ানো হয়েছে।

একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক একটি টেলিফোন পরিষেবা পাবেন বিনামূল্যে। টেলিফোন বা মোবাইল ফোন বা ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল ডেটা বা ডেটা কার্ডের জন্য প্রতি মাসে ৪,২০০ টাকা পাবেন তিনি।

More Articles